বিদ্যুৎ সরকার : আমার তো কোন সাজানো বাগান নেই, ফুলের সৌরভে মৌতাত হবে চারিধার। আমার তো কোন ছায়া সুনিবির গৃহকোণ নেই দোয়েলের শিষে ঘুম ভেঙ্গে যাবে আরবার। আমার যেমন ছিল নন্দিত অতীত তেমনি আছে নিন্দিত বর্তমান- শুধু বেঁচে থাকা এক রূপোলী স্বপ্নের ঘোরে।

সেদিন হঠাৎ করেই ও’র সাথে দেখা। অপ্রত্যাশিত ছিল না, হলেও হতে পারে এমনটা ভাবনায় ছিল। বলেছিলাম ‘আমাকে একটু ছুঁয়ে দিবে?’ কেন কী হবে ছুঁয়ে দিলে- কোন জিজ্ঞাসা, ভাবনার সময় ক্ষেপন হয়নি মোটেও। আলতো করে ছুঁয়ে দিল ও। আলতো ছোঁয়ায় কী যে শিহরণ ছিল আঙ্গুলের সরু সরু ডগায় জানি না। আমি শিহরিত, রক্ত কণিকায় দে দোল দোলায় আন্দোলিত। আমি একটি স্বপ্নের ভিতর হারিয়ে গিয়েছি- উড্ বাইন বীচকে মনে হলো আমার চিরচেনা বুড়ি গঙ্গার পাড়, কত শত পাল তোলা নৌকা লাল, নীল, সবুজ। চেনা আকাশ, লাল সূর্য, অন্তহীন সবুজ প্রান্তর চোখ জুড়োয় প্রাণ জুড়োয়। বুড়িগঙ্গা ব্রীজ ভালোবাসার সেতু। রেলিং থেকে দেখা জলের মধ্যে প্রিয়তমার মুখ, মাছেদের চঞ্চল চলাচল। নদীর মাঝে মস্ত ভেসাল- ‘ভি’ ফর ভিক্টোরি। ভেসালের জালে আটকে আছে পড়ন্ত বিকেলের অস্তগামী লাল সূর্য। পদ্মা অভিমুখে ছুটে চলে বাস, ইটের ভাটার ট্রাক, যাত্রীবাহী অটোরিক্সা- লক্ষ্য একটাই ‘হাওয়া বদল’, ইলিশের রূপালী ঝিলিক, স্রোতস্বিনী পদ্মার নিমগ্নতা। ঢেউয়ের পর ঢেউ, জলের ভেতর হারিয়ে যায় অমৃতের সন্ধানে, অসীমের সীমানায়। হু হু বাতাসে আঁচল উড়ে, অবাধ্য চুল-কেমন জানি সিনেমার রোমান্টিক জুটি বনে যায় অজান্তেই। ফিরতি বাসে চলে আসবে সবাই। তবুও, মনে মনে দৃশ্যায়িত হবে পদ্মা দর্শন। আমি তখনও দাঁড়িয়ে থাকবো ব্রীজের রেলিং ধরে। কখনো বুড়িগঙ্গার সবুজ জলরাশি আবার, কখনো আকাশ নীলের গভীরে সূর্যাস্তের লালিমা- চোখ স্থির হয়ে যাবে অস্থির দৃশ্য বদলের ক্ষণে।
আবদুল্লাহপুর, নিমতলী, মাওয়া, শেষ প্রান্তে পদ্মা। কতোদিন যাইনি। পদ্মা দর্শনে সুখ খুঁজে পাই, নির্মল বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাসে অনাবিল শান্তি। ঢেউয়ের বুকে লুকিয়ে থাকে নাগর দোলার দোল। উঠছে আবার নামছে, মাঝে মাঝে পতনের শব্দ, এক অবাক করা মূহুর্ত- আমি পদ্মা প্রেমে মগ্ন হয়ে যেতে চাই বার বার আব্দুল আলীমের গানের টানে প্রাণের গানে।
মাঝে মধ্যেই আমি আমাকে নিয়ে ভাবি আমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে আমাকে দাঁড় করাই, ভেবে নেই বিপরিতে অপর এক আমি। যেমন, আয়নায় আমার প্রতিচ্ছবি। আমার অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি আমার অপর ‘আমির’র কাছে জানতে চাই। ভাললাগা, মন্দলাগা, কুশলাদি। ভাবতে চেষ্টা করি আমার অতীতকে- ফ্রেমহীন প্রেমময় অতীত, তুমুল আড্ডা-ঝড়ে উৎপাটিত সুখের শিকড়, গভীর থেকে আরো গভীরে। মৃত্তিকার গভীরে লুকিয়ে থাকা রসসিক্ত সুখের শিকড়। ক্লাসের ফাঁকে মধুর কেন্টিনের লেবুর চা, রমজান ভাইয়ের গরম সিঙ্গারা উইথ লাভ, শরীফ ভাইয়ের সাচ্চা কাচ্চি বিরিয়ানী। কখনো কখনো টিএসসি’র সীমিত সবুজে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার অবগাহন। বাঁধভাঙ্গা চাঁদের আলোতে জ্যোৎস্নার প্রতিবেশী হয়ে ঘরে ফেরা। মাঝে মাঝে অনেক রাত হয়ে যেত ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। দিনের ক্লান্ত দু’চোখে ঘুম চলে আসতো সময়ের আগেই। স্বপ্নরাও বুঝি নেমে আসতো মশারির মতোন। সেই স্বপ্ন জুড়েও কলা ভবনের করিডোর, সহপাঠীদের আড্ডার বেড়াজাল, আই ই আর এ বন্ধুর সহযাত্রী হয়ে চায়ের উষ্ণতায় দেহ-মন চাঙ্গা, বিকেলে বলাকা হল, নিউ মার্কেট, নীল ক্ষেতের নীল ছবির অনন্য অনুসন্ধান- এসব নিত্যকার রুটিন। স্বপ্নময় রাত ভোর হতো কাক ভোরেই। সে স্বপ্নগুলো কেন আর ঘুমের ঘোরে আসতে চায় না? স্বপ্নরাও কি সময়ের আবর্তে অতীত হয়ে এক শরতের মেঘ হয়ে উড়ে উড়ে চলে যায়। সময়ের ব্যবধানে স্বপ্ন বদলে যায়, নতুন মোড়কে, নতুন বর্ণে গন্ধে চোখের কার্নিশ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়।

