ইউসুফ কামাল : চার.
ইলা তার প্রতিশ্রুতি রাখলো, পৌঁছানোর দশ দিনের মাথায় তার লস এন্জেলস এর নতুন বাসার ঠিকানা নোমানকে লিখে জানালো। চিঠি তো নয় যেন প্রচন্ড এক বিস্ময়ের ধাক্কা নোমান আর শাহেদকে এক বিশাল দু:শ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিলো। নতুন বাসার কথায় দুশ্চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ে গেল দু’জনেরই, কিছু হয়েছে নাকি? বেশি কিছু লেখেনি। এখন তো স্বামীর সংসারেই থাকার কথা কিন্তু আলাদা বাসা কেন? কিন্তু কি করা দরকার কিম্বা কি করা যায় সেটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই ওরা আসতে পারলো না। দু’জনেই চিঠিটা কয়েকবার পড়লো, ভাবলো কি হতে পারে ইলার? লিখেছে ‘আমার এখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে অনেক ভালো হতো যদি আমি ঢাকাতেই থাকতে পারতাম। কয়েকদিনেই মনে হচ্ছে ছয় মাস আমি আমেরিকায় এসেছি। ঢাকা থাকলে ইচ্ছে মতো রিক্সা করে ঘুরতে পারতাম, তোমাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা জমজমাট আড্ডা দিতে পারতাম। প্রাণ খুলে হাসতে পারতাম যা এখন ভুলেই গেছি। তোমাদের সাথে যতটুকু সময় আমি কাটাতাম তার মজাই ছিলো আলাদা যা কখনই ভোলার নয়’।
‘মহসিন হলের তোমার ২৪২ নং রুমে শাহেদের সাথের সেদিনের স্মৃতি তো আমি কোনদিনই ভুলতে পারবো না। আমার আর শাহেদের মধ্যে তুমি গভীরভাবে জড়িয়ে গেছো। গত কয়েকদিন ধরে মনে হচ্ছে শাহেদের সাথে যেন আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। মফস্বল শহরের কৈশোর স্মৃতিসহ আমার পরবর্তি জীবনে কখনোই, কোনদিনই শাহেদ এতটুকু অসংযত আচরণ করেনি আমার সাথে। ‘মফস্বল শহরের সেই স্মৃতিময় দিনগুলো আমার জীবনের মাইলফলক হয়ে বাদ বাকী জীবন টাকেই কেমন যেন ম্রিয়মান করে রেখেছে। তোমার হলে দীর্ঘ সময় দুজনে নিরিবিলি সময় পার করার সময়টাতেও এর কোন ব্যাত্যয় ঘটেনি। আমার জীবনের প্রচন্ড চাওয়ার মানুষটাকে এত নিরিবিলিতে পাওয়ার পরও আমি আমার স্বামীর প্রতি কোন অবিচার করিনি, তাকে ঠকাতে চাইনি। নিজের বিবেকের কাছে সবসময় পরিচ্ছন্ন থাকতে চেয়েছি। স্বামীর জন্য আগামী জীবনের প্রতিটি প্রহর যেন বিশ্বস্ততায় ভরপুর থাকে সে চেষ্টা করেছি।’ পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সেতুবন্ধনে শাহেদ আর আমি যে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছি সেটার প্রমাণ আমরা দুজনেই অনেক বার পেয়েছি উভয়ে উভয়ের কাছ থেকে। তুমি আমাদেরকে তোমার হলের রুমে রেখে নীলক্ষেত থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে ফিরে এসে দেখলে পাশাপাশি চেয়ারে দুজনে দুজনার হাত ধরে বসে আছি। ব্যাস ঐ পর্যন্তই ছিলো আমাদের সম্পর্কের বিশ্বস্ততা। এর বাইরে কখনই আমাদের ব্যবহারের সীমারেখা অতিক্রম করেনি। শাহেদকে আমি মনের থেকেই প্রচন্ড বিশ্বাস করি। মনে প্রাণে ও সত্যিকারে একজন ভালো মানুষ’।
