Home কলাম ইতি ইলা

ইতি ইলা

ইউসুফ কামাল : ১.
দ্বীপ জলা সন্ধ্যায় সুর তুলে জানালায় কান্নার খাচা শুধু রেখেছি
ও পাখী সে তো আসেনি তুমি ভালোবাসোনি
স্বপ্নের জাল শুধু বুনেছি…
সম্পর্কের সুত্রপাত রাহুল দেব বর্মণের বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকা ঝড় তোলা রুবি রায়ের সেই গানটির মতো হয়তো নয়।

তবে এখানে ইলা রায় এর সাথে দেখা হতো বাস স্টপেজে নয় বরং রোজ কলেজে যাওয়ার পথে। প্রথম দিকে দূর থেকে দৃষ্টি বিনিময়ে আর নিরব ভালোবাসা নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনে যেতো দু’জনে। প্রথম দিকে কথা বলার মতো অত সাহস তখনো হয়নি কারো। হবেই বা কেমন করে একে তো মফস্বল শহর তার উপর দুজনেই তো রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য সদস্যা। ধর্মীয়ভাবে অন্য ধর্ম বলতে যা বোঝায় ইলা’র পরিবার তাই। এ ধরনের সম্পর্কের ব্যাপারে রক্ষনশীলদের চিন্তা ধারার সাথে উদার মনাদের চিন্তার বিস্তর ফারাক। সামাজিকভাবে যোজন যোজন দূরের হলে কি হবে, ভালোলাগার সাথে ওরা এ দূরত্ব নিয়ে কখনো চিন্তাই করেনি। অত শত বাঁধা ওদের কাছে কোনো বাধাই মনে হয়নি, বাধ ভাংগা ভালোলাগা ও আবেগের কাছে এগুলোর বিপক্ষে ভাবার মতো মনের গভীরতাও ওদের তখনও হয়নি। আর বাধ ভাংগা স্বপ্ন তো অধরা স্বপ্নই।

সবার জীবনেই এমন একটা সময় থাকে যখন এই সমস্ত বিধি নিষেধ কারো কাছে কোন বাধাই মনে হয় না। মনে হয় এগুলো সবই মনুষ্য সৃষ্টির বিধান, যা লঙ্ঘন করা কোন বিষয়ই নয়। পরে দুজনের মধ্যে হাল্কা কথা শুরু হয়ে গিয়েছিল, দুজনেই বুঝে গিয়েছিল দুজনই দুজনের ভালো লাগা মানুষ। যৌবনের শুরুতে ভালো লাগা সহজে ভোলা যায় না, সেটা জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বুঝতে দেরী হয়নি কারোই। একটা সময়ের হিসাব হয়ে গিয়েছিলো দু’জনের মধ্যেই। যাতে করে দু’জনে দু’জনার দৃষ্টিসীমার মধ্যেই থাকতো, আগে পিছে করে কলেজে পৌঁছার আগ পর্যন্ত পুরো রাস্তাটা। দুজন দুই বিভাগে পড়তো কিন্তু এক সাথেই ছুটির ঘন্টা বাজতো। ইলা’র বাড়ির সামনে দিয়ে সবার সাথে এক সাথেই বাড়ি ফিরতে হতো। ইলা ওর বাড়ির গেটে ঢোকার মুহূর্তে দু’জনই এক সাথে ঘুরে তাকাতো। এটা যেন একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওদের দুজনের মধ্যে।

কৈশর পেরিয়ে সবে কলেজের প্রথম জীবন, জীবনের যোগবিয়োগ এর সূ² হিসাব বোঝার মতো বয়স, বুদ্ধি কিছুই তখনো ওদের তেমন হয়নি। দুই চোখে তখন শুধুই স্বপ্ন আর কল্পনার ফানুস। ভালোলাগার বিষয়টার স্থায়ীত্বকাল খুব বেশি হলেও বছর দেড়েক এর বেশি বোধ হয় ছিলো না। ইলা’র বাবা তখন মহকুমা পর্যায়ের সরকারি বড় কর্মকর্তা, সরকারি বাসাতেই থাকতেন। কলেজের পথটাও ঐ বাসার সামনে দিয়েই, আর ইলা’র পড়ার টেবিলের সামনের জানালা দিয়ে দূর থেকেই দেখা যেত ঐ পথ দিয়ে সবার আসা যাওয়া। তাতে দূর থেকে দেখে হিসেব করে বেড়িয়ে পড়লেই দুজনের কলেজে যাবার পথে একে অন্যের দূরত্বের মধ্যে বেশি ফারাক হতো না। তখন মফস্বল শহরে রিক্সার প্রচলন খুব একটা ছিলো না, হাতে গোনা গোটা বিশেক রিকসা হয়তো তখন শহরে ছিল। তাই সবাই হেঁটেই কলেজে যাওয়া আসা করতো। পাশের বাসার ওরই সমবয়সী এক ছাত্রীও ওর সাথেই কলেজে পড়তো আর সেই ছিল ইলার কলেজের আসা যাওয়ার সাথী।

ভালোই চলছিলো হঠাত করেই যেন বিরহের সুর বেজে উঠলো গতিময় ছন্দের মধ্যে। ঈদের লম্বা ছুটির পর কলেজে যেতেই শাহেদ জানতে পারলো ইলা’র বাবা বদলী হয়ে চলে গেছে সপরিবারে। নিজ জেলা সিলেটেরই এক মহকুমা শহর মৌলভীবাজার অথবা হবিগঞ্জে পোষ্টিং নিয়ে। ঈদের ছুটির মধ্যেই ওরা চলে গেছে যে কারণে তেমন কেউই জানতে পারেনি। ওর চলে যাওয়ার দিন সাতেক পর ঈদের ছুটির শেষে কলেজ খুল্লে সবার মতো শাহেদও জানতে পারলো ইলা নেই। কয়েকটা দিন মনটা একটু বেশিই খারাপ হয়ে ছিলো তারপরও তো বাস্তবতার উপরে তো আর কিছু নেই, কয়েকদিনের মনটা কিছুটা স্থির হয়ে আসলো। বিষণ্ণ মনে কয়েকদিন ঘুরে বেড়াল, তারপর মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসলো। তারপরও ইলার বাসার দিকে চোখ পড়লেই শাহেদের মনের ভিতর একটা শূন্যতা কাজ করতো, কষ্টও লাগতো কিন্তু ঐ বয়সে এর চেয়ে বেশি আর কিই বা করতে পারতো। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেল মনের অশান্ত ভাবটা। স্মৃতিপট থেকে ইলা’র স্মৃতিও ধুসর হয়ে গেল কিছু দিনের মধ্যেই। বাস্তবতা তো এমনিই হয়।

মাঝে এসে গেলো স্বাধীনতা যুদ্ধ। আরো দূরে সরে গেলো মানুষজন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে। কে কোথায় হারিয়ে গেলো, চেনাজানা মানুষগুলো অনেকেই হারিয়ে গেলো পৃথিবীর বুক থেকে। যুদ্ধে শাহেদের নিজেরও তো পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়ে গিয়েছিলো প্রায়। ভাগ্যের জোরে কোন মতে বেঁচে গেছে, হয়তো জীবনের বাকী সময়টা দেখে যেতে হবে তাই। পৃথিবী চলমান তাই হয়তো আবার দেখা হয়ে গেল শাহেদের সাথে কয়েক বছর পরে। বলতে হবে ভাগ্যে লেখা ছিল, হয়তো তাই। শাহেদ বন্ধুদের সাথে বিকেলে কলেজ রেস্টুরেন্ট এ প্রাত্যাহিক আড্ডা শেষে নিউ মার্কেটে ঘুরছিলো। পিছন থেকে মেয়েলী কন্ঠে কে যেন নাম ধরে ডাকলো, অবাক হয়ে ফিরে এগিয়ে যেতেই চিনলো ইলা’কে। তার মানে ইলা তাহলে ওর নাম টাও ভোলেনি। শাহেদ বিস্মিত হয়ে চিন্তা করলো ও কি তাহলে ঢাকাতেই থাকে? ঘটনায় কেমন যেন হতভম্ব হয়ে পড়লো শাহেদ। কত বছর হবে? পাঁচ বছরের মতো মনে হয়, কিন্তু মনে হোল যেন একযুগ পরে দেখা হোল। সাথে ওর মা আর ছোট বোন। অল্প কথা হলো, ইস্কাটনের সরকারি বাসায় থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিওলজী ডিপার্টমেন্টে পড়ে। একটু খেয়াল করে দেখলো, তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি ওর মধ্যে, তবে সেই গোলগাল চেহারাটা একটু ভারী হয়েছে সম্ভবত বয়সের কারণেই।

শাহেদ ভাবলো আজ দূর থেকে দেখে ডেকে কথা বলছে, তার মানে পুরনো স্মৃতি তাহলে এখনো ভোলেনি। বেশ আশ্চর্যই হলো শাহেদ। মনের মধ্যে একটা সুখের অনুভুতি কাজ করা শুরু করলো। বুঝলো সময় আর পরিবেশ যে মানুষের জড়তাকে দূর করে কত সহজ করে দেয় ইলা’র কথা বলাতে সেটা আজ ওর মনে হলো। শাহেদ চিন্তা করলো ও নিজে অর্থনীতির ছাত্র। ওর ক্লাস কলা ভবনের তিন তালায় আর ইলা’র সোসিওলজী তো এক তলায়। বেশি পার্থক্য না তবুও এত দিন দেখা হলো না কেন? সারারাত ধরেই প্রায় পুরনো ভালোলাগাগুলো মাথার মধ্যে ঘুরাফেরা করলো শাহেদের। পরদিন ইচ্ছে করেই তিন তলায় উঠার আগে ভাবলো একবার ঢুঁ মারলে কেমন হয়, দেখিই না পাই কিনা? দেখা যদি হয়েই যায়, ভালোই হবে কথা বলা যাবে। কালকে ওর মায়ের সামনে তো কথা হয়নি। এদিক ওদিক তাকাতাকি করতেই নোমান এগিয়ে এলো, মহসিন হলে শাহেদের দুই রুম পরে থাকে। শাহেদকে দেখে এগিয়ে এলো, জিজ্ঞাস করলো, আরে কাউকে খুঁজছেন নাকি?
নোমানকে ইলা’র কথা বলতেই ও পাল্টা প্রশ্ন করলো, চিনেন নাকি? ওতো আমার ক্লাসমেট। হলে তো থাকে না, সময় মতো এসে ক্লাস করে আবার ক্লাস শেষে বাসায় চলে যায়। বল্লাম বাসা কোথায় জানো? নোমান সাথে সাথে মুখস্তের মতো বলে দিল, ইস্কাটনের সরকারি বাসা আশিয়ানা’য় থাকে। আমাদের ক্লাস তো এক ঘন্টা পর সাড়ে দশ’টায়, সময় মতো চলে আসবে। এলে আপনার কথা বলবো? আপনার নাম বল্লে চিনবে তো? জিজ্ঞাস্য দৃষ্টি নিয় প্রশ্ন করলো নোমান। সহাস্যে শাহেদ বললো, চিনতে পারে। শাহেদ ফিরে এলো, দেখা হলো না মনে মনে একটু আশাহতই হলো। মনে করার চেষ্টা করলো পুরনো দিনের কথাগুলো। আবার নিজেকে সংযত করে নিলো, সেই কবে কার কথা এর মধ্যে কত সময় চলে গেছে। কত রকম পরিবর্তন হয়েছে মানুষের মধ্যে। ভুলেই তো গিয়েছিলো সে, দেখা হলো বলেই না আবার কথাগুলো বেশি করে মনে হলো। এত দিনের মধ্যে অনেক কিছুই তো ঘটে যেতে পারে, জোর করে মনের লাগাম টেনে ধরলো। দেখা যাক নোমান কিছু বলে কিনা? শাহেদের অপেক্ষার প্রহর পরদিন শেষ হলো, দুপুরের দিকে নোমানের সাথে ইলা নিজেই আসলো শাহেদের সাথে দেখা করতে তিন তলায় ওর ডিপার্টমেন্টে।

ইলা নিজেই নোমানকে খুলে বল্লো শাহেদের সাথের সেই পুরনো কলেজে পড়ার সময়ের স্মৃতিগুলো। সবাই বেশ মজা করেই উপভোগ করলো হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তওগুলো। কেমন করে দুজনে সময়গুলো উপভোগ করতো, কত উচ্ছল আনন্দময় ছিলো সেই দিনগুলো। পরের দিনের প্রতিক্ষার সেই অধীর আগ্রহের কথা বলে উচ্ছল হাসিতে সবাই হাসাহাসি করলো। শাহেদ চিন্তা করলো কত সহজভাবে পুরনো ভালো লাগা গল্পগুলো অবলিলায় বলে যাচ্ছে ইলা। তখন তো চিন্তাহীন উড়ন্ত হাওয়ার মতো মধুর স্বপ্নে বিভোর ছিলো দু’জনেই, বসে থাকতো শুধুই অনাগত স্বর্ণালী দিনগুলোর প্রতীক্ষায়। গল্পের শেষ মুহুর্তের ইলার কথাগুলোয় শাহেদ নিজেই চমকে উঠলো। যা সে ইলার সাথে আবার দেখা না হলে হয়তো জীবনেও জানতো না। জীবন শুরুর প্রথম দিকের দু’জনের সেই ভালোলাগার ঘটনাগুলো যে এতবড় ঘটনার জন্ম দিয়ে ফেলছিলো বিশ্বাস করতেই পারলো না শাহেদ।

ইলার সেই প্রতিবেশি বান্ধবীর অতিরঞ্জিত গল্প ইলার মা’র মুখ থেকে ওর বাবা জানতে পেরেই আতংকিত হয়ে পরেছিলেন। কোন অনাকাংখিত ঘটনা যেন না ঘটে যায়, সেই আতংকেই তড়িঘড়ি করেই বদলী হয়ে চলে গেলেন নিজ হবিগঞ্জে। অমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা হয়তো ছিলো না তবু উঠতি বয়সের উন্মাদনার প্রতি ভরসা করতে পারেননি ইলার অভিভাবকেরা আশ্চর্যই হলো শাহেদ তখনকার পরিবেশ আর এখনকার পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে। সেই ইলা আর আজকের ইলা কি একই মানুষ? সময়ই মানুষকে কখনো দূরে সরিয়ে দেয় আবার কখনো কাছে নিয়ে আসে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, ইউএসএ

Exit mobile version