Home কলাম উন্মাদ এক্সপ্রেস

উন্মাদ এক্সপ্রেস

মূল: কার্ল হফ্ম্যান – ভাষান্তরে: সেলিম হিমাদ্রি
sheemadri@gmail.com

গৌরচন্দ্রিকা
সবে তো মাত্র শুরু

কার্ল হফ্ম্যান আমেরিকার একজন ভ্রাম্যমান সাংবাদিক। আফ্রিকার কঙ্গোতে একটা প্রতিবেদন করতে গিয়ে ওখানকার আভ্যন্তরীণ প্লেনে চড়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়। তারপর, ঝোঁকের বসে তৃতীয় বিশে^র তাবত গণপরিবহণগুলোর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র তুলে ধরতে পরিবার-পরিজন ফেলে ঘর ছাড়েন। সেই সুবাদে কিউবা থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা হয়ে এশিয়ার কয়েকটা দেশে ঘুরে বেড়ান। সব দেশের সাধারণ জনগণ প্রিয়জনের টানে, জীবিকার সন্ধানে ন্যূনতম নিশ্চয়তার কথা ভুলে মারাত্মক, বিপজ্জনক এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ বাস-ট্রাক-লঞ্চ-হাওয়াই জাহাজে চড়তে বাধ্য হয়। কার্লও সবার মতো একই যানবাহনে চড়ে এক চরম অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে নিতে বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। সদরঘাট থেকে রকেট ইষ্টিমারে করে খুলনায় গিয়ে কয়েকদিন ঘুরেছেন। লঞ্চে করে চাঁদপুরে যাবার পথে ফেরদৌসের সাথে পরিচয় হয়। বাংলাদেশিদের আতিথেয়তায় অভাবনীয়ভাবে মুগ্ধ হয়ে যান। সব অভিজ্ঞতার ফসল একত্র করে ‘লুনাটিক এক্সপ্রেজ’ বইটায় তুলে ধরেন। আমার অক্ষম হাতের অনুবাদে আপনাদের সাথে তাঁর অভিজ্ঞতাটা ভাগ করতে নাম দিয়েছি – ‘উন্মাদ এক্সপ্রেস’! তা’হলে চলুন, কার্ল ভাইয়ের সাথে আমরাও ফেরদৌসের উঠোনে জিরিয়ে নেই, একটু ডাল-ভাত খেয়ে আতিথ্যের স্বাদ নেই। পৃথিবীটা একটু অন্য চোখে দেখি, ঘুরে আসি….

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
গত দশকে দু’ দু’বার, ২০০০ এবং ২০০৪ সালে, আম্বনে ধর্মীয় গোরামীর কারণে মুসলমান-খৃষ্টানদের মধ্যে প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। হাজার হাজার লোক বিনা কারণে প্রাণ হারায়। জাহাজের অনেকেই বার বার বারণ করেছে আম্বন যেতে। ঘাটের কাছাকাছি যেতে বেশ লম্বা, সরু উপক‚ল ঘেঁষে জাহাজ চলছে। দু’ পাশের পাহাড়ের উপর লাল টাইলের বাড়ি-ঘর। সবুজ, স্বচ্ছ শান্ত পানি, ছোট ঠোঁটের চকচকে রুপালী-ধূসর ডলফিন ন্যূডলের ফোমকাপ, প্লাষ্টিক, বোতলে ছাওয়া পানির ভিতর থেকে ছিটকে ওঠে। জাল ফেলা সাড়ি সাড়ি নৌকা।

প্রচন্ড গরম এবং আদ্রতার মাঝে জাহাজ আমাদের নিয়ে ‘কোটা আম্বন’ ঘাটে ভিড়েছে। অগোছালোভাবে বানানো ঝুরঝুরে একতলা/দু’তলা কয়েকটা দালান ঘাটের কাছে। ঝং ধরা টিনের চাল। তারচেয়ে ঝং ধরা ছোট ছোট ট্রলার এবং জোড়া পালের নৌকা ঘাটে ভিড়ানো।
বিদায় বেলার গোছগাছ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়। অতিরিক্ত কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয় না। ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে ঘাটের ভীরের মধ্যে হারিয়ে যাবার সাথে সাথে ট্যাক্সি অজানা রাস্তা থেকে তুলে নিল।

