মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী : আদর্শ সমাজের লেন-দেনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল পারস্পরিক হাদিয়া-তোহফা আদান-প্রদান।
নবীজি (সা.) এর প্রতি খুব উৎসাহিত করেছেন। হেকমত হল, এর দ্বারা অন্তরে মহব্বত ভালোবাসা তৈরি হয়। সম্পর্ক দৃঢ় হয়। যেটি দুনিয়ার জীবনে অনেক বড় নিয়ামত। অ
নেক বিপৎ-মুসিবত থেকে হেফাজতের মাধ্যম। শান্তি-নিরাপত্তা লাভের খুব সহায়ক।
হাদিয়া হল যা অন্য কাউকে খুশি করা এবং তার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ভালো প্রকাশ করার জন্য দেয়া হয়। আর এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য থাকে। এই হাদিয়াটা ছোট কাউকে দেয়া হলে নিজের আদর-স্নেহ প্রকাশ করা হয়।
বন্ধু-বান্ধবকে দেয়া হলে সেটা হয় মহব্বত-ভালোবাসা বৃদ্ধির মাধ্যম। অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়া হলে খেদমত করার মাধ্যমে তার মনতুষ্টি অর্জন হয়। আর কোনো বুজুর্গ আল্লাহওয়ালা সম্মানিত ব্যক্তিকে দেয়া হলে সেটা হবে তার সম্মানের জন্য।
কোনো প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সওয়াবের নিয়তে দেয়া হলে সেটা হাদিয়া হবে না। সদকা হবে। হাদিয়া তখনই হবে যখন এর দ্বারা মহব্বত-ভালোবাসার প্রকাশ উদ্দেশ্য থাকবে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কাঙ্ক্ষিত হবে।
একনিষ্ঠতার সঙ্গে হাদিয়া দেয়া হলে এর সওয়াব দান-সদকা থেকে কম নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি। হাদিয়া এবং দানের পার্থক্যের ফলাফল হল, রাসূল (সা.) হাদিয়া গ্রহণ করতেন। নিজেও ব্যবহার করতেন। সদকা গ্রহণ করতেন তবে নিজে ব্যবহার করতেন না। অন্যদেরকে দিয়ে দিতেন।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হল, সমাজজীবনে পারস্পরিক একনিষ্ঠতাপূর্ণ লেন-দেনের প্রচলন খুবই কমে গেছে। কিছু কিছু বিশেষ মহলে বুজুর্গ, আলেম, পীরদেরকে হাদিয়া দেয়ার প্রচলন কিছুটা আছে। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীদেরকে হাদিয়া পাঠানোর প্রচলন প্রায় শূন্যের কোঠায়।
অথচ পারস্পরিক মহব্বত-ভালোবাসা বৃদ্ধি, সমাজজীবনে শান্তি-নিরাপত্তা লাভ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য রাসূল (সা.)-এর নির্দেশিত দুর্লভ কৌশল এটি।
হাদিয়া দেয়ার ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তাদের সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করে, অতঃপর খোটা বা তুলনা দিয়ে এবং কষ্ট দিয়ে তার অনুগমন করে না। তাদের জন্য রবের কাছে রয়েছে তাদের বিনিময়, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৬২)
হাদিয়া ব্যবহার করতে নিষেধ নেই। এ মর্মে আল্লাহ বলেন, ‘তারা যদি খুশি হয়ে তোমাদেরকে দিয়ে দেয়, তাহলে তোমরা তা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ কর।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৪)
হাদিয়া ভালোবাসা বৃদ্ধির মাধ্যম
নবীজি (সা.) বলেন, ‘রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পর হাদিয়া আদান-প্রদান কর, তাহলে মহব্বত বৃদ্ধি পাবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৫৯৪)
হিংসা দূর করার উপায় হাদিয়া
রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় কর এর দ্বারা অন্তরের সঙ্কীর্ণতা ও হিংসা দূর হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৯২৫০)
হাদিয়ার বিনিময়ে হাদিয়া
হাদিয়া দেয়ার ব্যাপারে নবীজি (সা.) এর কর্মনীতি এবং নির্দেশনা রয়েছেন। নবীজি (সা.)কে কেউ হাদিয়া দিলে তিনি গ্রহণ করতেন।
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) এর নিয়ম ছিল তিনি হাদিয়া গ্রহণ করতেন এবং এর বিনিময়ে নিজেও কিছু হাদিয়া হিসেবে দিয়ে দিতেন।’ (সহিহ বোখারি)
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘যাকে হাদিয়া দেয়া হয় যদি তার কাছে হাদিয়ার বদলে দেয়ার মতো কিছু থাকে তাহলে দিয়ে দেবে। আর যার কাছে দেয়ার মতো কিছুই থাকে না তখন সে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার প্রশংসা করে দেবে এবং তার ব্যাপারে ভালো কথা বলে দেবে। যে এমন করল সে কৃতজ্ঞতা আদায় করল। আর যে এমন করল না এবং উপকারকে গোপন করল সে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।’ (জামে তিরমিজি)
হাদিয়াদাতাকে কিছুই না দেয়ার থাকলে অন্তত জাযাকাল্লাহু খায়রান (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন) এতটুকু বললেও তার অকৃতজ্ঞতা বলে গণ্য হবে না।
অল্প হাদিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান না করা
রাসূল (সা.) বলেন, ‘হে মুসলিম রমণীগণ! তোমাদের প্রতিবেশীর জন্য সামান্য উপহার বা হাদিয়াও তুচ্ছ জ্ঞান কর না। যদিও তা বকরির পায়ের খুর হয়।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৪২৭)
নবীজি (সা.) স্পষ্টই বলেছেন, ‘আমাকে যদি (বকরির পায়ের) মাংসবিহীন চিকন হাড় খেতেও দাওয়াত করা হয়; তবু আমি সে দাওয়াত রক্ষা করব।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৫১৭৮)
অল্প জিনিস হাদিয়া দিতেও লজ্জা না করা। গ্রহণ করতেও নাক না ছিটকানো। কারণ এতে করে হাদিয়াদাতা মনে মনে কষ্ট হবে। আর এভাবে আস্তে আস্তে হাদিয়ার দ্বার বন্ধ হয়ে যাবে।
হাদিয়া দিয়ে খোটা দেয়া যাবে না
হাদিয়া দিয়ে খোটা দেয়া খুবই ভয়ঙ্কর। হাদিস শরিফে রাসূল (সা.) বলেন, ‘খোটাদানকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (সহিহ মুসলিম)
ধনী-গরিব সবাইকে হাদিয়া দেয়া
মানুষজনকে দাওয়াত করে খাবার খাওয়ানো এটিও হাদিয়ার মধ্যে গণ্য। এ ক্ষেত্রে শুধু ধনীদেরকে দাওয়াত দেয়া, আর গরিব-অসহায়দেরকে উপেক্ষা করা অত্যন্ত মন্দ।
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেছেন, ‘যে ওলিমায় শুধু ধনীদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয় আর গরিবদের বর্জন করা হয়, সে ওলিমার খাবার নিকৃষ্ট খাবার। আর যে আমন্ত্রণ রক্ষা করে না, সে তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর অবাধ্য হল।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ৫১৭৭)
কাফের-মুশরিকদের সঙ্গে হাদিয়া আদান-প্রদান
যদি কোনো কাফের মুশরিক কোনো মুসলমানকে হাদিয়া দেয় তাহলে সেটা গ্রহণ করা জায়েজ। তবে বস্তুটি ব্যবহার করার বৈধতা ইসলামে থাকতে হবে।
নবীজি (সা.) কাফেরদের পক্ষ থেকে পাঠানো হাদিয়া গ্রহণ করেছেন। এমনিভাবে কাফেরদেরকে হাদিয়া দেয়া যাবে। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার নিষেধ না হওয়ার কথা কুরআনেও উল্লেখ আছে।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বের করেনি তাদের প্রতি মহানুভতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালোবাসেন।’ (সূরা মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
তবে কাফেরদেরকে অন্তর থেকে ভালোবাসা যাবে না। যা কুরআনের অন্যান্য আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।
আল্লাহ পাক আমাদেরকে হাদিয়া আদান-প্রদানের সুন্নতটির ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