সাজ্জাদ আলী
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই কাকাবাবু পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে গেলেন। করাচী ইউনিভার্সিটি থেকে এমএ পাশ দিয়ে সেখানেই তিনি সরকারের হিসাব বিভাগে কর্ম করছিলেন। ৭১’এর মার্চ মাস আসতেই আব্বা তাঁকে জরুরি টেলিগ্রাম বার্তা পাঠালেন, “চাকরি ছেড়ে অবিলম্বে বাড়ি চলে আয়”। কিন্তু না তিনি এলেন না, রয়ে গেলেন করাচীতে। অভিভাবকদের আদেশ/নির্দেশের বিপরীতে অবস্থান নিতে পারলে তাঁর “স্বাধীন চেতা প্রবৃত্তি (!)” বরাবরই তৃপ্ত হয়। কিন্তু এই “স্বাধীন চেতনা” যে মাঝেমধ্যে পুরো পরিবারকে পরাধীন করে তোলে, তা নিয়ে তাঁর বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই। আব্বাও এ ক্ষেত্রে একপেশে! অন্য কাকারা বা পরিবারের আর সবার জন্য শাসনদন্ড শক্ত হলেও এই কাকাবাবুটির ক্ষেত্রে আব্বা বড়ই ঢিলেঢালা। গদগদ স্নেহে বলবেন, আমার সেজ ভাইটিকে নিয়ে কেউ কিছু বলবে না তো, ও একটু মাথা পাগলা!
অবশ্য এই স্নেহাধিক্যের সঙ্গত কারণও ছিলো। সেই ষাটের দশকে গ্রাম্য সমাজরীতিতে পারিবারিক প্রতিপত্তি বজায় রাখতে অর্থ, শক্তি ও শিক্ষার সমন্বিত প্রয়োজন ছিলো। উত্তরাধিকার সূত্রে আব্বা প্রথম দুটি পেয়েছিলেন। তৃতীয়টি অর্থাৎ “শিক্ষা”, তাঁর ভাইদের দিয়ে অর্জন করানোটা ছিলো আব্বার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মিশন। কাকাদের মধ্যে তাঁর সে মিশন দ্রুত বাস্তবায়ন করছিলেন কাকাবাবু। তরতর করে আইএ, বিএ, এমএ পাশ দিয়ে আব্বার স্বপ্ন সফল করেছিলেন তিনি। সেই আমলে গাঁয়ের কোন ছেলে এমএ পাশ করাটা ছিলো বিরল ঘটনা। দূরদূরান্ত থেকে এই এমএ পাশকারীকে লোকে এক নজর দেখতে আসতো। ভাইয়েরা শিক্ষিত, লাঠি আছে, অর্থকড়ির ঘাটতি নেই, ডাঙ্গায় যথেষ্ট জোতজমি; আব্বার সামাজিক প্রতিদ্বন্দিরা সব সময়েই তাঁর থেকে ক’কদম পিছিয়ে থাকতো। অন্ধ স্নেহটা কাকাবাবু বোধকরি সে কারণেই পেতেন।
সেই সাড়ে বারো কি তের বছর বয়সে আম্মা দাদীর সম্পন্ন গৃহস্তে বড় বউ হয়ে এলেন। পিতৃহীন আমার অবিবাহিত ফুফু-কাকারা একজন সমবয়স্ক ও বন্ধুভাবাপন্ন অভিভাবক পেলেন। সেই থেকে তাঁদের যা কিছু বায়না, তা মিটানোর দায় আম্মারই। কাকাবাবু আর আম্মা সমবয়সী। শৈশব থেকেই কাকা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং আধুনিকমনস্ক। জীবনে বড় হওয়ার উচ্চাশা তাঁর আশৈশব। গাঁয়ে থেকেও শহুরে কায়দায় তাঁর চলন-বলন। ছাত্র বিশেষ ভাল না, তবে পড়–য়া। রাত জেগে উচ্চস্বরে বিদ্যা মুখস্ত করতেন তিনি। আর পরীক্ষার খাতায় মুখস্ত সে বিদ্যা কার্যকরিভাবে লিখে আসবার সক্ষমতা ছিলো তাঁর।
ছেলে যাতে পরীক্ষায় পাশ দেয়, দাদীর সেদিকে সজাগ দৃষ্টি। ভাল রেজাল্টের দরকার নাই, পাশ দিলেই তিনি খুশি। পুস্টিকর সব খাদ্য ছেলের চার পাশে জড় করে রাখেন, যাতে খেয়েদেয়ে তার ঘিলু বাড়ে। আম্মাকে তিনি স্থায়ী দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন, তাঁর পড়–য়া ছেলের দেখভাল করার জন্য। দাদীর বাঁধা গোয়ালা কাম ডিমওয়ালা সতীশ দাদু প্রতিদিন সকালে টাটকা মাখন, দুধ আর ডিম বাড়িতে দিয়ে যায়। আম্মা কাকাবাবুর পড়ার টেবিলের কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে; ডিম কি পোজ করে খাবে, নাকি ভাঁজা খাবে তাই জানতে। কিন্তু পড়–য়ার ফুসরত নেই! চোখ বন্ধ করে মাথা ঝেকে ঝেকে পড়া মুখস্ত করছে, “বাবর, হুমাউন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, এরা সবাই মুগল সম্রাট ছিলেন” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আব্বা গঞ্জমুখী হলেই আম্মা তাঁর হাতে ফর্দ ধরিয়ে দিতেন। তালিকার অর্ধেক আইটেমই কাকাবাবুর জন্য। এই যেমন, ফাউন্টেইন পেন, জাপানি টেট্রনের প্যান্ট, প্যালিক্যান কালি, বাঁধানো হায়দার খাতা, তিব্বত পাউডার, দাঁড়ি কামানোর লোশন, বিদেশী লাক্স সাবান, পেছনে বকলেস দেওয়া চামড়ার স্যান্ডেল, হাঁড়ের তৈরি পকেট চিরুনী, টি-শার্ট, ইত্যাদি সব ফরমায়েস কাকাবাবুর জন্য। তালিকাবদ্ধ এসব সামগ্রী যে কাকাবাবুর প্রবল চাহিদা, তা নয়। বন্ধুত্বের নিদর্শণস্বরূপ আম্মাাই কাকাবাবুর হয়ে আব্বার কাছে আগবাড়িয়ে এসব আব্দার লিখে দিতেন। এক কথায় বলতে গেলে কাকা-ফুফুদের মধ্যে কাকাবাবু ছিলেন বিশেষ সুবিধাভোগি। অনেকটা নিজ বাড়িতেই জামাই আদরে বড় হয়ে উঠেছেন তিনি।
তো বলছিলাম যে, পাঞ্জাবীদের সাথে যুদ্ধাবস্থা তৈরী হওয়ার পরেও কাকাবাবু করাচী ছেড়ে বাড়ি ফিরতে সম্মত হলেন না। আব্বার টেলিগ্রামটি যে দাদীরই ইচ্ছা ও আদেশ, তাতো তাঁর অজানা নয়। তাঁর এই করাচী আটকে পড়াটা পরিবারের জন্য মস্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠলো। কাকাবাবুর সর্বশেষ তারবার্তা বাড়িতে এসে পৌঁছেছিলো একাত্তরের ২৩ শে মার্চ। লিখেছিলেন, “শ্রদ্ধেয় ভাইজান, চাকরী ছাড়তে মন সায় দিচ্ছে না, আমি এখনই বাড়ি আসছি না। মাকে দোয়া করতে বলবেন”। এর ঠিক ৩ দিন পরেই যুদ্ধ বেঁধে গেল। দাদীর চার ছেলেই তাঁর চোখের সামনে, শুধু সেজটা আটকা পড়লো পাকিস্তানে। আমার লৌহমানবী দাদী পুত্র শোকে ভেঙ্গে পড়লেন। প্রত্যেকদিন দুপুরের পর থেকেই বাড়ির প্রবেশ পথে শতবর্ষি রেন্ট্রি গাছের নিচে মোড়া পেতে ছেলের পথ চেয়ে বসে থাকেন। আর চোখের জলে বুক ভাসান। জীবনের প্রতিটি সংকটে বিজয়ীনি আমার দাদী। কোন কিছুতে তিনি ভেঙ্গে পড়তে পারেন, এটা সকলের কাছেই এতদিন অবিশ্বাস্য ছিলো।
এদিকে যুদ্ধের ডামাডোল আমাদের অজপাড়াগাঁয়েও আছড়ে পড়লো। আমার ফুফুরা সবাই শহর থেকে দাদীর বাড়িতে চলে এলেন। নিকট সম্পর্কের কয়েক ঘর আত্মীয়রাও নিরাপদ বিবেচনায় আমাদের বাড়িতে এসে উঠলেন। অথচ সত্য হলো, দশ গাঁয়ের মধ্যে আমাদের বাড়িটিই সব থেকে অনিরাপদ। আব্বা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক, আর শেখের ব্যাটার সোনার বাংলা স্বাধীন করার জন্য দাদীর ধানের গোলা সব সময়ই খোলা। এসব খবর পাঞ্জাবীদের কানে তুলবার লোকের তো সে সময় অভাব ছিলোনা। সব সময় আমরা শঙ্কায় থাকতাম, কখন মিলিটারীরা বাড়িটি আক্রমন করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়!