এরিষ্টটল মোজে নামের এক লোকের সাথে হোটেলের বাইরে পরিচয় হয়েছে। সুঠামদেহী, লম্বাচুলের এরিষ্টটল আসপাশটা ঘুরে দেখাবার প্রস্তাব দিল। ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম প্রধান দেশ। আম্বনকে রাজধানী করে মলুক্কা দ্বীপ ছাড়াও আরও কয়েকটা দ্বীপে মুসলিম এবং খৃষ্টান জনসংখ্যার অনুপাত প্রায় আধাআধি।

দাঙ্গা লাগার মূল কারণগুলি অল্পবিস্তর জানি – এক বিকাল বেলা হঠাত করে দাঙ্গা বেধে যায়। আগুন দেয়া, লুটপাট, খুন-খারাবী চলতে থাকে মাসের পর মাস। প্রত্যক্ষদর্শী বা ভুক্তভোগীর থেকে শুনতে চাই, বিস্তারিত জানতে চাই। এরিষ্টটল খৃষ্টান – ঘটনার ব্যাপারে তার কী ভাবনা বা কেমন করে দিনগুলি কেটেছে শুনতে চাই। মুসলিম-খৃষ্টান, দুই আলাদা বিশ্বাসের মানুষজন যুগ যুগ ধরে এক পাড়ায় থেকেছে, একসাথে বড় হয়েছে। অথচ, একদিন এক অন্ধ ক্রোধ নিয়ে একে অন্যের উপর নির্দয়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিনাশ করতে পিছপা হয়নি।

প্রথম দেখায় আম্বনকে তৃতীয় বিশ্বের অন্য যে কোনো ছোট্ট শহর থেকে আলাদা মনে হয়নি। কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর, বৈচিত্র্যে ভরা। রাস্তা-ঘাট, অলি-গলি, ভাঙ্গাচোরা, খোলা নর্দমা। রিক্সা-সাইকেল-ভ্যান সরু রাস্তা দখল করে আছে। হোটেল-রেস্তোরায় মুরগী, শুকর, মাছ ঝলসানো চলছে। দোকান ভর্তি হাঁড়ি-পাতিল, রেফ্রিজারেটর, ষ্টোভ। ফেরিওয়ালাদের হাতে চা-কফি, ন্যূডল বাক্্সো।

এরিষ্টটল দেখছে ভিন্ন মাপে। শহরটা কোনো এক অদৃশ্য দে’য়ালের কারণে বিভক্ত।
“শহরের এই অংশটা মুসলিমদের দখলে,” একটা জায়গা পার হবার পর এরিষ্টটল বলল। সে না বললে বুঝতে পারতাম না। একটা লাল পতাকা উড়ছে – বিভক্তির চিহ্ন। এছাড়া, আমার চোখে আম্বন শহরের কোনো পার্থক্য ধরা পড়ছে না। ইন্দোনেশিয়ার যে কোনো শহরে অসমাপ্ত দালানকোঠার অভাব নেই। এরিষ্টটল আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দে’য়ার পর বুঝতে পারলাম – আম্বনের অনেক দোকান-পাট, দালান-কোঠায় আগুনের পোঁড়া কালো দাগ। দেয়ালে দেয়ালে বুলেটের গর্ত। হাজার হাজার বুলেটের গর্ত।

“বাড়িতে বসেছিলাম,” এরিষ্টটল স্মৃতিচারণ করছে, “এক প্রতিবেশি এসে বলল, লোকজন দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু করেছে। শোনা মাত্র রাস্তায় এসে দেখি মুসলমানরা খৃষ্টানদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল মারছে। খৃষ্টানরাও পাল্টা ইট-পাটকেল মারছে। কয়েক শ’ লোক রাস্তায়। পুলিশ আসা মাত্র সব ভেগেছে।”
“সামনের ওই বিল্ডিংটা দেখছেন,” পোঁড়া, ভাঙাচোরা, খালি চার-তলা একটা দালান দেখিয়ে বলল, “খৃষ্টান লোকজন থাকতো। মুসলমানরা আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।”
আর একটা এমন আগুনে পোঁড়া দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। নিচ তলায় কম্প্যূটার স্কুল, উপরের তলায় এপার্টমেন্ট ছিল।
“জান বাঁচাতে লোকজন দৌঁড়ে উপরের তলায় আশ্রয় নিয়েছিল। মুসলমানরা মানুষজন সহ বিল্ডিংয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সবাইকে পুঁড়িয়ে মারে।”
দাঙ্গা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। টানা কয়েক সপ্তাহ পুরোদমে চলতে থাকে। এরিষ্টটল জানালো, “সেই সময় জাহাজ আম্বনে আসতো না। চাল জোগার করা খুব মুশকিল ছিল। ভাত ফুটানোর জন্য কেরোসিন তেল পাওয়া যেত না। কোনো কাজ খুঁজে পাইনি, কেউই কোনো কাজ-কারবার করতে পারতো না।”

“লোকজন অকাতরে একে অন্যকে খুন করছে। আমার বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ ফুট দূরে মুসলিমদের এলাকা। তারা আক্রমণ করলে আমরাও গুলি ছুড়তাম। সব সময় সতর্ক থাকতে হতো। রান্না করতে কেরোসিন যেমন করেই হোক যোগার করতে হবে। বাধ্য হয়ে একদিন পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে কেরোসিনের খোঁজে বের হয়েছি। আমাকে অন্য পক্ষ দেখে ফেলার সাথে সাথে গুলি ছুড়তে শুরু করে। সবার কাছে বন্দুক-পিস্তল। এখানে টিকতে না পেরে আমার গ্রামের বাড়ি ‘বাবার’ দ্বীপে পালিয়ে যাই। ওখানে ৬ মাস কাটিয়ে দেই।”
কিন্তু, কেন হঠাত করে এমন দাঙ্গা শুরু হলো? কিভাবে শুরু হলো? কোন্্ কারণে প্রতিবেশীর একে অন্যকে আক্রমণ করেছে, আগুনে পুঁড়িয়ে মেরেছে?

“কিছু উস্কানিদাতাদের মদত,” এরিষ্টটল পিছনের ঘটনা বলছে, “জাকার্তা থেকে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ভাড়া করা কিছু লোককে আক্রমণ করতে বলা হয়। চার্চ ছাড়াও মসজিদে পর্যন্ত আগুন দিতে নির্দেশ দেয়। আমরা এখনও জানি না কারা এই দাঙ্গার ষড়যন্ত্র করে। একমাত্র আল্লাহ্ জানেন তাদের নাম-ঠিকানা।”
এরিষ্টটলের কথায় কিছুটা সত্যতা আছে। মলুক্কার জনগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করে আসছিল। ২০০০ সনের দিকে ইন্দোনেশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে ‘আরএমএস (RMS)’- রিপাবলিক অব্্ দ্য সাউথ মলুক্কাস নামের রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতারা চেয়েছিল আম্বন থেকে সব মুসলিমদের খেদিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। তারপরও, এই বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা আমি মেনে নিতে পারলাম না। কেউ যদি আমাকে পৃথিবীর তাবত টাকা দিয়ে বলে আমার প্রতিবেশীর বাড়ি-ঘরে আগুন দিতে তারপরও রাজি হবো না।
আমি যদি খুব গরীব হতাম তাহলে কি আমি আগুন দিতাম? ভাবছি।
আগুন দেয়ার আগে মনের গহীনে কোনো না কোনো কারণে অন্যের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং শত্রæতা পুষতে হয় যা জ্বালানী হিসেবে কাজ করবে। স্ফুলিঙ্গের কাজ করবে।
আমার ভাবনা-যুক্তিগুলি এক এক করে এরিষ্টটলকে বললাম। আমাকে সুস্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করুক – অন্য ধর্মের পাড়া-পড়শীর উপর এই রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা বা শত্রুতার শুরু কোথায় এবং আসল কারণ কী কী।
এরিষ্টটল হয় এড়িয়ে যেতে চায় অথবা আমার ভাবনা-যুক্তিগুলির আসল মাহাত্ম্য একদমই বুঝতে পারেনি।

“আমরা কোনোমতেই দাঙ্গায় জড়াতে চাইনি,” এরিষ্টটলের উত্তর, “কে বা কারা যেন সাধারণ লোকজনের হাতে টাকা, গোলা-বারুদ-বন্দুক তুলে দিয়েছিল।”
আবার হাঁটতে শুরু করলাম। সামনের চার্চটা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওই মসজিদটাও আগুনে পুড়ে ছাই। কাছের বাড়ি-ঘরগুলিও আগুনে শেষ।
“দাঙ্গার আগে আমরা সবাই একে অপরের কাছাকাছি ছিলাম,” তার ফেলে আসা দিনের ভালো স্মৃতিগুলি মনে পড়ে গেছে,“আমরা কেউই আলাদা ছিলাম না। ভেদাভেদ ছিল না। আর এখন, আমরা একদম আলাদা হয়ে গেছি। আমরা আমাদের মহল্লায় থাকি। ওরা ওদের মহল্লায় থাকে।”
জাহাজ-ঘাটায় হাঁটতে হাঁটতে জাতিগত দাঙ্গার মূল রহস্যটা বুঝতে চেষ্টা করছি। ঠুঁনকো এক বিদ্বেষভাব থেকে কিভাবে সহজে প্রতিবেশীদের মাঝে প্রতিহিংসা জ্বলে ওঠে?
হাঁটতে গিয়ে একটা ব্যাপার চোখে পড়েছে যেটা সিগুন্টাং ঘাটে ভেরার সময় লক্ষ্য করি নি। কাঠের তৈরি কয়েক ডজন ফেরি। নৌকাগুলির বেশ বয়স হয়ে গেছে। সিগুন্টাং থেকে আকারে অনেক ছোট।
“এই ফেরিগুলি কোথায় যায়?” জানতে চাইলাম। এরিষ্টটল কিছু না বলে কাঁধ ঝাকালো।
“চলুন খোঁজ নিয়ে দেখি,” উত্সাহের সাথে বললাম।
কংক্রিটের ঢাল বেয়ে নিচে নামার পর খুব অভিভ‚ত হয়ে গেলাম। ৪০, ৬০, ৮০ ফুটের একেকটা ফেরি। পাতলা থেকে শুরু করে ভারি, মোটা কাঠ এবং মরচে ধরা লোহার পাত দিয়ে সবগুলি বানানো। এরিষ্টটল একটার প্রধান মাল্লার খোঁজ করছে। ‘আম্বোইনা ষ্টার’ ফেরির ডেকে তেল-মবিলে মাখামাখি হাফপ্যান্ট, রং চটা টিশার্টে প্রধান মাল্লা-কাম-ইঞ্জিনিয়ার।
খবরা-খবর নিতে এরিষ্টটলকে আমি ইংরেজিতে বলছি, সে অনুবাদকের কাজ করছে। আমি প্রশ্ন করার সময় প্রতিবারই ফেরির চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমার দিকে কেমন যেন অদ্ভ‚ত চোখে তাঁকায়। ‘বুরু’ দ্বীপের দু’ গ্রাম (লামব্রুলে এবং লেকসূলা)-’র দিকে আগামীকাল বিকালের দিকে রওনা হবেন। যেতে লাগবে প্রায় ১৮ ঘন্টা। ইচ্ছে করলে আমি তার ফেরিতে করে যেতে পারি। কাল ঠিক ৫টার মধ্যে ফেরিতে উঠতে হবে।
‘বুরু’? আমার গাইডবই বের করে দ্বীপটার ব্যাপারে খুঁজছি, এক ছত্রের বেশি কোনো তথ্য নেই: এখানে একটা জেলখানা এক সময় ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক কর্মীদের রাখার কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। (চলবে)

Exit mobile version