মূল: কার্ল হফ্ম্যান – ভাষান্তরে: সেলিম হিমাদ্রি : (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্লেনগুলোতে যাত্রীবোঝাই থাকলেও ভিতরটা বেশ পরিস্কার, কর্মচারি-ক্রুরা না হয় একটু রুঢ় ব্যবহার করতে পারে – তা’তে কি হয়েছে! ইন্টারনেটে টিকেট কেটে প্লেনে ওঠো, ছোট্ট এক ব্যাগ বাদাম পাবে এবং এক সময় তোমার ঠিকানায় সহি-সালামতে পৌঁছে যাবে।
অন্যদিকে, আফ্রিকার আকাশ-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ এক ভিন্ন জগৎ। আফ্রিকার ৯০টার মধ্যে ৫০টা এয়ারলাইন্সকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ‘ফাইং কফিন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এ’সব এয়ারলাইন্সগুলো আমেরিকার এয়ারলাইন্সের তুলনায় ২৫ গুন ঝুঁকিপূর্ণ।
লরেন্স অসবর্ন ‘নগ্ন পরিব্রাজক’ বইয়ে লিখেছেন, “দেশ আবিস্কার এখন একটা সেঁকেলে আত্মগরিমার মানসিকতা …..পর্যটন শিল্পের বিস্তারে দেশ আবিস্কারের আসল মোহ বা অহঙ্কারকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছে….এখন ভ্রমণপিয়াসূদের জন্য আগের সেই আবিস্কার করার মতো দেশ আর নেই।”

তাঁর এই হেয়ালীপূর্ণ কথার মর্ম বুঝতে পারলেও মেনে নিতে পারছি না। এইতো আমি নিজেই ঘর ছেড়ে বের হয়ে অনিশ্চয়তার পথে পা’ ফেলেছি। প্রতি পদে পদেই যাত্রী বোঝাই বাস গভীর খাঁদে পড়ে যায়, নৌকা-লঞ্চ-ফেরি টপাটপ ডুবে যায়, প্লেন চকিতে আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে – প্রতিদিনই কিন্তু আমরা আমাদের অগোচরেই মারাত্মক, ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাফেরা করছি।

যতই এ’ধরনের মৃত্যুফাঁদ দেখছি ততই আমার কৌতুহলটা বাড়ছে। কোনোমতেই দমাতে পারছি না। ইচ্ছে হয়, মৃত্যুফাঁদের এই গণ পরিবহনগুলোতে উঠে সারা পৃথিবীটা চক্কর দিয়ে আসি। যাত্রীসহ ডুবে যাওয়া ফেরি, খাঁদে ছিটকে পড়া বাস বা আকাশ থেকে পড়ে যাওয়া প্লেনগুলো দুর্ঘটনার আগে কেমন ছিল – খুঁটিনাটি জানতে ইচ্ছে করে।

দুনিয়ার সব খেটে খাওয়া লোকজনদের মতো আমিও একই যানবাহনে চড়ে তাদের অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে চাই। এসব বাহনগুলোই সাধারণ লোকজনদের জন্য সহজলভ্য একমাত্র সম্বল।

একটা দীর্ঘ বেড়ানোতে অবশ্য অনিশ্চয়তার অভাব হয় না। যতটুকু সম্ভব নিজেকে নিরাপদ ও সুস্থ্য রাখতে হবে। লাইফ ভেষ্ট, পানি-রোধক সংকেত পাঠানোর বাতি রাখতে হবে। গত বড়দিনের সকালে আমার বোন ‘সারভাইভাল কিট’ জাতীয় একটা টিনের কৌটা উপহার দিয়েছিল। আদৌ কাজে আসবে কিনা বলা মুশকিল।

বাক্সের ভিতর কমলা রংয়ের প্লাষ্টিকে মোড়ানো কয়েক পাতা বড়ি – শরীরের নিচ দিয়ে তরল পদার্থ পিচ্কারির মতো ছুটতে শুরু করলে পানিতে গুলে সেব্য। তরল পদার্থে রক্ত দেখলে সোজা কবিরাজ-বৈদ্যের উপদেশ-নির্দেশ মানতে হবে। দম নিতে কষ্ট হলে ‘জিথ্রোমাইসিন’। বেশি ব্যাথায় কোডেইন মেশানো বেদনানাশক টাইলেনল – ২টা করে প্রতি ৪ ঘন্টা অন্তর অন্তর । ম্যালেরিয়ায় ‘ম্যালারন’। কাটাছেড়াঁ সেলাই করতে জীবানুমুক্ত সূঁইসূতা।
জীবন বীমাটা দ্বিগুণ করতে চাইলাম। লাভ হলো না। দু’ দু’টা বীমা কোম্পানীর প্রতিনিধিরা বিফল -অনেক চেষ্টা করেও কোনো বীমা কোম্পানীকে রাজি করাতে পারে নি। জানতে চেয়েছে কোন্, কোন্ দেশে যাব এবং কোন্ ধরনের গাড়ি-ঘোড়ায় চড়বো। অবশ্য, ইচ্ছে করেই বীমা কোম্পানীর পাঠানো ভ্রমণ-তালিকায় দেশ এবং যানবাহনের ইতিবৃত্তান্ত বলতে ভুলে গেছি। ‘এআইজি’ বীমা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি বলে দিলেন, ‘আপনার ‘ভ্রমণ বৃত্তান্ত’ বড্ড বেশি আগোছালো আর অতিরিক্ত অনিশ্চয়তায় ঠাঁসা।’

ওদিকে, ডাক্তার সাহেব তাঁর জানামতে সব ধরনের টিকা শরীরে ফঁুিটয়ে দিলেন – হেপাটাইটিস এ, বি, জাপানি এনসেফালাইটিস, পিত্ত জ¦র, টাইফয়েড, টিটেনাস এবং কলেরা। মনে হয়, আর কোনো কিছু ফোঁটাতে হবে না বা সঙ্গে নিতে হবে না। সব গোছানো শেষ।

প্রতিদিনের সাদামাটা জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর ফন্দিটা মনে হয় জীবনের শুরুতেই ভালোভাবে রপ্ত করেছিলাম। কাজের জীবন শুরুই হয় ঘুরে বেড়ানোর সাথে সাংবাদিকতা করা। দু’টাই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আলাদা করা যায় না।

একটা পত্রিকা থেকে প্রতিবেদনের জন্য প্রথম পাঠায় ট্যাঙ্কারের এক ক্যাপ্টেনের দিনপঞ্জির ফিরিস্তি তুলে ধরতে। ৬০০ ফটু লম্বা মালবাহী জাহাজটা রাসায়নিক পদার্থ আনা-নে’য়া করে। চলে আটলান্টিক উপক‚লের কাছাকাছি। কানেকটিকাটের নিউ হ্যাভন-এ নোঙ্গর করা ট্যাঙ্কারে ওঠার জন্য বেড়িয়ে গেলাম। বেশ ভালোই ঘাবড়ে গেছি। সারাটা পথ গা-ঘোলানো বমি-বমি ভাব শরীরে লেপ্টে ছিল।
৩ সপ্তাহ পর সম্পাদক সাহেব ডেকে পাঠালেন, “আগামী ২ সপ্তাহ ক্যানারী দ্বীপে কাটানোর প্রস্তাবটা কেমন মনে হয়?”

সেই সময়টায় চিরকুমার থাকাটা বেশিদিন টিকলো না। এক গরমের মৌসুমে ২২-এ পা’ দে’য়া মাত্র লিন্ডসের প্রেমে পড়ে গেলাম। ৫ বছর পর বিয়ের বন্ধন। দু’জনের স্বাধীন পেশার কারণে ঘর-সংসার সামাল দিতে তেমন ঝামেলা পোহাঁতে হয় নি। সব সময় একে অপরকে কাছে পেয়েছি। তবে, কোনো কোনো সময় কাজের খাতিরে দূরের কোনো এয়ারপোর্টে, প্লেনে ওঠার আগে বড় একা, বড় অসহায় মনে হতো। এখনো মনে পড়ে, সেইন্ত লুসিয়ায় প্লেনে ওঠার সময় গলা ভারী হয়ে কান্না আসছিল। প্রতিদিন লিন্ডস্কে ফোন করতাম।

মনে পড়ে না, কিভাবে সবকিছু বদলে যেতে শুরু করল। খুব আস্তে আস্তে বদলে যেতে শুরু করলাম। বছরের পর বছর ঘর-সংসার ফেলে পৃথিবীর নানা দেশে থাকাটা কেমন করে যেন সহজ, গা’সহা হয়ে গেল। কখনো তেমন কিছুতে বেশিক্ষণ মনোযোগ রাখতে পারতাম না। এখন কাজের টানে আমার সমস্ত ধ্যান-ধারণা, মেধা-মনন, শক্তি-সামর্থ্য, দিন-রাত কাটে মনের মতো একটা খবর বা প্রতিবেদন তৈরি করতে। অন্যের জীবন-যাত্রায় অবলীলায় ঢুকে গিয়ে খবরের মাল-মশলা জোগার করতে হয়।

একটা সুন্দর বস্তুনিষ্ঠ খবর বা কাহিনি সাজাতে গিয়ে নিজের আরাম-আয়েস ভুলে যেতে এখন আর কষ্ট হয় না। কয়েক বেলা না খেয়ে থাকতে পারি। শীত-গরম কিছ্ইু আর গায়ে মাখি না। বৈরাগী হবার আগে যা’ কল্পনাও করতে পারি নি। প্রতিটা কাহিনি এখন আমার কাছে মরা-বাঁচার ব্যাপার। দুর্গম জায়গায় অবলিলায় চষে বেড়াই। আবার, নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসি। অনেক সময় মনে হয়, এতকিছু করতে পারার মূল কারণ হয়তঃবা আমার সংসার নামের নোঙ্গরটা পাথরে না আটকে বেলাভূমিতে আলতোভাবে পড়ে আছে। তাই বলে লিন্ডসের উপর আমার টান এতটুকুও কম না।

পত্রিকার পয়সায় দেশ-বিদেশ দেখার অশেষ কৌতুহল মিটছে। মিশনারীদের প্লেনে করে নিউ গিনির পাহাড়-জঙ্গলের আদিবাসিদের গ্রামে গিয়েছি। ভারাটে সৈন্যদের সাথে প্লেনে করে দক্ষিণ সুদান দেখেছি। সাইবেরিয়া গিয়ে বিলুপ্তপ্রায় এক আদিবাসিদের সাথে বসে রেঈনডিয়ার হরিণের পায়ার স্যূপ খেয়েছি। ১৫০ ফুটের জাহাজে করে ঘুরবার সময় জন ওয়েনের মতো দেখতে এক লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। আমরা তখন গ্রীনল্যান্ডের দখিন-পূব উপক‚লের কাছাকাছি। একসাথে বসে চুক চুক করে হুইস্কি গেলার সময় তার জীবনের একটা অজানা দিক শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। কোনো এক সময় তাকে সলোমন দ্বীপে বন্দী করে মাত্র ৩ বর্গফুটের বাক্সে আটকে রেখেছিল। পরে, এক সময় ছাড়া পেয়ে সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন।

ঘুরে বেড়ানোটা এক ধরনের নেশার মতো। এমন একটা সময় ছিল যখন কোথাও যাবার আগ মুহুর্তে, প্লেনে ওঠার সময় অজানা আবেগে বুক-গলা ভারী হয়ে যেত। এখন, অধির আগ্রহে অপেক্ষা করি কখন প্লেনে উঠবো। প্লেনে ওঠার ব্যাপারটা এখন পাশা খেলার ঘঁুিট ছোড়াঁর মতো। অবারিত, দিগন্তহীন আকাশের ছোঁয়া। আবার আমার যাত্রা শুরু। এবার কী অভিজ্ঞতা হবে? কী, কী দেখবো? কার সাথে দেখা হবে? ঠিকঠাক মতো কি খবরটা তৈরি করে পাঠাতে পারবো? বেঁচেই বা থাকবো কি? অজানা-অচেনা লোকজনদের জীবনে ঢুকে যেতে পারবো। তাদের চোখ-মন-শরীর দিয়ে অন্য জীবন-চিত্র দেখবো।

সাংবাদিক হ’বার এ’টাই মস্তবড় লাভ – অল্প সময়ের জন্য হলেও অন্যের জীবন ধার করে নিজের জীবন-যাপন। নতুন এক জীবনে আনাগোনা।

প্রতিটা সীমান্ত পারাপারে আমি চলে যাই অদ্ভ‚ত, অজানা, অদেখা এক দেশে। এই যেমন, গ্রীনল্যান্ডে গাছপালাহীন ধূঁ ধূঁ বরফের মরুভুমির উপর ঈন্যূইট আদিবাসিদের কুকুরে টানা ¯েøজ, চাবুকের বাতাস চেড়ার সপাং সপাং শব্দ। বোর্নিও দ্বীপে, লম্বা ধাঁচের কুড়ে ঘরে বসে ডায়াক গোত্রের মেয়েদের ঝুড়ি বোনা দেখি। গুয়েতেমালায় মায়ান গোষ্ঠীর এলাকায় – ধপূ-ধূণার ধোঁয়ার আবরনে ঢাকা অদ্ভ‚ত, নাম না জানা দেবতার পূঁজা দেখার সৌভাগ্য। যতই এ’সব কাহিনী শুনি বা দেখি ততই মন উতালা হয়ে যায়। বুঝতে বাকি নেই, কোনোমতেই না দেখে থাকা অসম্ভব।

ঘরে ফিরে যাওয়াটা এখন হয়ে গেছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমার ভিতর এখন দু’টা স্বতন্ত্র স্বত্তার সমান ঠোঁকাঠুঁকি। একজন আমি দক্ষিণ সুদানে – যুদ্ধাহতদের মাঝে, প্রচন্ড গরম, মাছির ভনভনী অত্যাচার। আবার, আর এক আমি – স্কুলের শিক্ষকদের সাথে আমার ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার হাল-হকিকত নিয়ে বিস্তর আলোচনা, পরামর্শ। কোনো একদিন হয়তঃ নৌকায় করে আমাজন নদীর উপর। আবার, পরদিন হয়তঃ দেশে ফিরে ঘর-দোর পয়-পরিস্কারে মহা ব্যস্ত। বাজার-সদাই করছি। বউ-বা”চারা অধীর আগ্রহে থাকে – আমার কে”ছা শুনবে। যতটুকু সম্ভব শোনাই। শুধু বলতে পারি না, আমার এই নতুন গজিয়ে ওঠা দ্বিমুখি চরিত্রকে সামাল দে’য়ার আপ্রাণ চেষ্টা – যেমন ভবঘুরে তেমন দায়িত্ববান বাবা-স্বামী। দিনে দিনে বাড়ছে দ্বিমুখি চরিত্রের প্রভাব। টের পাচ্ছি, আস্তে আস্তে ঘরে ফেরার মোহ কমে গিয়ে বাইরে টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর বাতিক বাড়ছে।

একদিন শরীর বিগ্ড়ে গেল। ফু’র মতো প্রচন্ড লক্ষণ। চলাফেরা করতে পারলেও কেমন যেন কান্ত, শক্তিহীন, অবসন্ন ভাব। উঠে দাঁড়াতে কষ্ট হয়। ঠিকমতো ঘুম হয় না। এক বছর ধরে ভুগছি। ডাক্তার কোনো অসুখের লক্ষণ খুঁজে পায় না। হঠাৎ একদিন ফোনে ক্রীং ক্রীং। তার পরের সপ্তাহে আমি ঘর ছাড়া। আমার জন্য ব্যাপারটা এখন নতুন কিছু না।

কাজের ডাকে প্রশান্ত সাগরের মাঝখানে যেতে হবে। প্রায় দু’মাস কাটাতে হবে। এমেলিয়া এরহাটের্র খোঁজ-খবর নিতে হবে। সাগরের নীল পানি, উড়াল মাছ আর তিমির ডাক শোনার সাথে সাথে প্রথমদিনেই শরীরের সমস্ত ম্যাজম্যাজানি, নিরাশক্তভাব এক নিমিষে উধাও। কাজ শেষে ৮ সপ্তাহ পর আবার ঘরে ফেরা। কান্তিভাব না থাকলেও টের পেলাম লুকিয়ে থাকা অসুখি, অতৃপ্ত মানসিক ভাব। প্রতিদিনের জীবন থেকে কোনোমতেই আলাদা করতে পারছি না।

আর্থার র‌্যান্সমে’র ‘সোয়ালোজ এন্ড আমাজনস’ বইটা আমার পছন্দের একটা বই। প্রথম পাতার কিছু কথা এখানে বলতেই হয়। ওয়াকার নামের এক লোকের বউ-বাচ্চা নিয়ে ছুটি কাটানোর গল্প। হ্রদের পাশে ভাড়া করা কুটিরের লাগোয়া নৌঘাঁট। তার চার বা”চা ঘাঁটে বাধাঁ একটা ডিঙ্গি নৌকা দেখতে পায়। ওই দূরে, হ্রদের মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপ। বাচ্চাদের মাথায় একটাই চিন্তা – ওই ছোট্ট দ্বীপটা হেনতেন একটা দ্বীপ না! একটা বিশেষ দ্বীপ। ওদের জন্যই বসে আছে। ভাবখানা যেন, ওই দ্বীপটা শুধু ওদেরই। চোখের সামনে এমন একটা নিজস্ব দ্বীপ দেখার পর কার মন চায় হ্রদের পাশে বসে থাকতে? রাত নামলে শুরশুর করে ঘরে ঢুকে পড়া আর টুপ করে ঘুমিয়ে পড়তে কি ভালো লাগে? বিশাল সাগরের মতো দেখতে সামনের হ্রদ, ঘাঁটে বাঁধা ১৪ ফুটের ডিঙ্গি, ওই দূরে, গাছ-গাছালিতে ঢাকা নতুন দ্বীপ আবিস্কার! এতকিছুর আয়োজন মানেই – নাগালে থাকা ডিঙ্গি নৌকায় পাল তুলে নতুন দেশ আবিস্কারের হাতছানি।

আর্থার ভ্রাম্যমান সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সময় ১৯৩০ সালে বইটা লিখেছিলেন। দ্বায়িত্বের কারণে রাশিয়ার বিপ্লবের খবর জোগার করতে গিয়ে লিওন ট্রটস্কী’র সচিবকে বিয়ে করে ফেলেন। ২০ফুট লম্বা নৌকায় করে বালটিক সাগরে ঘুরে বেড়াতেন। সেই অভিজ্ঞতাই উপরের বইয়ে তুলে ধরেছেন। এত সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী আমি আর কখনোই পড়ি নি। একটা নৌকা, এক অদেখা দ্বীপ, আবিস্কারের আকাঙ্খা। ভাবনাটা ভিতরে পাখা মেলে। সমস্ত স্বত্ত¡াকে ঢেকে ফেলে, কোনোমতেই মুছে ফেলতে পারছি না! অন্যকিছু আর ভাবতে ভালো লাগে না বা প্রয়োজনও মনে করি না।

“ঘর-পালানোর এত বাতিক কেন্ তোর?” বন্ধুরা জানতে চায়। শুভাকাক্সিক্ষ হিসেবে বন্ধুরা মাথা চুলকায় আমার এই পাগলামির থৈ খুঁজে পেতে। ভবঘুরে খাসালতের মধ্যে পৌরুষত্ব বা বীরত্ব জাহির আর স্বে”ছা-বলিদান ছাড়া আর কিছুর হদিস পায় না। অজানার উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়ার আগেই বন্ধুরা যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিয়েছে। শুভ কামনা দূরে থাক, সামান্য শোক বা সমবেদনা জানানোও প্রয়োজনবোধ করে না। হঠাৎ করেই সবাই যেন কেমন উধাও হয়ে গেছে। বুঝে গেছে, আমার মাথার তার ছিড়ে গেছে। আমার সাথে বন্ধুত্ব ছিল বলে খুবই সরমিন্দা। বুঝে উঠতে পারছে না, আমাকে নিয়ে ওরা কী করবে।
‘বেচারা কার্ল!’

মনের আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পাই আমাকে নিয়ে ওরা এখন কী বলছে,“ওই গবেটটার মাথার ঘিলু সব গোবর হয়ে গেছে, ধুঁকে ধুঁকে নিজেকে শেষ করতে সাধের বৈরাগী হয়েছে!”
কিš‘, আমার মন বলছে, সবকিছু আমার অনুক‚লে। মোক্ষ সময় বেছে নিয়েছি বৈরাগী হবার। এমেলিয়া এরহার্টের ভবঘুরে স্বভাবের ছোঁয়াচে রোগ শরীরে ঢোকার পর থেকে আরও বেশি বেশি করে চক্কর দে’য়া হয়ে গেছে। আমার দিনগুলো হয়ে গেছে এখন একটার পর একটা প্লেন থেকে ওঠা আর নামার হিসেব রাখতে রাখতে। প্রতিবারের ঘোরাঘুরিতে আমার সাহস বেড়ে গেছে, অজানা জায়গা আর অজানা মনে হয় না।

এখন আমাকে বড়সড় আকারের কিছু একটা করতে হবে। জীবন নামের বোতল থেকে ছিট্কে বের হওয়া দরকার। একমাত্র লম্বা সফরগুলো দিয়েই এই অসাধ্য সাধন সম্ভব। এখনও অনেক অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে – খুব জানার ইচ্ছা, দেখার ইচ্ছা। এমন একদিন আসবে, যখন ঘরে ফিরব নতুন একজোড়া দিব্যচোখ নিয়ে।

ওয়াশিংটন ডি.সি.’র পূব পাশের পরিত্যক্ত শিল্প এলাকার ভিতর দিয়ে নিউইয়র্ক এভিন্যূ’র জানজটের মধ্যে গা ভাসিয়ে দিয়ে হেলতে-দুলতে আমাদের বাসটা ছুটছে। গরমের মৌসুমে ঝড়ো হাওয়া ‘চেসাপেক বে’র উপর দিয়ে বয়ে যায়। ঝড়ো হাওয়ার মতো আমার উদ্বেগ-উৎকন্ঠাও অল্প অল্প করে উবে যায়। সামনে হয়তঃ দুর্ভোগ-দুর্দশা, বিপদ-আপদ আমার জন্য মুখিয়ে আছে। তাতে কি, তারসাথে তো অজানা, অদেখাও আমার পথ চেয়ে বসে আছে – যা’র জন্য আমি ঘর ছেড়েছি। এই এক এমন অনুভ‚তি যার মাঝে আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা। ভেবে দেখলাম, আমি আসলেই অনেক ভাগ্যবান!

যা’হোক, যেমনই হোক – যে কোনো কিছুর মোকাবেলার জন্য তৈরি হয়ে আছি। কে জানে, সবচেয়ে বিপদসংকুল, ভয়াবহ একটা লম্বা সফর আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এমন অজানা, অচেনা জায়গায় যেটা হবে একদম আন্কোরা, মচমচে অভিজ্ঞতা!

সামনের আঁকাবাঁকা, প্যাচানো রাস্তাটা উত্তরমুখি হলেও আস্তে আস্তে নিয়ে যাবে একেবারে দক্ষিণ দিকে। আমার যাবার ই”ছা দক্ষিণ আমেরিকার দিকে।

একমাত্র এয়ারলাইন্সের নাম এখন সবচে’ বেশি জ¦লজ¦লে – কিউবানা এয়ারলাইন্স। নিরাপত্তা বিষয়ক সূচক সবচেয়ে মারাত্মক এবং ভয়াবহ। আমেরিকার এক এয়ারলাইন্স – সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের ‘ফেটাল ইভেন্ট রেটে’র তুলনায় ২০ গুণ বেশি! কিš‘ মুশকিল হলো, কিউবার সাথে আমেরিকার ক‚টনৈতিক সম্পর্ক নেই।

কিউবানা এয়ারলাইন্সে চড়তে হবে বাড়ির পাশের কানাডার টরান্টো থেকে। আর, টরান্টো যাবার সবচেয়ে খতরনাক পন্থা বা বিপজ্জনক উপায় হলো ওয়াশিংটন থেকে চায়না বাস কোম্পানীর বাসে নিউইয়র্ক। (চলবে)
sheemadri@gmail.com