১৯৭১ কে যুদ্ধের বছরের পাশাপাশি গুজবের বছরও বলা যায়। বিশেষ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অজ পাড়াগাঁয়ে প্রতিদিন সে সব গুজব যেন বোমাসম বিস্ফোরিত হতো। কত্ত কিছিমের যে গুজব! আল্লাহ মাবুদ, রহম করো! যুদ্ধের জয়-পরাজয় নিয়ে গুজব, কার ছেলে পালাইয়া ভারত গ্যাছে, রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখাইলো কে, কবে কোথায় মিলিটারিরা হানা দেবে, ক’টা বেওয়ারিশ লাশ নদীর চরে আটকা পড়ছে, ইত্যাদি সব উড়ো খবর নিত্য বাতাসে ভাসতো। লোকে কোনটা বিশ্বাস করবে বা করবে না? সমাজ জীবনে তখন এই “গুজব” ছিলো এক মহা সংকট! ও দিকে গাঁয়ের লোকেরা কাকাবাবুর বেঁচে থাকা নিয়ে নানান কথা ছড়াচ্ছে! ওদের বিশ্বাস ছফেদ আর নাই, তারে পাঞ্জাবীরা মাইরা ফালাইছে। এতদিনে পাকিস্তানে তার লাশ মাউটাইয়া গেছে! দাদীআম্মা খালিখালি তাঁর জন্যি দোয়া-খতম পড়াইতেছে। দশমুখ ঘুরে সে সব কথা আমাদের কানেও আসে।
পথপানে চেয়ে ছেলের প্রতীক্ষায় দাদী গাছ তলায় বসে থাকেন! কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছেন তিনি। কথায় কথায় আর হুঙ্কার ছাড়েন না, সংসারে মন নেই। দূরপথে ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা কাউকে হেঁটে আসতে দেখলে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। চাকরবাকরদের ডেকে তটস্থ করে তোলেন। বলেন, ওই যে মনে হয় আমার ছফেদ আইসত্যাছে, দৌঁড়াইয়া যা তোরা আগাইয়া আন তারে। হাট বাজার বা গঞ্জ থেকে কেউ এলেই জিজ্ঞাসা করবেন, আমার ছফেদের কোন খবর পাইলা? দুনিয়াশুধ্যু সবার উপরে নাখোশ দাদী, কেউ নাকি তার ছাওয়ালরে ফিরাইয়া আনার কথা ভাবে না।
দুএক দিন পরপরই তিনি গোমস্তাদের কাউকে মাঝিগাতি পোষ্ট অফিসে এবং রামদিয়া টেলিগ্রাম আফিসে খবর আনতে পাঠান। কিন্তু গত ক’মাস ধরেই ওরা খবরহীন বাড়ি ফিরে আসছে। ইদানিং তিনি দাদী চাকরবাকরদের উপরেও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন। তাঁর ধারণা ওই অকম্মাগুলা ডাক অফিসে না গিয়াই বাড়ি ফিরে আসতেছে। একদিন আব্বাকে ডেকে দাদী বললেন, ডাক পিয়নরা আসে না ক্যা? ছোফেদের চিঠিপত্তর আইলো কিনা, তুই খবর নে তো। ও মা অবুজ হইয়ো না, আব্বা দাদীকে সান্তনা দেন! যুদ্ধের জন্যি ডাক যোগাযোগ বন্ধ, চিঠি যাওয়াআসা নাই কইলেই চলে। তোমার চিঠি আসলে পিয়নরা সাথে সাথেই পৌঁছাইয়া দিবি। এ জবাবে তুষ্ট না দাদী! বললেন, তুই পিয়নগো তলব কর, আইজ বেলা ডোবার আগে আমার সাথে যেন আইস্যা দেখা করে! আমি নিজ কানে শুনতি চাই। আব্বা মিনমিনে গলায় বললেন, আচ্ছা মা ওগো হাজির করতেছি।
ক’দিন হলো দাদীর মাথায় নতুন চিন্তা ঢুকেছে। আম্মা আর মেজকাকীর কাছে তাঁর মনের কথা বলেছেনও। শেষমেশ একদিন আব্বাকে ডেকে বললেন, তুই পাকিস্তানে লোক পাঠাইয়া আমার ছোফেদরে বাড়ি আনার ব্যবস্থা কর। আহারে অবুঝ মা! দাদীকে বুকে জড়িয়ে আব্বা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মা পাকিস্তানতো এখন যাওয়া যায় না, কোন পথ নাই। উপায় থাকলে তোমার কি আমারে এ কথা কইতে হইতো? তুমি দোয়া পড়ো, মিলাদ দাও, কোরান খতম করাও, জানের বদলে জান ছদকা দাও, আল্লাহ ওরে ফিরাইয়া আনবিই। কি কইস তুই? পাকিস্তান যাওয়া যায় না মানে ডা কি? তোর না কত ক্ষ্যামতা! তুই চাইলে কি না পারিস বাবা? হায়রে মায়ের মন! আব্বা আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না! দাদীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। মা-ছেলের সে কান্নায় ডালে বসা পক্ষীরাও শোকে ডানা ঝাপটায়!
