সেরীন ফেরদৌস : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, যুদ্ধও প্রায় শেষের দিকে, ১৯৪৪ সাল। আমেরিকান সৈন্যরা দখল করে নিয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ পিয়ানোসা। সেখান থেকে বম্বিং অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে ইতালিতে আর অন্যান্য দেশে, আকাশে-মাটিতে। এইফাঁকে গড়ে উঠেছে ছোট থেকে বড় বিজনেস, অস্ত্র-খাবার- নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ইত্যাদির লেনদেন। সৈন্যদের নিয়মিত সেক্স সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় ব্রথেল। যুদ্ধ একটি অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কিন্তু তারপরও দেখা যায় যে, পুঁজিবাদের কোনো দেশ নেই! আমেরিকান সৈন্যদের মেস অফিসার মাইলো, যে কিনা খাবারের ব্যবসা শুরুই করেছিলো সেদ্ধ ডিম বিক্রি দিয়ে, অচিরেই হয়ে ওঠে ঝানু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী আর আন্ডারগ্রাউন্ড চোরা কারবারী! মাইলোর চোখে শত্রুদেশ মিত্রদেশ বলে কিছু নাই। আমেরিকা যেমন, তেমন শত্রুদেশ জার্মানীও তার ব্যবসাক্ষেত্র! মাত্র ১৯ বছরের নিষ্পাপ আমেরিকান সৈন্য উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে যুদ্ধে। নেটলি পরিষ্কার করে বুঝতে পারে না এই যুদ্ধ কি, কেন। কার উদ্দেশ্যে সে এই ছোট্ট জীবনটি বাজি ধরেছে। সে শুধু জানে, দেশের জন্য আত্মত্যাগ মহান, এর নাম দেশপ্রেম! সে বীরের মতো প্রাণ দেবে! সে জানে, আমেরিকা পৃথিবীর সেরা দেশ, আমেরিকান সৈন্য সেরা, আমেরিকার মূল্যবোধ সেরা, যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আমেরিকা পৃথিবী রক্ষার কাজ করে চলেছে। সে বুঝতে পারে না সমস্ত প্রটোকল অমান্য করে কর্ণেল ক্যাথকার্ট কেনো মিশনের সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে! সে আরো অনেক সহকর্মীর মতোই বুঝতে পারে না যুদ্ধের ময়দানে তারা একটি সংখ্যামাত্র! যুদ্ধের এক পরযায়ে নেটলি মারা যায় এবং মারা যায় দলের অন্যান্য সহযোদ্ধারা, শুধুমাত্র দুইজন বাদে। তরুণ যোদ্ধা ইয়ুসারেইন, বম্বার, একের পর এক সফল মিশন শেষ করে ত্যক্ত ও বিরক্ত হতে হতে একসময় যুদ্ধ-রাজনীতির কুটকৌশলটা ধরে ফেলে। বুঝতে পারে এই যুদ্ধ র্অথহীন, এই গর্ব মিথ্যা, এই ত্যাগের আরেক নাম ক্ষয়। সে কাছে থেকে দেখতে পেয়েছে কিভাবে যুদ্ধকে ব্যবহার করছে ধূর্ত ব্যবসায়ী মাইলো, কার স্বার্থে কর্ণেল ক্যাথর্কাট ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিশনসংখ্যা বাড়িয়ে চলছে, কিভাবে ব্যুরোক্রেসী এবং আর্মি চেইন অব কমাণ্ডের নামে স্বেচ্ছাচারিতা করছে। একের পর এক অনেকগুলো অপারেশন সাকসেসফুললি শেষ করার পর যখন তার বোধোদয় ঘটে, সে তখন অসুস্থতার অজুহাতে চলে আসতে চায় যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে। কিন্তু পারে না, কারণ তাকে আসতে বাধা দেয়া হয়। কিন্তু ইয়ুসারেইনের কাছে ততক্ষণে মৃত্যু এবং জীবন একই মুদ্রার এপিঠওপিঠ মাত্র। মানুষের মহত্ব, মহান জীবনের শ্লোগান তার কাছে ব্যাঙ্গাত্মক লাগে। বোমার আঘাতে অচেনা কিশোর শত্রুটির শরীর থেকে সমস্ত নাড়িভুড়িসহ অর্গানগুলো বেরিয়ে এলে ইয়ুসেরেইন বুঝে যেতে থাকে মানুষও নিছক একটি জৈবিক প্রাণ ছাড়া আর কিছু না!
