বিদ্যুৎ সরকার : উঠোনের এক পাশে শুধু আমাদের ঘর, অনেকটা রেল গাড়ির কামরার মতোন। বাড়ির অন্যান্যদের ঘরগুলো বাকি তিন পাশে সুবিন্যস্ত। আমাদের ঘরগুলোর মতনই। আমাদের শেষ প্রান্তের ঘরটি আকারে ছোট, স্টোর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর আগেরটা বৈঠক খানা কাম গেষ্ট রুম। আর, এ প্রান্তের ঘরদুটোর একটিতে বাবা-মা, ছোট ভাই এবং এ দিকের শেষ ঘরটি শুধুই আমার জন্য বরাদ্দ। ঘরটি আমার লেখাপড়া ও থাকার জন্য ব্যবহার করা হয়। পাশেই পুকুর। খোলা জনালায় পুকুরের জলজ ছবিসমগ্র আমার বাড়তি পাওয়া। কাঠফাটা রোদের দুপুরগুলোতে জানালার ফ্রেম হয়ে যায় আমার গ্রামীণ টেলিভিশন। কাছের নিস্তরঙ্গ পুকুরের চিরায়ত নৈশব্দ ভেংগে জলের গভীরে ঢুকে যায় মিন রাশির মাছরাঙা। ব্যর্থ হতে দেখিনি। কখনো দূরের সবুজ ধানখেত হঠাৎ হু হু বাতাসে দোল খেতে থাকে অনাবিল সুখের ছোঁয়ায়। দুরন্ত শিশুর উরন্ত ঘুড়ির লাটাইয়ে অসীম মন যোগাযোগে আত্মনিবেদিত। ঘুড়ির সুতোর টানের সাথে প্রাণের টান একই সূত্রে বাঁধা পড়ে যায় তখনি। আমার একলা আকাশ পাখি আর রঙিন ঘুড়ির উড়ালে রঙিন হয়ে যায় অজান্তেই। শুয়ে শুয়ে টিনের চালে জামরুলের বোল পরার শব্দ শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমের দেশে চলে যেতাম। আমারই ঘরের ঠিক উপরটায় জামরুল গাছের একটি মস্ত ডাল, সেখান থেকেই বোল পরার শব্দের উৎপত্তি। ঝরে পরা বোল দিয়ে বিকল্প লাটিম ঘুরানোর আনন্দ খুঁজে পেতাম।
জামরুলের রঙ গোলাপি থেকে লালে চলে আসতো পরিপক্কতার তাগিদেই। শৈশবে রক্তিম জামরুলগুলোকে অবুঝের মতো রক্ত সর্বস্ব ফল বলে ভুল করতাম এবং ভেবে নিতাম কামড়ে কামড়ে বুঝি রক্ত ক্ষরণ। ভুল করে ভুল ভালোবাসায় মন ও প্রাণ দুলে উঠতো- ‘মোর বীণা উঠে কোন সুরে বাজি…।’
যে দিন জামরুল গাছে উঠার ছাড়পত্র পেলাম, মনে হলো আমি যেন আকাশ ছোঁয়ার লটারি টিকেট পেয়ে গেছি কপাল গুনে। গাছে উঠে ইচ্ছে মতো যে কোন ডাল থেকে যে কোন রক্তিম জামরুল নিজ হাতে পেরে নিতে পারবো, এ এক আকাশচুম্বি অনিন্দ্য আনন্দ আমাকে ভীষণভাবে আলোরিত করেছিল অন্তরের অন্তস্থলে। প্রায় প্রতিদিনই পড়া শেষে রক্তিম জামরুল পারার সুখানুভূতি খুঁজে নিতাম। এমনি এক সুখকে খুঁজতে গিয়ে আমি পেয়ে গেলাম অন্য এক অদেখা অপার্থিব সুখের সন্ধান। জামরুল গাছের কোটরে একটি শালিকের গোপন বাসা। এ এক অপ্রত্যাশিত ভালোলাগার প্রত্যাশিত সুখ আমাকে আনন্দের নাগর দোলায় দোল দিয়ে যাচ্ছিলো বার বার। জামরুলের কচি পাতা চুইয়ে চুইয়ে এক চিলতে রোদ যেন আমাকে উত্তাপ দিচ্ছিলো চিরন্তর। প্রতিদিন নির্জন শান্ত দুপুরে অপেক্ষায় থাকতাম শালিক দুটোর আগমনের শুভ ক্ষনটির জন্য। চক্ চকে কালচে নরোম পালকের গভীরে লুকিয়ে আছে আমর সমস্ত ভাললাগার উত্তাপ। হলুদ ঠোটের সীমানায় অসীম সংগীতময় সুরের মূর্চ্ছনা। আমার প্রতিটি দুপুর আসে ধান শালিকের নরোম পালকের গড়ম পরশ নিয়ে। ধূসর পালকের পেলবতায় পুলকিত হয় আমার হৃদয় যখন-তখন। ধান শালিকের শুভ আগমনের শুভদৃষ্টিতে আলোকিত হয় মন।

বার বার ওদের ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, তবুও অনিচ্ছার ঘেরাটোপে আটকে থাকে আমার চঞ্চল হাত। চিরতরে হারানোর এক অহেতুক ভয় আমাকে নির্ভীক হতে কখনো উৎসাহিত করে না। চঞ্চল মন আনমনা হয় তাদের অশরীরি ছোঁয়া পেলে। এমনি এক দুপুরে আমার এতোদিনের জমানো অনুপম ভালোলাগার স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো পিছনে ঠেলে দিয়ে স্বপ্নপুরীতে নিয়ে গেলো কোটরে লুকিয়ে রাখা ধান শালিকের সুনীল ডিমগুলো। ডিমের নীল রং মিশে আছে আকাশের নীলে। কবে ডিম থেকে ছানা বের হয়ে আকাশের নীল সামিয়ানায় পাখা মেলে উড়বে সে প্রত্যাশার প্রহর গুনি আমি। আমার একটি মাত্র সবুজ গ্রাম, সেই গ্রামে একটি ছোট্ট ঘরের খোলা জানালা। জানালার গভীরে লুকিয়ে আছে একটি জামরুল গাছ, রক্তিম জামরুলের লালিমা, কোটরে ধান শালিকের নীল ডিমের উচ্ছ্বাস ছানা হোয়ে পাখা মেলে উড়ার। প্রান্তর জুড়ে বাতাসে দোল খাওয়া সবুজ ধানখেত, একটি মাত্র সুনীল আকাশ, আকাশে অচিরেই উড়বে ধূসর রঙের শালিক ছানা দল। আমার ঘরের জনালায় বহে সুবাতাস নিরন্তর।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা