হিমাদ্রী রয় : জীবনে চলার পথে কতজনই তো আত্মীয় হয়ে উঠে কিন্তু আপন হয়ে উঠে না অনেকেই। আবার আমাদের পাশের লোকটিকে আপন ভাবতে পারি না অথচ দূরের চাঁদ যেন আপনার চেয়ে আপনজন। ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো ও রজনী গন্ধা তোমার গন্ধ সুধা ঢালো’।
অভিবাসী জীবনে চাঁদের হাসিতে খুশির বাঁধভাঙা জোয়ার আসে চাঁদ রাতে আমার শহরের ড্যানফোর্থ এর এক টুকরো বাংলাদেশে। আমি দেখি এখানে চাঁদ রাতে বিভেদ-বেদনা ভেসে যায় পথের বাতাসে। আমাদের রাইধা ফাইরুজ মিষ্টির হেনা ঐ আধখানা রুপালী চাঁদের কাব্য এঁকে দেয় হাতে হাতে। রাত বাড়ে জনাকীর্ণ ড্যানফোর্থ ফুরায় জীবনের সব লেনদেন শুধু জেগে থাকে আনন্দের হাট আমিও তার খরিদ্দার; আমার প্রভুর দেয়া প্রেমের কড়িতে আনন্দ কেনার পাওনা মেটাই।
যে চাঁদ এক মাস সিয়াম সাধনার পুরস্কার, সেই একই চাঁদে অন্য কোন তিথিতে পূর্ণিমা রাতে বৃক্ষের নিচে বুদ্ধ পেয়েছিলেন বোধিসত্ত¡, সেই চাঁদ পাঁচশত বছর পূর্বে নেমে এসেছিলো নদীয়ায় সচীর আঙিনায়। বাবাকে মনে পড়ে যায় বাবা গাইতেন ‘প্রভাত সময়ে সচীর আঙিনায় গোরাচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে’। পুত্র শোকেও চাঁদকে উপেক্ষা করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ ‘আমারে যে জাগতে হবে কি জানি সে আসবে কবে যদি আমায় পড়ে তাহার মনে আজ জোছনা রাতে’। চাঁদের কোন দেশ নেই, গোত্র নেই। চাঁদের ভাষা প্রেম আর ধর্ম স¤প্রীতি।
চাঁদে বড় দুঃখগুলো না চাইলেও জমা হয়ে যায় চাইলেই ছুঁয়ে দেখা যায়। মরণ ঘুমে আচ্ছন্ন পৃথিবীর বিগত দুইটি বছরে দেখাদেখি বারণ থাকলেও এক মাস সিয়াম সাধনার পর চাঁদটাই একমাত্র খুশির কারণ ছিলো। সমাগম না হলেও সবাই ছাঁদে কিংবা বারান্দায় মায়ের সাথে চাঁদের রাতে খুশি ভাগাভাগি করেছেন। এবারের ঈদের চাঁদ হয়তো অনেকের দুঃখ পুকুরে উছলে পড়বে, জলধারা হয়ে ঠাঁই নেবে টলমল মনের পর মনে; যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন গেল ঈদের পরে। তাই এবারের ঈদের চাঁদ তাদের কাছে ‘বাঁশ বাগানে মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ মাগো আমার শোলক বলার কাজলা দিদি কই’।
হতে পারে আমার চাঁদ দেখার রেওয়াজ ভিন্ন তবে আমার ঘরের চাঁদমুখ আমার মা এখন আকাশের গায় বাবাও আছেন কোন এক তারায়। সেই অনুভূতি থেকে বুঝতে পারি আমার প্রিয়জনেরা অন্তত যাদের খবর জানি রিফাত, রিমি, মাথার উপরে আশীর্বাদের হাত ভাবী ইশাত আরা মেরুনা অতিস¤প্রতি কেউ হয়েছেন মাতৃহারা কেউ পিতৃহারা। আরো কত স্বজন হারিয়েছেন প্রিয়জন। করোনার মধ্যে গেলো বছর ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে অভিভাবক কবি দেলওয়ার এলাহী বলেছিলেন ‘তোমারেও শুভেচ্ছা হিমাদ্রী সবাই ভালো আছি দেশো আম্মাও ভালো আছইন, ফোনে জিগাইছি আম্মা চাঁন দ্যাখছো তাইনও দেখছইন’। আর এবার? হয়তো নয় আমি নিশ্চিত আজ চাঁদ রাতে হাজার মানুষ যখন ঈদের চাঁদ দেখবে, আমার প্রিয় মুখগুলো এবং কবি দেলওয়ার এলাহী সবাই এক আকাশের এক চাঁদের বুকে বড় দুঃখ গুলো ছুঁয়ে বলবে আম্মা কিংবা আব্বা তোমারে দেখছি।
দেয়ালটা জিজ্ঞেস করবে ‘তুমি কি কেবল ছবি’ আর অন্তরের ঈশ্বর বলে উঠবেন ‘তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে’ ঝড়ের মতো খুশির দামামা বাজিয়ে জাগিয়ে তুলবে বুকের মধ্যে ঝাকড়া চুলের ক্ষ্যাপা অথচ স্নিগ্ধ মায়াময় প্রেম দিতে আর প্রেম পেতে
‘আপনাকে তুই বিলিয়ে দে আজ
আসমানী তাগিদ
ও মোর রমজানের ঐ রোজার শেষে’।