কথা হচ্ছিলো আমেরিকান ঔপন্যাসিক জোসেফ হিলারের উপন্যাস “ক্যাচ-২২” নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এ উপন্যাসে যুদ্ধের বাজারচলতি ধারণা “হিরোইজম”কে পাশ কাটিয়ে সামনে আনা হয়েছে যুদ্ধের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তির মনস্তাত্তি¡ক বিস্তারকে। ঠাট্টার ভাষায় যুদ্ধের মতো একটা সিরিয়াস ব্যাপারকে বিস্তৃত একটা প্রেক্ষাপটে ধরতে গিয়ে লেখক ভাষা নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষানীরিক্ষা করেছেন। যে কোনো যুদ্ধকেই গ্লোরিফাই করা হয়ে থাকে দেশপ্রেম, মুক্তি, বিজয়, জাতীয়তা, শ্রেষ্ঠত্ব ইত্যাদি নানান নাম দিয়ে যা বলির পাঁঠার মতো সাধারন মানুষগুলোর উপর চেতনানাশক আফিমের মত কাজ করে এবং এটাই চায় ক্ষমতাসীনেরা। ক্ষমতাসীনের স্বার্থ আর সাধারন মানুষের স্বার্থ কখনোই এক রাস্তায় থাকেনা। এবং প্রায়শই এ তীক্ত কথাগুলোও বলার বা লেখার উপায় থাকে না। জোসেফ হিলার তাই ঠাট্টা এবং কিছুটা অ্যাবসার্ডিটিকে অবলম্বন করে যুদ্ধের কঠোর গল্পটি বলতে চাইলেন।
উপন্যাসের ভাষা কৌতুকময়তা ও রঙ্গ দিয়ে ঠাসা হলেও সবকিছু ছাপিয়ে যুদ্ধের নির্মম ও সিরিয়াস চেহারাটি দগদগে হয়ে ফুটে উঠেছে। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত ঢাউস আকারের এ উপন্যাসটি সরাসরি আমেরিকান ব্যুরোক্রেসী, আর্মি চেইন অব কমান্ড ও ক্যাপিটালিজমকে চ্যালেঞ্জ করে। লেখক ভাষাকে টুইস্ট করে যুদ্ধ ও আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের ভূমিকাকে সরাসরি উপহাস করেছেন এ উপন্যাসে। মাতবর ও গোঁয়ার দেশ হিসেবে আমেরিকা “গণতন্ত্র” এবং “জিতে যাওয়া” বলতে যা বুঝে থাকে সেটাকে তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন উপন্যাসের নানা চরিত্রের ভেতরের কমেডি এবং প্রশ্ন দিয়ে। চরিত্রের ব্যাঙ্গাত্মক, অর্থহীন ও পরষ্পর সঙ্গতিবিহীন কথাবার্তার ভেতর দিয়ে যুদ্ধের অসাড়তার দিকটিরও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, উপন্যাসের প্রায় প্রতিটি চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত হয় এবং তাদের অনেকেই যুদ্ধের মাঠ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ফসল ঘরে তুলে নিচ্ছে যুদ্ধকে একটা অপরচুনিটি হিসেবে ব্যবহার করে। যুদ্ধের নিয়ম, নীতি-নৈতিকতা কিছুই আর কাজ করছে না সেখানে। বরং তা হিপোক্রেসী আর ভণ্ডামিতে ঠাসা। বাকি পড়ে থাকে ব্যক্তিমানুষের প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ, যাপন আর সুখ-দু:খ।
ব্যক্তি মানুষের মনস্তত্ত¡ যুদ্ধকে আলিঙ্গন করে কেমন অস্বাভাবিক বা অতিস্বাভাবিক হয়ে ওঠে তার বর্ণনায় লেখকের মুন্সিয়ানা রয়েছে। দেশপ্রম নাম দিয়ে যুদ্ধের মতো ভয়াবহ একটি ঘটনাকে রোমান্টিসাইজ করা, বহাল রাখার বাটপারিকে চ্যালেঞ্জ করে এই উপন্যাস। বলা যায়, যুদ্ধের মাল্টি-পার্সপেক্টিভ চেহারাটি বিচিত্র রূপে ধরা পরেছে এই উপন্যাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপরে লেখা এ উপন্যাসটি গত শতকের অন্যতম সেনসিটিভ ও শক্তিশালী উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত। উল্লেখ্য, লেখক নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন আমেরিকান যোদ্ধা ছিলেন।
টরন্টোর বেøার কলেজিয়েট স্কুলের ১২ গ্রেডের এবছরের চলতি সেমিস্টারের পাঠ্য বই ’ক্যাচ-২২’। উঁহু, উপন্যাসটি আমি নিজে সরাসরি পড়িনি, পড়েছে আমার বড় মেয়ে র্বণমালা। তবে তার তরফ থেকে পড়াকালীন নিয়মিত আপডেট, গল্প শোনা আর বিশ্লেষণ মোটামুটি বেশ ভালোই ধারণা দিয়েছে আমাকে উপন্যাসটি সম্পর্কে। এ লেখার মোটিভ উপন্যাসের বিষয়বস্তু নয় বরং উপন্যাস কিভাবে স্কুলে পড়ানো হচ্ছে সে বিষয় নিয়ে। প্রতি বছরই ওদের নতুন নতুন উপন্যাস পড়ানো হয়েছে। না বলে পারছি না যে কোভিডের পূর্ণ আইসোলেশন অবস্থায়ও যখন কি না অনলাইন ক্লাস বজায় ছিলো, ইংরেজির ক্লাশ শিক্ষক নিজে বাড়িতে গিয়ে গিয়ে উপন্যাস ছাত্রদের হাতে পৌছে দিয়েছে। প্রতিবারের মতোই এ উপন্যাসটি ওদের ক্লাশে পড়ানো শুরু হবার সাথে সাথেই আমাদের বাসায়ও এ বিষয়ক বাতাস বইতে শুরু করে। বর্ণমালা নিজে তো এনগেজড থাকছেই, আমারও শোনার আগ্রহ আছে বলে গল্পের উত্তেজনা আমাকেও ক্রমশ: গ্রাস করতে থাকে! প্রায় কয়েক সপ্তাহ এভাবেই সারা বাড়ি জুড়ে উপন্যাস উপন্যাস গন্ধ মঁ মঁ করে। অন্যরা কিভাবে নেয় জানি না, তবে আমরা মা-মেয়ে দুইজন নানাভাবে এ বিষয়ক আলোচনায়-আলাপে ডুবে থাকি। বর্ণও স্কুল থেকে ফেরে এক ঝুড়ি গল্প নিয়ে, অন্যান্য ক্লাশমেটদের, শিক্ষকের। উপন্যাসের উসিলায় ওর অন্যান্য নানাদেশী ক্লাশমেটদের গল্পও ঢুকে পরে আমাদের ঘরে। আমরা উপন্যাসটিকে একজন চাইনিজ/ হাঙ্গেরিয়ান অথবা বৃটিশকানাডিয়ান স্কুলছাত্রের চোখ দিয়েও উপভোগ করার সুযোগ পেয়ে যাই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, ভিন্ন ভিন্ন কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা বাচ্চারা কেমন করে একই ঘটার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করে! খুবই আনন্দের ঘটনা! এইখানে একটু ফুটনোট দিয়ে রাখি, বর্ণ স্কুলের যে প্রোগ্রামটিতে পড়ে, সেটি আবার একটি বিশেষ সায়েন্স এবং ম্যাথবেজড প্রোগ্রাম, যার একটি আলাদা নামও আছে, ’টপস প্রোগ্রাম’ নামে। ব্যক্তিগতভাবে আমার সবসময়ই মনে মনে একটা প্রশ্ন ছিলো, সায়েন্সবেজড একটা প্রোগ্রামে সাহিত্য কি আর সত্যিই আগ্রহ নিয়ে পড়াবে এরা! কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে গত চার বছরে এই প্রোগ্রামে শুধু যে ভালো ভালো কিছু উপন্যাস যেমন, ওরেক্স এন্ড ক্রেক (মার্গারেড অ্যাডউড, কানাডা), ওডেসি (হোমার, গ্রীক মিথোলজি), ফ্রাংকেনস্টাইন (মেরি শেলী, ইংল্যান্ড), এক্সিট ওয়েস্ট (মহসীন হামিদ, পাকিস্তান), ক্যাচ-২২ (জোসেফ হিলার, আমেরিকা) পড়িয়েছে তা না, পড়ানোর কায়দাটি দেখেও বিস্মিত হয়েছি! পাঠক একটু খেয়াল করবেন উপন্যাসের বিষয় ও লোকেশনের বিচিত্রতা!
কানাডায়, বিজ্ঞান ও অংকভিত্তিক একটি প্রোগ্রামের নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশশ্রেণী পরযন্ত লেখাপড়ার কালিকুলামে উপন্যাসকে কতখানি গুরুত্বের সাথে এবং কিভাবে ক্রিটিক্যালি দেখার ব্যবস্থা করানো হয় তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করাই আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য। মজার ব্যাপার হলো, যদিও অন্যান্য বিষয়ের মতোই এখানেও নাম্বারের ব্যাপার আছে, তারপরও উপন্যাস পাঠ ব্যাপারটাকে তারা সরাসরি প্রশ্নোত্তর জাতীয় কিছু হিসেবে সাজায় নি বরং বিশ্লেষণ ও ছাত্রদের চিন্তাশক্তি ব্যবহার করার দিকে গুরুত্ব দিয়েছে। এবছরের উপন্যাস পড়ানো অংশটির ক্লাশনাম হলো ” ক্যাচ-২২ সেমিনার”। ক্যাচ-২২ উপন্যাসটি স্কুলে পড়ানোর ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতাটি এখানে শেয়ার করছি মাত্র।
শুরুতে পুরো উপন্যাসটা আগাগোড়া পাঠ করানোর ব্যবস্থা করা হলো। আগেই বলেছি যে এটি একটি ঢাউস উপন্যাস, প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠা। বুঝে পাই না, যে ক’টি পড়ানো হয়েছে, প্রতিটিই মোটামুটি এই সাইজের! এজন্য তাদেরকে ক্লাশের নিয়মিত সময় ছাড়াও স্কুলেই বাড়তি ঘন্টা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পাঠের নিমিত্তে। বাড়িতে পড়ে আসো জাতীয় রিস্ক নেবার দরকার নাই, ক্লাশের কাজ বরং ক্লাশে সারো। প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে উপন্যাসটি স্কুলের তরফ থেকে সরবরাহ করা হলো আর ক্লাশরুমে মৌখিকভাবে উন্মুক্ত গল্পটি বলাবলির ব্যবস্থা করা হলো। ব্যাপারটা এমন, প্রতিটি ছাত্রছাত্রীই যেনো শুরুতেই উপন্যাসটি বুঝে উঠবার জায়গাটিতে কম জটিলতায় ভোগে। মনে রাখার ব্যাপার আছে, ছাত্রছাত্রীরা নানান সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা এবং ফিকশন পড়াপড়ির অভিজ্ঞতা সবার সমান নাও থাকতে পারে। উপন্যাস নিয়ে আড্ডাবাজির কাজটি যেনো স্কুলেই করা সম্ভব সেই সুযোগ দেয়া স্কুলের দায়িত্ব। পড়ার সময়টি যেনো ফাঁকিবাজি না করে, সেটির দেখভাল করা ইংরেজির শিক্ষকের দায়িত্ব। লেখক সম্পর্কে, উপন্যাস সম্পর্কে নানা ম্যাগাজিনে বের হওয়া রিভিউ, খবরের কাগজের ক্লিপ ছাত্রছাত্রীরা হাতের কাছেই পায়, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তার উপরে বাড়ছি সোর্স হিসেবে ইন্টারনেট তো আছেই। সবার চেয়ে বড় কথা হলো, উপন্যাস পাঠকালীন যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য, বা পাঠ নির্দেশনার জন্য ইংরেজির শিক্ষক অনলাইন এবং অফলাইনে ছাত্রদের কাছে টানা সহজলভ্য থাকছেন। ছাত্রটা হয় ফোনে, নয় মেইলে নয় সরাসরি যখন যা খুশি তাঁকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাচ্ছে। এভাবেই বিজ্ঞান বা অংকের আপাত রসহীন জগতের চাপ থেকে আনন্দের সাথে ছাত্ররা ঢুকে পরে সাহিত্যের ম্যাজিকাল জগতে! উঁহু, বইয়ের ঢাউস সাইজ, উপন্যাসের স্পেশাল ভাষা, বিজাতীয় সংস্কৃতি বা লোকেশনের জটিলতা তাদের তেমন বিচলিত করে না বলেই শুনেছি। উপন্যাসের প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করার চাপ নেই, শুরুতে শুধুই কাহিনীর ভেতর ডুব দিয়ে থাকা!
এরপরের কাজ হলো চ্যাপ্টার ভাগ করে দেয়া যাতে আরো একটু ঘনিষ্ঠভাবে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে স্ক্যান করা চলে। ছোট ছোট করে দল গঠন করা হলো, প্রতি দলে দুই জন। দল ছোট রাখার প্রথম কারণ হলো উপন্যাসটি আদতেই বিশাল। তাছাড়া ছোট দলে ক্রিটিক্যাল চিন্তার ক্ষেত্রটা আরো গভীর হবার সুযোগ থাকে। একেকটি গ্রæপের কাজ হলো তাদের জন্য বরাদ্দ দেয়া চ্যাপ্টারটি আরো গভীরভাবে পড়া ও বিশ্লেষণ করা। ছাত্রদের কাজ হলো মূল উপন্যাসের আঙ্গিকে র্নিধারিত চ্যাপ্টারগুলোর প্রতিটি অংশ নানাভাবে বিচার করা, কানেক্ট করা। চ্যাপ্টারের থিম, নাটকীয় মুহূর্ত, কোথায় কোথায় স্যাটায়ার করা হয়েছে এবং কেনো, লেখকের অন্যান্য উপন্যাসের সাথে কোনো সংযোগ অথবা পার্থক্য আছে কিনা, লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে উপন্যাসের সম্পর্ক, বাক্যের ভেতরের অন্তরনিহিত অর্থ, কন্ট্রাডিকশান, প্রতিটি চরিত্রের নিখুঁত অবজারভেশন, প্রয়োজনীয়তা, দুরবলতা, বাহুল্য ইত্যাদি নিয়ে নিজ নিজ গ্রæপের ভেতর আলোচনা করা। শুধু তাই নয়, চিন্তার জগতকে আরো একটু প্রসারিত করার জন্য উপন্যাসের পটভূমি ধরে ছাত্রদের দিকে ছুঁড়ে দেয়া হয় উপন্যাসের রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক বৈচিত্র্যের দিকটি। কোন ধরণের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা- সে পুঁজিবাদ বা সমাজতন্ত্র হোক, কিভাবে কাজ করে, বিকশিত হয় এবং শেষাবধি তা ব্যক্তির সাামজিক-মানসিক পরিসর পরযন্ত কতখানি নিয়ন্ত্রণ করে ইত্যাদি। আরো আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় একশো বছর আগের ঘটনা, পৃথিবীর প্রভূত বদলও ঘটেছে, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মেরুকরণ বদলেছে, তারপরও এই উপন্যাস চলতি সময়কে কতখানি ব্যাখ্য করতে সক্ষম? ছাত্রদের আলোচনায় উপন্যাসের ভ্যালিডিটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা বটে। তবে পুরো বিশ্লেষণ পদ্ধতিটি যেনো ছাত্রদের বিভ্রান্ত বা এলোমেলো করে না ফেলে তার জন্য এই পর্বে তাদের জন্য গাইড হিসেবে ছাপানো রুবরিক দেয়া থাকে। গাইডলাইনে পরিষ্কার নির্দেশনা থাকে কিভাবে তারা আগাবে পরবর্তী ধাপে।
নিজেদের ভেতর গ্রæপ আলোচনায় বোঝাবুঝি শেষ হলে প্রতিটি গ্রুপের কাজ হলো ক্লাশ সেমিনারে উপস্থাপনার জন্য পাওয়ার পয়েন্ট ক্লিপ তৈরি করা। পাওয়ার পয়েন্ট ক্লিপ ছাড়াও তাদের তৈরি থাকতে হবে ক্লাশের অন্যান্য ছাত্রদের উপস্থিত প্রশ্ন মোকাবেলা ও ব্যাখ্যা করার জন্য। ধরা যাক উপস্থাপনা দলটির সদস্য হচ্ছে দুই জন। কাজেই এই দুইজন ছাড়া বাকিরা, মানে ক্লাশের অন্যান্য ছাত্ররা ওইদিনের ক্লাশে শ্রোতা এবং প্রশ্নকর্তা।
আরও মজার ঘটনা আছে এখানে। ক্লাশের মোটমাট শ্রোতাদের আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। একদল ’ইনার গ্রæপ’ হিসেবে উপস্থাপনা দলটিকে প্রশ্ন করবে, ব্যাখ্যা দাবি করবে, বিশ্লেষণ করতে বলবে অথবা ফিডব্যাক দেবে। শ্রোতাদের দ্বিতীয় দলটি ’আউটার গ্রæপ’ হিসেবে চুপ থাকবে নিজেদের নোটবুক হাতে নিয়ে। তারা হচ্ছে নীরব অবজার্ভার। তারা উপস্থাপনা দল এবং ইনার দলকে নিবিড় পরযবেক্ষণ করবে এবং নোট নেবে। আউটার দলটির কাজ হলো ওই দুই দলের দক্ষতা, আগ্রহ, কৌতুহল, অ্যাকিটিভ অংশগ্রহণ ইত্যাদি পরিমাপ করা। একইভাবে ঘুরে ঘুরে সপ্তাহ দুয়েক ধরে চলবে সেমিনার প্রেজেন্টেশন। ততদিনে, বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে উপন্যাসের অস্থি-মজ্জা ভাজা ভাজা অবস্থা।
আর পুরো সময় জুড়েই শ্রেণীকক্ষের সাহিত্যের শিক্ষকের কাজ হলো এই পুরো প্রক্রিয়ার ডিজাইন করা, ছাত্রদের মটিভেশন দেয়া ও ইনভলব করা এবং গ্রেডিং করা। এই প্রক্রিয়ায় একটি দুর্বল ছাত্র ঠিক কোন জায়গাটিতে দুর্বল এবং ঠিক কোন জায়গায় তার সবলতা আছে তা আইডেন্টিফাই করার মাধ্যমে তাকে নম্বর দেয়া হয়। দেখা যায়, একটি ছাত্র কথা গুছিয়ে বলতে না পারলেও হয়তো তার অবজার্বেশন খুব শার্প। আরেকটি ছাত্র হয়তো ভালো তার্কিক, অথবা কেউ হয়তো উপন্যাসের সাব-টেক্স খুব ভালো বিশ্লেষণ করতে পারছে। প্রতিটি ছাত্র ইউনিক, প্রতিটি ছাত্রের ভেতর সম্ভাবনা আছে, প্রতিটি ছাত্রই কোথাও না কোথাও দুর্দান্ত!
সবার শেষে, ছাত্ররা আরো কিছুদিন উপন্যাসটি নিজেদের কাছে রাখার সুযোগ পেলো যাতে শেষবারের মতো, চাইলে আরো একবার পুরো উপন্যাসটি পড়ার সুযোগ পায়। অবশ্য সেটা অবশ্যপাঠ্য নয় স্কুলের তরফ থেকে। যার যার কৌতুহল থেকে সে সে পড়তে পারে। যদিও, দেখলাম পুরো প্রক্রিয়া শেষ হবার পরও বর্ণমালা হুমড়ি খেয়ে আবারো পড়ছে বইটি আর ক্ষণে ক্ষণে বলে উঠছে, “মা, এইবার আমি ভাষাটা পরিষ্কার বুঝতে পারছি, দেখো দেখো অমুকে অমুক কেন বলছে এখন আমি জানি…!”
লেখাটা দরকার মনে করলে আরো একটু ঠিকঠাক করে নিয়েন। ভালো থাকেন জাহাঙ্গীর ভাই!
লেখক : টরন্টো, কানাডা