কাকাবাবু আমাদের হিরো! কি না করেছেন তিনি আমাদের জন্য? শহর থেকে বল খেলার জার্সি কিনে এনেছেন, বিদেশি চকলেট, দস্যু বনহুরের বই ইত্যাদি আরো কত কি সব এনে দিয়েছেন। শনিগ্রহের বলয়ের গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। শিখিয়েছেন গাঁয়ের কথ্য ভাষার বদলে প্রমিত বাংলা বলা। সঠিক উচ্চারণে আধুনিক কবিতার আবৃত্তি তাঁর কন্ঠেই প্রথম শুনেছি। আমাদের প্রথম দেখা টাই-স্যুট পরা মানুষ তিনিই। তাঁর চলবার ঢং, বলবার ধরণ, মুখের হাসি, চুলের স্টাইল, ব্যক্তিত্ব, সবই আমাদের মনকাড়া। সুবেশি, সুদর্শন, দীর্ঘাঙ্গি এক সুপুরুষ তিনি। বড় হয়ে আমরা সবাই একেকজন “কাকাবাবু” হবো, এই আমাদের ভাইবোনদের পণ। আমাদের গেঁয়ো জীবনে আধুনিকতার আলো জ্বালিয়েছেন যে মানুষটি, তাঁর মন্দ কিছু হতেই পারে না! আজ না হয় কাল, তিনি ফিরবেনই আমাদের মাঝে। দাদীর সাথে বসে তাঁর জন্য দোয়া পড়ি। মিলাদে বসে জিকির করি, ছিপারা খতম দেই।
যুদ্ধের বছরে স্কুল নেই, লেখাপড়ার বালাই নেই; শুধু খেলা আর খেলা। তবুও আমাদের মনে এতটুকু সুখ নেই। কোন একদিন হয়তো গোল্লাছুট খেলতে যেয়ে ঝেড়ে দৌঁড় দিয়েছি, বা হাডুডু খেলায় মাত্রই বুক ভরে দম নিয়েছি, অথবা ছি-বুড়ি খেলার ‘বুড়ি’ হয়েছি; এমনই কোন চরমানন্দের মুহুর্তে হয়তো মনে পড়লো কাকাবাবুর কথা! সাথে সাথেই মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। খেলা ছেড়ে ধপাস করে বসে পড়লাম উঠোনে। দিনভর যা কিছুই করি না কেন, মন জুড়ে করে থাকেন তিনি। আমরা চাচাতোফুফাতোরা এখন আর কেউ দুধের সর, শোল মাছের মাথা, চিড়া ভাজা, ডাবের সর, বরই’র আচার বা চাক ভাঙ্গা মধু, খেতে পারি না! ওগুলো কাকাবাবু খুব ভাল খেতেন। আজ তিনি কোথায় কি খাচ্ছেন জানিনা! তাঁকে রেখে আমরা কেমনে তাঁর প্রিয় খাবারগুলো মুখে তুলি?