‘এখানে এসেই বুঝলাম আমাকে মনে হয় নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে, আর এ জন্য মনকে প্রস্তুত করতে শুরু করে দিলাম। যার মানে দাঁড়ালো নিজেকেই নিজের উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি কারো মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে পারবো না। নিজের স্বত্তাকে বিসর্জন দিয়ে, অনৈতিক সম্পর্ক ধারণ করা মানুষের সাথে কি বাস করা যায়? এভাবে তো আমি মানুষ হইনি’।
শাহেদ জানে ইলার জন্ম সিলেটের বনেদী হিন্দু পরিবারে, হবিগঞ্জের বিখ্যাত ‘রায়’ পরিবারের মেয়ে ইলা রায়। সামাজিক অবস্থানের দিকে হিসেব করলে ব্রিটিশ আমল থেকেই আলাদা একটা অবস্থান আছে সমগ্র সিলেট অঞ্চলে ওদের পরিবারের’।
শাহেদের চিন্তার বিষয় হলো জীবনই তো শুরু হলো না, এখনই এমনতো হবার কথা নয়। কি এমন হলো? বিদেশ জীবনে সবাই স্বাধীন ভাবে থাকতে পছন্দ করে শাহেদ এটা শুনেছিলো কিন্তু তাই বলে সেটা এমন কেন হবে? জীবন তো শুরুই হলো না, এখন তো মধু চন্দ্রিমার সময়। হেসে খেলে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটানোর কথা, কিন্তু শুরুতেই ভায়োলীনে এত করুণ সুর কেনো? চিন্তা করে কোন কুল কিনারায় পৌঁছতে পারলো না শাহেদ।
নোমানের কাছেও বিষয়টা মোটেও ভালো লাগেনি। শুধু বল্লো বিষয়টা তো বুঝতে পারছি না, এমন কেন হবে? তবে ইলা যে খুবই স্বাধীনচেতা সেটা আমি জানতাম, তাই বলে এখনই এমন হবে কেন? শাহেদ নোমান দু’জনই বিষয়টার উপর বস্তুত কোন রকম ধারণাই করতে পারলো না। তবে সামান্য যা বোঝা গেল তাতে এটা পরিস্কার, এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে ওঁদের দু’জনের মধ্যে যার পরিপ্রেক্ষিতে ইলা এই ধরনের চিঠি লিখতে পেরেছে। ওখানকার পরিবেশ কি হতে পারে সেটা দু’জনই মনে মনে ভাবলো কয়েকদিন ধরে। নোমান বিষয়টা নিয়ে সরাসরি জানতে না চাইলেও লিখলো, কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি? পনেরো দিন পরে উত্তরে ইলা সংক্ষেপে শুধু লিখেছিলো, ‘একটা চাকরী পেয়েছি, এখনো পৃথিবীতে ভালো মানুষ আছে। আত্মসন্মানের চেয়ে কোন কিছুই বড় নয় আমার কাছে। সন্মান বিকিয়ে কোন সম্পর্কই আমি রাখতে চাই না, তা সে যেই হোক না কেনো’? চিন্তা করো না, আমি ভালো আছি।
পরীক্ষা শেষে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার আর কোন সুযোগ থাকে না। শাহেদ ঢাকা ছেড়ে চলে গেল নিজের এলাকা কুমিল্লায় আর নোমান গেল গাজীপুর। যাওয়ার আগে মাস দুয়েক দুজনের বন্ধুত্বটা যেন আরো গভীর হয়ে গেলো। শুধু জানলো না দুজনের বন্ধুত্বের মাঝের মূল মানুষটি সাত সমুদ্দুরের ওপারে বসে আছে হাজারো অশান্তি মাথায় নিয়ে। নোমানের সাথে ইলার চিঠির মাধ্যমেই যা যোগাযোগ হয়, আর তাতে ইলা যেটুকু লিখে জানায় এর বেশি তো জানার উপায়ও নেই। আর ইলাও যেন মুখে কুলুপ এটে বসে আছে, খোলাখুলিভাবে কিছুই বলছে না। তবে শাহেদ এটুকু বুঝতে পারলো প্রচন্ড মানসিক ধাক্কা না খেলে এমন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কি এমন হলো? (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, রাজবাড়ী, বাংলাদেশ