ফরিদ আহমেদ : ১৯৫২ সালে পিকিং এ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ওই শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন উদীয়মান এবং প্রতিশ্রুতিশীল রাজনৈতিক নেতা। বয়স মাত্র বত্রিশ বছর। সদ্যই জেলে থেকে বের হয়েছেন ভাষা আন্দোলনে অংশ নেবার অপরাধে। তাঁর সাথে সেই সফরে ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানও ছিলেন। এঁরা ছাড়াও আরো কিছু লোক গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে।
চীন সফরের অভিজ্ঞতাকে খাতায় লিখে রেখে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। ১৯৫৪ সালে তিনি আবারও জেলে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে জেলে বসেই দুই বছর আগের চীন ভ্রমণের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন তিনি। এর শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন ‘নয়াচীন’। তাঁর সেই লিখিত খাতা এখন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নামে বই আকারে বের হয়েছে।
চীনে তখন সদ্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজাচ্ছে নতুন আদর্শের সরকার। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইতে সেইসব কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুই তিনি তুলে এনেছেনে এই বইতে তাঁর চোখে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে।। এই বইয়ের এক জায়গায় চীনের এক শ্রমিকের বাড়িতে যাবার বিবরণ আছে। সেই আপনাদে শোনাই আজ।
সাংহাইতে একটা কাপড়ের কল দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা। বিপ্লবের পরে চীনের শিল্পব্যবস্থায় মালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছ, এর লভ্যাংশ কীভাবে বণ্টিত হয়, শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য মালিক পক্ষ কী কী কাজ করে, সেটা মালিক পক্ষ এবং ট্রেড ইউনিয়নের লোকেরা অতিথিদের ব্যাখ্যা করে বলছিলো তাঁদের।
শ্রমিকদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করা আছে। অবিবাহিত পুরুষ শ্রমিকরা থাকে এক কলোনিতে, অবিবাহিত নারী শ্রমিকরা ভিন্ন কলোনিতে। আবার কেউ বিয়ে করলে তার বাসস্থান করা হয় ভিন্ন কলোনিতে। শ্রমিকদের জন্য আলাদা বাজার আছে, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল আছে। যে সমস্ত নারী শ্রমিকের বাচ্চা আছে, কাজে যাবার আগে তাদের বাচ্চাদের দেখভালের সুবন্দোবস্ত আছে, বাচ্চাদের জন্য স্কুল আছে।
বিকালের দিকে তাঁরা বের হয়েছিলেন শ্রমিকদের কলোনি দেখার জন্য। বঙ্গবন্ধুর মনে হঠাৎ করেই ভাবনা জাগলো যে এদের বাসস্থান দেখলে কেমন হয়। আগে থেকে বলে রাখলে হয়তো সাজানো-গোছানো কোনো ঘর দেখাবে, তাই সেই প্রস্তুতি তিনি তাদের দিতে রাজি হলেন না। এক বাড়ির সামনে গিয়ে হুট করে দোভাষীকে বললেন যে তিনি এই বাড়িটার ভিতর দেখতে চান।
দোভাষী এই আবদারে কিছুটা চমকে গেলেও নিরাশ করলো না। বললো যে, ‘আমি ভিতরে গিয়ে খবর দিয়ে আসি। খবর না দিয়ে আরেকজনের বাড়িতে কী করে ঢুকি বলেন?’
দোভাষী কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো। তাদেরকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে গেলো। ভিতরে যাবার সময়ে বললো, এ বাড়ির স্বামী স্ত্রী দু’জনেই শ্রমিক। এদের মাত্র তিন চারদিন আগে বিয়ে হয়েছে। তবে, স্বামীটি বাড়িতে নেই কারখানায় কাজ করতে গেছে।
তাঁরা বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই স্ত্রীটি তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাড়ি। সবার বসার জন্য চেয়ার ছিলো না। একটা চেয়ার কম ছিলো। ভদ্রমহিলা একটা মোড়া এনে দিলেন। চেয়ার কম থাকলেও, অন্যান্য আসবাবপত্র বেশ ভালোই আছে দেখলেন তারা। পূর্ব পাকিস্তানের শ্রমিকদের তুলনায় তারা যে বেশ ভালো আছেন সেটা সহজেই বোঝা যায়।
হুট করে তারা এসেছেন বলে তিনি লজ্জিত এবং বিব্রত। কারণ, ঘরে অতিথি এসেছে। কিন্তু, তাদেরকে দেবার মতো কোনো খাবার নেই। স্বামীও বাড়ীতে নেই যে তাকে বাজারে পাঠাবে। কাজেই তিনি ঘরে থাকা চিং চা বানিয়ে সবাইকে দিলেন। এই চা প্রতিটা চীনার বাড়িতেই থাকে।
ভদ্রমহিলা অতিথি আপ্যায়ন ঠিকমতো না করতে পেরে যেমন লজ্জিত হচ্ছিলেন, একই ধরনের লজ্জার মধ্যে দিয়ে তখন বঙ্গবন্ধুও যাচ্ছিলেন। এই মেয়েটার সদ্য বিয়ে হয়েছে। সেই বাড়িতে তারা এসেছেন। তাকে কিছু একটা উপহার দেওয়া উচিত। অথচ তাঁদের কাছেও কিছু নেই মেয়েটাকে দেবার জন্য। এর পরের অংশ আমি তাঁর লেখা থেকেই তুলে দিচ্ছি শুধু এটা বোঝাতে যে একজন মানুষ এমনি এমনি মহান হয় না, তাঁর ভিতরের মহান হবার গুণ থাকা লাগে। তাঁর লেখা অংশটুকু পড়লে, আপনারাও সেটা বুঝতে পারবেন।
“আমরা এক মুশকিলে পড়ে গেলাম। বিবাহ বাড়িতে গিয়েছি, কিছু উপহার না দিয়ে কী করে ফিরে আসি। আমাদের এত যতœ করেছে চীনের জনসাধারণ, খাওয়া-দাওয়া থাকা যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছে আমাদের। ইলিয়াসকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কাছে কিছু আছে? বললো, না। ফজলুল হককে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কাছে কিছু? বললো, না। একটু সুবিধা ছিল বাংলা ও উর্দুতে কথা বললে বোঝার উপায় নাই। আমি ভাবছিলাম, হঠাৎ আমার হাতের দিকে খেয়াল পড়লো – দেখি আমার তো একটা আংটি আছে। আমি খুলে সেই শ্রমিকের স্ত্রীকে উপহার দিলাম। দোভাষীকে বললাম, পরাইয়া দিতে। কিছুতেই গ্রহণ করতে চায় না, তারপর নিলো। আমরা ফিরে এলাম।”