আমারও কি কোন স্বপ্ন ছিল, অমল কান্তির যেমন? ও’তো রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। শুধুই রোদ্দুর, কাক ডাকা ভোরের স্নিগ্ধ রোদ্দুর। জামরুলের সবুজ পাতায় এক চিলতে রোদ্দুর। অমলের সেই স্বপ্ন কোনদিন পুরণ হয়নি। আমারো তো স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন আছে অমলের মতোন রোদ্দুর হওয়ার। আজও সে স্বপ্ন সফল হয়নি শুধু উপলব্ধির দরোজায় কড়া নাড়ে মাতাল বাতাস। জোছনার বাতাসে ভিজে যাচ্ছে সবুজ ঘাসের সমতল ভূমি, নির্লিপ্ত সরোবরে অবিরাম বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ। অমল আর আমি একই নো-ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে স্বপ্নহীন স্বপ্ন পাগল মানুষ।

আমার তো কোন স্বপ্ন ছিল না উড়ে এসে জুড়ে বসার! এমন বরফাচ্ছন্ন প্রকৃতির মাঝে ঘাস ফড়িং খোঁজার, আমার কি এমন স্বপ্ন ছিল নীলকন্ঠ পাখির পালকের বদলে স্নো-ফল দেখার, আমায় কেন বড় অনিচ্ছায় স্বপ্ন দেখায় নায়াগ্রা জলপ্রপাতের? তবুও এই শহরে আমার একটি স্বপ্নালোক আছে স্বপ্নের পরিবর্তে স্বপ্ন দেখায়, ভালোবাসার পরিবর্তে ভালোবাসা বিলোয়, ছুঁয়ে দিতে বললে আলতো করে ছুঁয়ে দেয়- ঠিক তক্ষুনি আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। স্বপ্নের ঝুল বারান্দায় একটি রুপোলি চাঁদ, চাঁদের ভেতর সোনালী চুলের এক স্বপ্ন কুমারী। তবুও আমি স্বপ্ন পূরণের আশায় বেঁচে আছি। ছোট্ট একটি স্বপ্ন পূরণ, এক চিলতে রোদ্দুর হওয়া। এক টুকরো মেঘের ভেতর এক চিলতে রোদ্দুর বা জামরুল-চালতার সবুজ পাতার উপর স্বচ্ছ শীতল রোদ্দুর।

শা শা তুমি কি আরও একবার আমাকে ছুঁয়ে দেবে? তুমি ছুঁয়ে দিলেই আমি স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাই বার বার। আমার তো ছোট্ট একটি স্বপ্ন, রোদ্দুর হওয়ার স্বপ্ন!!
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা