মূল: কার্ল হফ্ম্যান – ভাষান্তরে: সেলিম হিমাদ্রি
sheemadri@gmail.com

গৌরচন্দ্রিকা
সবে তো মাত্র শুরু
কার্ল হফ্ম্যান আমেরিকার একজন ভ্রাম্যমান সাংবাদিক। আফ্রিকার কঙ্গোতে একটা প্রতিবেদন করতে গিয়ে ওখানকার আভ্যন্তরীণ প্লেনে চড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। তারপর, ঝোঁকের বসে তৃতীয় বিশ্বের তাবত গণপরিবহণগুলোর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র তুলে ধরতে পরিবার-পরিজন ফেলে ঘর ছাড়েন। সেই সুবাদে কিউবা থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা হয়ে এশিয়ার কয়েকটা দেশে ঘুরে বেড়ান। সব দেশের সাধারণ জনগণ প্রিয়জনের টানে, জীবিকার সন্ধানে ন্যূনতম নিশ্চয়তার কথা ভুলে মারাত্মক, বিপজ্জনক এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ বাস-ট্রাক-লঞ্চ-হাওয়াই জাহাজে চড়তে বাধ্য হয়। কার্লও সবার মতো একই যানবাহনে চড়ে এক চরম অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে নিতে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। সদরঘাট থেকে রকেট ইষ্টিমারে করে খুলনায় গিয়ে কয়েকদিন ঘুরেছেন। লঞ্চে করে চাঁদপুরে যাবার পথে ফেরদৌসের সাথে পরিচয় হয়। বাংলাদেশিদের আতিথেয়তায় অভাবনীয়ভাবে মুগ্ধ হয়ে যান। সব অভিজ্ঞতার ফসল একত্র করে ‘লুনাটিক এক্সপ্রেজ’ বইটায় তুলে ধরেন। আমার অক্ষম হাতের অনুবাদে আপনাদের সাথে তাঁর অভিজ্ঞতাটা ভাগ করতে নাম দিয়েছি – ‘উন্মাদ এক্সপ্রেস’! তা’হলে চলুন, কার্ল ভাইয়ের সাথে আমরাও ফেরদৌসের উঠোনে জিরিয়ে নেই, একটু ডাল-ভাত খেয়ে আতিথ্যের স্বাদ নেই। পৃথিবীটা একটু অন্য চোখে দেখি, ঘুরে আসি….

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সবক নাম্বার এক – দুনিয়ার যেখানেই যান না কেন, কাউকে কখনো গা ঘেঁষে দাঁড়াতে দিবেন না। ফকিরগুলিকেও ভালোমতো শিখিয়ে-পড়িয়ে রাস্তায় নামানো হয়। ‘হেলো, হেলো,’ – বলে আপনাকে ডাকবে। কাছে ঘেঁষে আপনার পকেটগুলি যাচাই করবে। ইচ্ছে করে আপনার গায়ে হেলে পড়বে, ঠেঁস দিবে। আপনি হয়তঃ কিছু মনে করেননি, ফকির মনে করে কিছু বলবেনও না। আবার, ধাক্কা বা বেসামাল হয়ে গেছে ভাণ করে গায়ে গড়িয়ে পড়বে। এবারও আপনি গায়ে না মেখে কিছু বলেননি। ভেবে নিয়েছেন – অনিচ্ছায় গায়ে হেলে পড়েছে। অত সহজে আপনাকে রেহাই দিবে না। আপনাকে চোখে চোখে রাখছে। আপনার মতি-গতি বুঝতে চেষ্টা করছে। বারে বারে গায়ে পড়ে গেলে আপনি কী করতে পারেন সেটাই মাপছে। তিনবারের মাথায় আপনার টাকা, আপনার ফোন ওদের কব্জায় চলে গেছে। টেরও পাবেন না।”

ভিড়ের মধ্যে উপায় না দেখে বগীতে ঝুলানো ষ্ট্রাপ ধরে ভারসাম্য সামলাচ্ছেন। ওদিকে কায়দা করে পকেটমারের দল আপনাকে ষ্ট্রাপ থেকে হাত নামানোর সুযোগ দিবে না। কোনো না কোনোভাবে কনুই দিয়ে আপনার হাত-মুখ উপরের দিকে আটকে রাখবে। নাসিরভাইর চোখকে কখনোই কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি। তাঁর উপর ওস্তাদি ফলাতে পারেনি।
“চোখ-কান-মগজ খাটিয়ে পয়সা বানাই। একবার দেখলেই বলতে পারি কে মাগির দালাল, কে ড্রাগ বেঁচে, কে চোর-ডাকাত গোছের। চলতে ফিরতে এখন আমি সহজেই বুঝতে পারি কে, কোন্্ কিসিমের।”

ঠেলতে ঠেলতে প্ল্যাটফর্মের একদম কিনারে চলে এসেছি। দমবন্ধ ভিড় বাড়ছে। আশায় আশায় প্রতিটা ক্ষণ গুনছে। একটা ট্রেন ঢুকেছে। ভিড়টা নড়াচড়া করছে। ভিড়টা হয়ে গেছে একটা অবিচ্ছিন্ন একক সত্ত¡া। আমরাও ভিড়ের একাংশ। ভিড়ের নড়াচড়ার সাথে আমরা একবার বামে দুলছি, আর একবার ডান দিকে – বগীর দরজাটা ঠিক কোন্্ দাগে একদম থামবে? একেবারে থামার আগেই শুরু হয়ে গেল হট্টগোল – ফুটবল খেলার সময় বল নিয়ে দু’দলের খেলোয়ারদের মধ্যে যেমন তালগোল লেগে যায়। লোকজনের চোখ-মুখে লড়াকু, হিং¯্র, মরিয়াভাব। সুযোগ বুঝে আমি দরজার একটা হ্যান্ডেল ধরে হ্যাচ্্কা টানে বগীর ভিতরে উঠে গেছি।

“খুশি হওয়ার কিছু নেই, সাব! আসল ভিড় তো শুরুই হয় নি,” ডলা খেয়ে ভিতরে ঢুকে পড়াতে নাসিরভাই হাসতে হাসতে বললেন,“আসুন, আমার পাশে পাশে থাকুন।”
বগীর ভিতরটা বড়সর, চওড়া। তারপরও, নাসিরভাইয়ের কথামতো একদম কাছে থেকে অনুসরণ করছি। সামনে যেতে গিয়ে দু’ সিটের মাঝখানে দাঁড়ানো লোকজনের ঘাম, গরম গায়ে ঘষা লাগছে। উপায় নেই।

ট্রেনের অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই, কংকালসার। মনে হয় না, যাত্রী নেয়ার জন্য বানানোর হয়েছিল। সামান্য আরাম-আয়েশের চিহ্ন নেই। লোহার মেঝে, লোহার দে’য়াল, জোড়া করে মুখোমুখি বসানো লোহার বেঞ্চ। জানালায় লোহার রড। দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের জন্য মাথার উপর ঝুলছে শ’য়ে শ’য়ে হ্যান্ডেল। সুযোগ পেয়ে দু’জানালার মাঝখানের দে’য়ালে নাসিরভাই আমাকে ঠেলে দিলেন। জায়গাটা ছিল তাঁরই। আমার সুবিধার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।
জায়গাটা গরমে অসম্ভব তেঁতে আছে। একটা নাজুক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি – আমার পশ্চাদ্দেশ অন্য যাত্রীর মুখ বরাবর, সামনের উরুসন্ধি আর এক যাত্রীর নাকের কাছে, আমার এক পাশ বগীর দে’য়ালে ঠেকানো – কেউ আর আমার পকেট মারতে পারবে না। কাছের জানালা দিয়ে হু হু করে টাটকা বাতাস ঢুকছে। নাসিরভাইয়ের চোখে-মুখে যুদ্ধ জয়ের আভা।
মুম্বাইয়ের ভিতর দিয়ে ট্রেন ছুটছে। উত্তরের শহরতলীর দিকে। কয়েক মিনিট পর পরই থামছে; বিরতিহীন ভিড়ের জোয়ার আছড়ে পড়ে বগীর দরজাগুলিতে। ভিক্ষুকের এক বিশাল বহরও উঠেছে। ভীড়ের মধ্যেই ঠেলেঠুলে করুণার আশায় ঘুরছে। তারমধ্যে একটু ব্যতিক্রম, ধারালো চেহারার এক ভিখারি – গায়ের রং লাল-বাদামী, মেহগনী রংয়ের কাছাকাছি। কপালে সিকি আকারের লাল টিপ, নাকে সোনার নথ, বেনী করা লম্বা চুলে গাঁদা ফুল। পরনে গাঢ় সোনালী শাড়ি। নাসিরভাইয়ের দেখাদেখি আমিও খুচরা পয়সা দিলাম। আমাদের কপাল ছুঁইয়ে দোয়া করছে। মেয়ে বা মহিলার মধ্যে অসাধারণ কিছু একটা বৈচিত্রময় সৌন্দর্য্য চোখে পড়ে।

“সে মেয়েও না, পুরুষও না – হিজরা,” নাসিরভাই ভুল ভেঙ্গে দিলেন।
ছোট একটা মেয়ে এক লোকের সাথে ভিড় ঠেলে আমাদের কাছাকাছি পাশের বেঞ্চের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হাঁপিয়ে গেছে বেচারী। বেঞ্চের কিনারে বসা এক লোকের কাঁধে নাসির টোকা দিলেন। পাত্তা দেয়ার গরজ দেখাল না। এবার কাঁধে একটু জোরে খোঁচা দিয়ে লোকটাকে হাতের ইশারায় বেঞ্চে চেপে বসতে বললেন। বৈদ্যের ওষুধে কাজ দিয়েছে! নাসিরভাইয়ের চোখে কিছু একটা ছিল – তাঁর সাথে পাল্লা বা মাস্তানী ফলানো মানে সাধ করে কপালে বিপদ ডেকে আনা। ট্যাঁ ফো না করে মানে মানে লোকটা একটু চেপে বসেছে। তার দেখাদেখি পাশে বসা মহিলা একটু চেপেছে। সাথে সাথে বেঞ্চের সবাই কেঁচোর মতো মুচড়ে একটু কষে বসেছে। বেঞ্চে ইঞ্চি ছয়েক জায়গা পয়দা হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার বসার জন্য যথেষ্ট!!

‘দাদার’ ষ্টেশনের কাছাকাছি ট্রেন চলে এসেছে। আমাদের আবার দরজার দিকে যেতে হবে। নাসিরভাই আমাকে শক্ত করে ধরে বগীর দে’য়াল ঘেঁষে রাখতে চেষ্টা করছেন। দরজার দিকে মরণঘাতী ভিড় বেড়ে গেছে। দরজাগুলি প্রায় খোলা, চলন্ত অবস্থাতেই লোকজনও ঝুলতে শুরু করেছে।
“তৈরি থাকুন,” নাসিরভাই সঙ্কেত দিলেন।
প্ল্যাটফর্মের কাছাকাছি আসাতে ট্রেন খুব আস্তে আস্তে চলছে। বাইরে দাঁড়ানো লোকজন দরজা বরাবর ছুটছে। কেউ কেউ হ্যান্ডেল পাকড়াও করে এরইমধ্যে ঝুলছে। কিন্তু, উপরে ওঠার উপায় নেই। দরজার মুখে, আমরা ভিতরে জটলা করে একদম টাইট হয়ে আছি – আমাদের নামতে হবে! ট্রেন একেবারে থামে নি। তারপরও, বগীর ভিতর থেকে নামার জন্য মরণ ধাক্কা। টিকতে না পেরে বাদামের খোঁসার মতো কংক্রিটের উপর ছিটকে পড়েছি।
“আমার এক বন্ধুর,” নাসিরভাই বলছেন,“খইনী খাওয়ার অভ্যাস ছিল। মুখ ভর্তি পিক। ফেলতে গিয়ে জানালা দিয়ে মুখ বের করেছে মাত্র। লাইন বরাবর পাশের খুঁটিতে ধড়াম করে মাথায় বাড়ি। ব্যস, ওটাই ছিল ওর শেষ পিক্্ ফেলা। মাথা একেবারে ভর্তা।”
লাইন বদলাতে ওভারহেড ব্রিজ, সিঁড়ি ভেঙ্গে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাচ্ছি। ব্রিজও লোকে-লোকরন্য।

ব্রিজ পার হবার সময় নাসিরভাই বিকৃত রুচির একটা নমুনা বলছেন:
“কিছু কিছু ছেলে-ছোক্্ড়া থেকে শুরু করে বুইড়া ভামরা পর্যন্ত প্রায়ই ব্রিজের মধ্যে বেহুদাই বার বার ওঠা-নামা করবে। জানেন, কোন্্ কারণে? ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের শরীর টেপার আশায়। বদ মতলব নিয়ে এই খবিশগুলি দশ-পনের বার ব্রিজ দিয়ে ওঠে-নামে। শুনলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিছু করার উপায় নেই। বেচারী মেয়েরা! পরিস্থিতিতে পড়ে চরম লাঞ্ছনার শিকার হয়। কেউ কেউ ধর্ষণের শিকার হয়। জীবন বড় নিষ্ঠুর। ভারতে বেশ্যাপল্লী না থাকলে মেয়েরা ঘরের বাইরে বেড়িয়ে মান-সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতো না।”

আবার আর একটা ট্রেনে উঠলাম। এবার, ইচ্ছে করে খোলা দরজার কাছাকাছি ঘাঁটি গেড়েছি।
“ট্রেন চলন্ত অবস্থায় বাইরের দিকে ঝুলে থাকাটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। মরণ ডেকে আনতে পারে” – একটা সর্তকবানী লেখা চোখে পড়ছে। ভিড়টাকে যদি অসীম সমুদ্রের সাথে তুলনা করি তাহলে বলতে হয় – সমুদ্রকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি সে যেন ফুঁটো নৌকায় পানি না ঢোকায়।
সতর্কবানী দেখার পর ইচ্ছে করেই দরজা দিয়ে মুখ বের করে দিয়েছি। পিঠের উপর বিরামহীন চাপ বাড়ছে। চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে দরজা দিয়ে ছিটকে পড়া ঠেকাতে আমাকেও শরীর শক্ত করে রাখতে হয়।

আমার মুখ-কাঁধ বৈদ্যুতিক তারের খাম্বাগুলি থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি তফাতে। বিদ্যুৎ বেগে পিছলে যায়। লাইনের দু’দিকে বস্তি, ভাঙ্গা-ঝুরঝুরে দালান। দে’য়াল ছত্রাকে কালো, স্যানিটারি পাইপে জং ধরা ফুঁটো দিয়ে সমানে ময়লা পানি গড়িয়ে নামছে। প্লাষ্টিকের পর্দা, দড়ি-দড়া আর পুরানো টায়ারের গোজামিল দিয়ে ওঠানো বস্তিগুলি ট্রেনের বেমক্কা বাতাসে ফরফর করে।
ট্রেন থেকে মাত্র দু’ফুট দূরে চারপাইয়ের উপর মহিলা, পুরুষ শুয়ে-বসে গরমে ঝিমোয়। খোলা চ‚লায় পরিবারে রান্না-বান্নার ডেক্চি।
‘থানে’ ষ্টেশনের ষ্টেশনমাষ্টারের অফিসের বাইরে এল্যূমিনিয়ামের দু’টা ষ্ট্রেচার দে’য়ালে হেলান দে’য়া। হাজার ব্যবহারে জায়গায় জায়গায় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।
“এই ষ্টেশনের সাত কিলোমিটার মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে দশজন নিহত হয়,” কান্দিভালি’র ডেপুটি ষ্টেশনমাষ্টার, মিলিন্দ সাল্ক জানালেন। কথা বলার সময় ভারতীয়দের চিরাচরিত কায়দায় কাঁধ-মাথা ঝুলতে থাকে। তাঁর চেয়ারের পিছনের দে’য়ালে হাতে লেখা একটা বিশাল বোর্ড:
কান্দিভালির আশেপাশের হাসপাতাল এবং বিভাগের নাম, ঠিকানার তালিকা।
কোনো চমক বা বিস্ময় নেই। ভাবলেষহীন গলায় বললেন, এই আজকেই মোট তিনটা দুর্ঘটনা হয়েছে।
ষ্টেশন থেকে একটু দূরে এক লোক ট্রেন আসার ঠিক আগ মুহুর্তে লাইনের উপর শুয়ে পড়ে – আত্মহত্যা।

গত রাত ১ টার দিকে। এখন থেকে প্রায় নয় ঘন্টা আগে পশ্চিম লাইনের শেষ ট্রেনটা কান্দিভেলি ষ্টেশনে ঢুকছে। ৫৫ বছরের এক হতভাগা লাইন পার হতে গিয়ে সামনে পড়ে যায়। সাথে সাথে দু’টুকরা। (চলবে)