মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

সাতাশ.
ঋত্বিক ঘটকের ত্রয়ী চলচ্চিত্রের শেষ চলচ্চিত্র ‘সুবর্ণরেখা’ ১৯৬২ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৬৩ সালে তিনি সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁন’কে নিয়ে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। হরিসাধন দাশগুপ্তের প্রযোজনায় এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছিলেন ঋত্বিক নিজেই। মাইহারে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁন’র গৃহে এবং তাঁর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের চিত্রগ্রহণ শেষ হবার পর প্রযোজকের সাথে ঋত্বিকের দ্বন্দ্বের কারণে ছবিটি আর শেষ হয়নি। এই প্রামাণ্যচিত্রের আগে ঋত্বিক ১৯৫৫ সালে অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের প্রযোজনায় তৈরী করেন ‘ওঁরাও’ আদিবাসীদের নিয়ে আরেকটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। ১৯৫৮ সালে নির্মিত তাঁর প্রথম সফল চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’ এ আমরা তাঁর ‘ওঁরাও’ প্রামাণ্যচিত্রের একটা প্রভাব দেখি কিছু আদিবাসী নৃত্য ও শব্দে। এছাড়া তিনি ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তৈরি করেন ‘সিভিল ডিফেন্স’, ১৯৬৭ সালে ‘সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো’, ১৯৭০ সালে ‘পুরুলিয়ার ছৌ’ এবং ‘আমার লেনিন’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও সব শ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে সাহায্য তোলার জন্য তিনি বোম্বের চলচ্চিত্রের চল্লিশ জন খ্যাতনামা অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সঙ্গীত শিল্পী ও পরিচালকদের নিয়ে ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ভারতের চিত্রজগতের তারকাদের উপলব্ধি করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ঋত্বিক ঘটক আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন, এর একটি ১৯৭২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওপর ‘ইন্দিরা গান্ধী’ নামে এবং ১৯৭৫ সালে শান্তিনিকেতনের প্রাকৃত শিল্পী রাম কিংকর বেইজ’এর ওপর ‘রাম কিংকর’ নামে। দুটি ছবিই একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে আর শেষ হয়নি। ‘রাম কিংকর’ প্রামাণ্যচিত্রের সম্পাদনার কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল, একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি ‘সাউন্ড’ এর কাজ করছিলেন। কিন্তু তাঁর শরীর প্রচণ্ড খারাপ হতে থাকে এবং ১৯৭৬ এর ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মাসে আমাদের ছেড়ে অনন্ত পাড়ে চলে যান।

১৯৪৮ সালে ঋত্বিক ঘটকের পরিবার শেষবারের মত রাজশাহীর পদ্মা পার হয়ে চলে যায় ওপার বাংলায়। ঋত্বিক কখনো এই ভাগাভাগি আর ধর্মের জন্য এই বিভাজন রেখা কখনো পারেননি। তাঁর জন্ম-নাড়ি রয়ে গেছে পুরনো ঢাকার মাটি। তাঁর অসম্ভব সুন্দর বাল্যস্মৃতি রয়ে গেছে ময়মনসিংহ শহরে, যখন সেই ১৯৩০ সালের দিকে তাঁর বাবা ছিলেন সেই শহরের একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তারপর তাঁর অসম্ভব, না ভোলা সময় কেটেছে রাজশাহী শহরে একেবারে পদ্মার পাড়ে। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার মিডফোর্ট হাসপাতালে ঋত্বিক ঘটক এই পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন তাঁর বোন প্রতীতি দেবীকে নিয়ে যিনি জন্মেছিলেন ঋত্বিকের জন্মের সাত মিনিট পরে। একই মাতৃজঠর ভাগ করে এই পৃথিবীতে আসা প্রতীতি দেবী ছিলেন ঋত্বিকের সব চেয়ে প্রিয় মানুষ। ঋত্বিক বারবার বলতেন, এই পৃথিবীর তাঁর সব চেয়ে প্রিয় মুখ হচ্ছে তাঁর যমজ বোন ‘ভবি’। ছোটবেলায় এই নামেই ডাকা হতো প্রতীতিকে আর ঋত্বিককে ‘ভবা’। অদ্ভুত ব্যাপার, যে বাংলা ভাগকে ঋত্বিক কখনো মেনে নিতে পারলেন না, সেই ঋত্বিকের জীবনে অসহনীয় বিচ্ছেদ ঘটে গেল তাঁর বোনের সাথে। ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর পরই বিচ্ছেদটা ঘটে যায়। প্রতীতি দেবী বিয়ে করেন কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পাশ করা তরুণ সাংবাদিক সঞ্জীব দত্তকে। সঞ্জীব দত্তের বাড়ি তিতাস নদীর পাড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পিতা ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। দেশ ভাগের সময় অনেক হিন্দু পরিবার পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় চলে গেলেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা তাঁদের শিকড় ছেড়ে যাবেন না। ফলে ঋত্বিকের হৃদয়ের অংশ ‘ভবি’কে থেকে যেতে হয় তাঁর এপার বাংলায়।

চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতিক ঘটক

নয় ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট আর আদরের প্রতীতি দেবীর বিচ্ছেদ ঘটে সবার সাথে। নিজের দেশ তখন তাঁর কাছে পরবাস। ইচ্ছে করলেই ছুটে যাওয়া যায় না সব ভাইবোন আর নিজ বাবা-মা’র কাছে। এই আপনজনদের কাছে তাঁকে যেতে হলে ‘পাসপোর্ট’ নামে একটা কাগজ-বইয়ের প্রয়োজন পড়ে। তবে তাঁর এই কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দেবতূল্য শ্বশুর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যিনি অপার প্রেম আর ভালোবাসায় ভালোবেসেছিলেন মাটি আর মানুষকে। সেই জন্যইতো, দেশ বিভাগের পর পরই যখন সবাই নিজেদেরকে গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তখনই তিনি দেশ ভাগের মাত্র সাত মাস পরে ১৯৪৮ সালের ২৫শে মার্চে করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা’র দাবি করেন। সেই অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সাথে তাঁর অনেক বাদানুবাদ হয়। কিন্তু তিনি বলিষ্ঠভাবে যুক্তি দিয়ে তিনি সবাইকে জানিয়েছিলেন, গোটা পাকিস্তানের শতকরা ছাপান্ন ভাগ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষার প্রতি রাষ্ট্রের অবশ্যই যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে। বাংলার কৃষক, বাংলার মজুর, বাংলার সাধারণ মানুষদের কথা বলতে গিয়ে প্রতীতি দেবীর দেবতূল্য শ্বশুর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সে দিনই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কালো তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে কখনো ভুলতে পারেনি। তাঁরা মনে করতেন, এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’ই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে গণ পরিষদে বাংলা ভাষার কথা তুলে ধরে বাংলার মানুষকে জাগিয়ে দিয়েছেন, যার ফলশ্রæতিতে শুরু হয় বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অন্যান্য ধারাবাহিক সব আন্দোলন। ফলে ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তান আর্মি সাধারণ জনগণকে নির্বিচারে হত্যা শুরু করার পর ২৯শে মার্চ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র দিলীপ দত্তকে কুমিল্লার বাড়ী থেকে বেনোয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে ছ্যাড়াতে ছ্যাড়াতে তুলে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। তাঁদের তুলে নিয়ে যাবার আগে কুমিল্লার বাড়ীটাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে যায়। প্রায় দু’ সপ্তাহ অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে পাকিস্তান আর্মি হত্যা করে ৮৪ বছরের বৃদ্ধ বাংলার মাটির প্রাণজ সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ও তাঁর সন্তান দিলীপ দত্তকে।
ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দেবী সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে কন্যা আরোমা দত্ত আর রাহুল দত্তকে নিয়ে এপ্রিলের দুই তারিখে কোন রকমে প্রাণ নিয়ে সীমানা পাড়ি দিয়ে হাজির হন কলকাতায় নিজের পরবাসী ভাই বোনদের কাছে। কলকাতায় প্রতীতি দেবী উঠেছিলেন তাঁর বোনের বাসায়। খবর পেয়েই ঋত্বিক ছূটে এসেছিলেন। ট্যাক্সি থেকেই নেমেই বাড়ীর বাইরে থেকে ‘ভবি কোথায়, ভবি কোথায়’ বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢুকেই জড়িয়ে নিয়েছিলেন আদরের বোনকে যার সাথে ছিচল্লিশ বছর আগে জড়াজড়ি করে মাতৃজঠর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখেছিলেন। প্রায় এগার বছর পর দেখা হচ্ছে দুই ভাই বোনের। সেই ১৯৬০ সালে শেষ বারের মত প্রতীতি দেবী তাঁর স্বামী-সন্তানদের নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। তখন ঋত্বিক মদ স্পর্শ করতেন না। তখন তিনি টকটকে ফর্সা, হাসি খুশী একটা সুঠামদেহী মানুষ। দূর থেকে যাকে দেখতে তরোয়ালের মত লাগতো। তখন তাঁর নিজের গাড়ী ছিল, ভালো থাকার জায়গা ছিল। তখন কেবল ‘মেঘে ঢাকা তারা’ মুক্তি পেয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাত আটটা-নয়টার দিকে বন্ধু ওস্তাদ বাহাদুর খা’র সাথে সরোদ বাজাতে বাজাতে বিভোর হয়ে যেতেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র প্রিমিয়ার শো সবাই এক সাথে দেখেছিলেন। প্রতীতি দেবীর পাশেই ছিলেন অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী, অভিনেতা অনীল চ্যাটার্জী আর ঋত্বিক ঘটক। ছবির শেষ দৃশ্যে সেদিন হল এর সব দর্শক ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। প্রতীতি দেবীও কেঁদেছিলেন। দীর্ঘ এগার বছর পর ভাইকে পাশে পেয়ে আবার প্রতীতি দেবী কাঁদলেন।