বাড়ির উত্তর পাশে দাদীর আমবাগান। সে ভিটায় তখন ২৭ টা আমগাছ ছিলো। বেশ কয়েকটা গাছেরই বিশেষ নাম আছে। বুড়োমা’র গাছ, গোল্লা আমের গাছ, চুপা আমের গাছ, কুটিমামার গাছ, ঝাপটানো গাছ, ইত্যাদি বিচিত্র সব নাম। আহাদ দাদাভাই এ সব নামকরণের হোতা। সব থেকে সুস্বাদু কাঁচামিঠা আম গাছটির নাম “কাকাবাবুর গাছ”। কি কারণে যেন আমরা ছোটরা বিশ্বাস করতাম যে, কাকাবাবুর মন্দকিছু হলে ওই গাছও মরে যাবে। প্রতিদিন সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা দৌঁড়ে গিয়ে বাড়ির উত্তর পাশে দাঁড়ায়ে গাছটিকে দেখে আসি। কখনও বা ভিটায় গিয়ে “কাকাবাবুর গাছটি” ছুঁয়ে দেখি। গাছতো ঠিকই আছে! ডালের ডগায় নতুন পাতা গজাচ্ছে, শাখা প্রশাখাগুলো বাতাসে আনন্দ-দোলা খাচ্ছে! গাছের গোড়ার দিকের পুরোনো বাকল খসে পড়ে নতুন বাকল উঁকি দিচ্ছে। একদিনতো যেন মনে হলো গাছটি আমাকে একা পেয়ে বলে উঠলো, তোরা এত ভাবছিস কেন? আমি তাড়াতাড়ি ফিরছি তো! সে কথা শুনে এক মনে ভাবি, ধুরু গাছ আবার কথা কয় নাকি? আরেক মন বলে, তুই ঠিকই শুনেছিস!
এমনি দুঃসহ এক পরিস্থিতির মধ্যে কাটছিলো আমাদের পরিবারের সেই দুর্বিষহ ৭১’ বছরটি! সে দিনের তারিখটি সঠিক মনে করতে পারছি না। তবে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ হবে। সন্ধ্যা উৎরে যাবার পরের সময়টিতে ভিতর বাড়ির উঠোনে আমরা চাচাতো ফুফাতো ভাইবোনেরা মাদুর পেতে হারিকেনের আলোয় খেলাধুলায় মত্ত। নীলু আপার নেতৃত্বে এক পাশে চলছে সাপলুডু খেলা, আরেক দিকে বদরভাইয়ের তত্বাবধানে পাঁচগুটির চাল। মেঝকাকী রাতের খাবারের তদারকীতে খাবারঘর-রান্নাঘরে দৌঁড়ঝাপ করছেন। আম্মা বোধহয় অভ্যাস মতো পুবের ঘরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছেন। আর উঠোনের এক কোনে বসে দাদী কুপির আলোতে হামানদিস্তায় পান ছেঁচছেন। কাকারা দক্ষিণ ঘরে ফুফাদের নিয়ে তাস পেটাচ্ছেন। চারকবাকরেরা সবাই স্বীয় কর্তব্যে ব্যস্ত।
হঠাৎ সন্ধ্যার আঁধার ভেদ করে কাকাবাবুর উচ্চকন্ঠ অনুরণিত হলো! ও মা আমি আইছি! বিদ্যুত চমকের দ্রুততায় আমরা চোখ ফেরালাম ভেতরবাড়ির প্রবেশ পথের বেকি বেড়ার দিকে। তড়িৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন দাদী, সাথে আমরাও! একেবারে এটেনশন পজিশনে সবাই! সেকেন্ডের মধ্যে চার পোতার চার ঘর থেকে পরিবারের সকলে উঠোনে এসে জড়ো হলো। এ যে অবিশ্বাস্য! আনন্দ-বিস্ময়ে দাদী থরথর করে কাঁপছেন! আমরা হারিক্যনের আলো আঁধারিতে দীর্ঘাঙ্গি মানুষটার মুখাবয়ব বোঝার চেষ্টা করছি। ভাইয়ের কন্ঠ শুনে আব্বা কাচারী ঘর থেকে তাঁর লোকজনসমেত ভিতরবাড়ি ছুটে এসেছেন। দ্রুত পায়ে এগিয়ে কাকাবাবু হাঁটুগেড়ে বসে কম্পমান দাদীকে জড়িয়ে ধরলেন! আর আমরা জনপনেরো ভাইবোন হুড়মুড় করে চারদিক থেকে জাপটে ধরলাম কাকাবাবুকে। সে কি আনন্দকান্না আমাদের! পরিবারের অনেক আনন্দক্ষণ আমি দেখেছি, কিন্তু সেদিনেরটি অতুলন!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)