বোনের মেয়ে আরমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন মামা ঋত্বিক ঘটক। তাঁর মনটা হালকা করার জন্য একদিন তাঁকে নিয়ে রওনা হলেন সাইথিয়াই যেখানে ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী লক্ষী ঘটক একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং সন্তানদের নিয়ে থাকেন। বীরভূম জেলার সাইথিয়াই ট্যাক্সিতে যেতে সময় লেগেছিল প্রায় তিন ঘন্টা। মামার চেহেরা দেখে আরোমার খটকা লেগেছিল। সে কোনভাবেই মিলাতে পারছিল না, তার মামার চেহেরাটা এমনভাবে ভেংগে গিয়েছে কেন। মামার থাকার কোন ভালো জায়গা নেই। বেশভূষায় একটা মলিনতা। এগার বছর আগের মামা আর এগার বছর পরের মামা একেবারেই আলাদা। আদর-স্নেহ সেই আগের মতই আছে, শুধু এখন দেখলে মনে, ঝড়ে বিধ্বস্ত এক ভাঙ্গাচুরা বৃক্ষ।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দেবীর শ্বশুর

সাইথিয়ায় আরোমা লক্ষ করলেন তার মামীর সাথে মামার সেই আগের সুন্দর সম্পর্কটা নেই। সাইথিয়া থেকে ট্যাক্সি করে এক সন্ধ্যায় অন্ধকার ফুঁড়ে কলকাতায় তারা ফিরছিলেন। হঠাত ঋত্বিক ট্যাক্সি ঘুরাতে বললো অন্য এক রাস্তায়। ট্যাক্সি এসে যেখানে থেমেছিল, সেটা ছিল কিছুটা নীরব আর ফাঁকা এক জায়গা। বলা যেতে পারে এক ধরনের গ্রাম। ট্যাক্সি থেকে নেমে তারা কিছুটা হেঁটে গিয়ে হাজির হয়েছিল এক কুঁড়ে ঘরের সামনে। মাটির কুঁড়ে ঘরটায় একটা হারিকেন জ্বলছিল। তারপর ঋত্বিক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাক দিয়েছিলেন, ‘ও রাম, ও রাম, দেখে যা আমি কাকে এনেছি। আমি আমার বাংলা মা কে এনেছি। দেখে যা।‘ ভিতর থেকে ডাক এসেছিল, ‘কে রে, ভবা?’ তারপর কুঁড়ে ঘরের ভিতর থেকে মাথা নিচু করে কালো ঢ্যাংগামত একজন হারিকেন হাতে বেরিয়ে এসেছিল। সেই রাতে দুজন তাঁদের বাংলা মা’কে পেয়ে অন্যরকম উছ্বসিত আর আনন্দে রাত পার করেছিলেন। তাঁদের দুজনের অনেক বেশি স্নেহ আর উৎসুকতায় কিছুটা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল আরোমা। সেই রাতে দুজনেই শিশু হয়ে গিয়েছিলেন। সকালের ঝলমলে আলোয় যখন সবার ঘুম ভেংগেছিল, তখন তাঁরা বেরিয়ে পড়েছিল কুঁড়ে ঘর থেকে একটু দূরে খোয়াই নদীর পাশে। দুজনের তখনো অন্যরকম এক আনন্দ আর জিজ্ঞাসু মন। তাঁরা একের পর এক আরোমাকে প্রশ্ন করে চলেছে বাংলার প্রকৃতি আর বাংলার মানুষ নিয়ে। আরোমার মনে তখন অন্য এক কষ্ট, তা এই বয়স্ক-শিশুরা একেবারে ভুলে গেছে। আরোমা বার বার ভাবছে আর কাঁদছে, তার দাদু আর কাকু কি বেঁচে আছে। ২৯শে মার্চে যখন আর্মীরা তাঁদের বেনোয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনো তাঁরা প্রাণে বেঁচেছিলেন। অনেকেই বলাবলি করেছে তাঁরা মারা গিয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত তারা তাঁদের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন নি। বরং নিজেদের প্রাণ আর আরমার মত যুবতী কন্যার সম্ভ্রম বাঁচাতে, তাঁদেরকে লুকিয়ে দেশের সীমানা পাড়ি দিতে হয়েছিল।

ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দেবী ও মনিস রফিক

সেই খোয়াই নদীর পাড়ের কুঁড়ে ঘরের সেই কালো ঢ্যাংগামত সরল মানুষটাকে সেখানেই রেখে তারা রওনা হয়েছিল কলকাতার দিকে। ততক্ষণে আরোমা জেনে গেছে, সেই ব্যক্তিটা ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রখ্যাত ভাস্কর রাম কিংকর বেইজ যাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্য রকম এক আস্থা ও গর্বে ভালবাসতেন।

ট্যাক্সিতে ফেরার পথে আরোমার বারবার মনে হচ্ছিলো, তার মামার মৃত্যু হয়েছে। যন্ত্রণা, ব্যাথায় কুঁকড়ে নিজেকে তছনছ করে ফেলেছে। এক সময় সে প্রশ্ন করে বসলো, ‘মামা, তোমার কি হয়েছে? তুমি ভ্যাগাবন্ড হলে কেন, তোমার ঘর নেই কেন?’ ঋত্বিক চাবুকের মত ভাগ্নির দিকে ঘুরে তাকিয়েছিলেন। আরোমা আবার বলে উঠেছিল, ‘তুমি উদ্বাস্তু হয়েছো কেন? আমরা না হয় একটা কারণে উদ্বাস্তু হয়েছি। কিন্তু তুমি কেন উদ্বাস্তু হলে? তোমারতো নিজের ঘর নেই, থাকার জায়গা নেই।‘ তারপর আবার এক নাগাড়ে মামা ভাগ্নির দিকে কয়েক মিনিট তাকিয়েছিলেন। একদম স্থিরভাবে, কিন্তু চোখে ছিল অন্যরকম এক আগুন। তারপর হঠাত চিৎকার করে ঋত্বিক কেঁদে উঠেছিলেন। একেবারে বাচ্চার মত কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘বুয়া (আরমা দত্তের ডাক নাম) আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা, বুয়া প্রচণ্ড যন্ত্রণা।’ বাইরে তখন ঘন অন্ধকার। গাড়ী তখন কলকাতার দিকে ছুটছে।

ঋত্বিক ঘটকের ভাগ্নি আরোমা দত্ত, বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য।

কাঁদতে কাঁদতেই সেদিন ঋত্বিক ঘটক তাঁর ভাগ্নিকে বলেছিল, ‘বুয়া, আই এয়ম এ বার্ন্ট পার্সোন। আমি শেষ হয়ে গেছি, আমি জানি না আমি কিভাবে শেষ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি শেষ হয়ে গেছি বুয়া। আমাকে দিয়ে আর কিছুই হবে না।‘ আরমা মামাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেছিল, ‘তোমার যখন এত যন্ত্রণা, আর তুমি যখন আমাকে বাংলা মা বলো, তাহলে, তুমি আমার কাছে আসলে না কেন? আমি তোমাকে দেখে রাখতাম’ এবার ঋত্বিক একেবারে মলিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আরো বেশি মলিনভাবে বলে উঠেছিলেন, ‘বুয়া, আমিতো ইচ্ছে করলেই তোর কাছে আর আমার আদরের ভবির কাছে ছুঁটে যেতে পারি না, আমার প্রিয় জন্মভূমি যে এখন আমার দেশ নয়। ওটা একটা অন্য দেশ। ওখানে যেতে এখন আমার পাসপোর্ট লাগবে। আমার প্রাণটাকে কেটে ভাগ করে ফেলা হয়েছে, বুয়া!’ (চলবে)