ইউসুফ কামাল : দুই.
শাহেদের কলেজ জীবনের সেই ভালো লাগা ইলা’র আবার দীর্ঘদিন পর দেখা পেলো বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। কলেজের সেই স্বল্পবাক নায়িকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হয়ে উঠলো উচ্ছলতায় ভরা এক পূর্ণ নায়িকা। শাহেদের জীবনে দেখা দিল সদা হাস্যময় প্রাণোচ্ছল এক নতুন মানুষ হয়ে। প্রথমে একটু খটকা লেগেছিলো শাহেদের, বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিল না এ কি সেই ইলা নাকি অন্য কেউ? পরে ভেবেছিলো হয়তো বৃহত্তর পরিবেশের জন্য ইলা’র এই পরিবর্তন, মানে সহজ হয়ে যাওয়া। ইলা’ই তো নিজে সেদিন খুঁজে পেয়েছিলো শাহেদকে নিউমার্কেটে সুদীর্ঘ পাঁচ বছর পর। যে চোখ তুলে তাকালেও তার মধ্যে থাকতো গভীর চাওয়া, সেই মিষ্টি সুবাসিত হাওয়াটা সরে গিয়ে বরং সেখানে যেন স্থান করে নিয়েছে গ্রীষ্মের দুপুরের উদ্দাম হাওয়া। আগে যে দূরে থেকে সলজ্জ চাহনী দিয়ে একটা সম্মোহনী ভালোলাগার পরিবেশ সৃষ্টি করতো। সেই ইলা এখন দু’ফুট দুরত্বের মধ্যে থাকলেও আগের মতো সেই লাজুক ভাব এখন শাহেদ দেখতে পাচ্ছে না। একটু ভাবলো কি কারণ হতে পারে?
প্রথম দিন নোমানের উপস্থিতিতে শাহেদ মোটেই সহজ হতে পারছিলো না, বার বারই ওর মনে সেই পুরনো দিনগুলো সামনে চলে আসছিলো। নোমানের মতো একজন স্বল্প পরিচিত ব্যাক্তির উপস্থিতি শাহেদ এমনিতেই মেনে নিতে পারছিলো না তার উপর পুরনো দিনের একান্ত ব্যাক্তিগত আলাপচারিতা। ইলা’র সহজ আর দ্বিধাহীনভাবে অতীতের ‘না বলা গল্প’গুলো প্রকাশ্যে বলে দেওয়ায় শাহেদকে বরং কেমন যেন একটু দ্বিধাগ্রস্থই করে ফেলেছিলো। যে ইলা নিজে শাহেদের সামনে দাঁড়ালে লজ্বা, ভয়ে সংকুচিত হয়ে থাকতো আজকের এই ইলাই কি সেই ইলা? শাহেদ গভীরভাবে ভেবেছে ইলা’র এই সহজ হয়ে যাওয়া কি শুধু সময় আর পরিবেশের কারণেই? এমনও তো হতে পারে হয়তো মনে প্রাণে শাহেদ সেই পুরনো দিনেই আটকে আছে, যার কারণে সে ইচ্ছে করলেও সহজ হতে পারছে না? দু’দিন পরই শাহেদ বুঝতে পারলো ইলার এ সহজ হয়ে যাওয়ার কারণ। গল্পচ্ছলে নোমানই জানলো গত বছর ‘লস এ্যাঞ্জেলস’ প্রবাসী প্রকৌশলী ওদের পারিবারিক পরিচিত একজনের সাথে ওর গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে। টেলিফোন এ ওদের বিয়ের পর্বে নোমানসহ ক্লাসের আরো দুই তিনজন বন্ধু আমন্ত্রিত ছিলো। ইলা’র বাবা এমনিতেই রক্ষণশীল মানুষ মেয়েকে নিয়ে আর কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাননি তাই পরীক্ষার আগেই মেয়ের বিয়ের পর্ব শেষ করে ফেলেছেন। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে ইলা’ও চলে যাবে স্বামীর কর্মস্থলে, পরীক্ষার জন্যই ওর যাওয়া দেরী হচ্ছে।

সাধারণত: মেয়েদের বিয়ের পর তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে, ব্যাবহারিক দিক দিয়ে তারা নতুন এক পৃথিবীতে প্রবেশ করে। নতুন এক ধরনের আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে যার ফলে স্বল্পবাক নারীদের মধ্যেও বিরাট একটা পরিবর্তন চলে আসে। নোমানের সামনে শাহেদ আর ইলা’র অতীত কাহিনী উচ্ছ¡াস সহকারে বলার পর শাহেদ কয়েকদিন ইলা’র সাথে একটু দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করলো পারিপার্শিক অবস্থা চিন্তা করেই। ইলা’র বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র নোমানই শাহেদ আর ইলা’র পূর্বাপর ঘটনাগুলো জানতো, তাই অনেক কিছু চিন্তা করেই শাহেদ নিজেকে একটু সরিয়ে রাখলো। বিষয়টা ইলা’ও ধরতে পেরেছিলো, একদিন দুপুরে শাহেদ ওর তিন তলার ডিপার্টমেন্ট থেকে ক্লাস শেষে নামার সময় সিঁড়ির শেষ মাথায় মুখোমুখি হয়ে গেলো ইলা’র। শাহেদ’কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো নিজের থেকেই বল্লো, সময় হবে তোমার? কথা বলবো। শাহেদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। ইলা বল্লো, চলো। নিরবে ওর পিছনে অনুসরণ করলো শাহেদ। মোটামুটি সব ডিপার্টমেন্টের ক্লাসই শেষ হয়ে গিয়েছে। কড়িডোর ধরে একটু এগোতেই বাম দিকের একটা খালি কক্ষ দেখে ঢুকে পড়লো বল্লো, আসো এখানে একটু বসি। বুঝলাম কিছু বলতে চাচ্ছে ইলা।
পাশাপাশি একটু দূরত্ব রেখে দুজন বসলো। নিরবতা ভেংগে ইলা বল্লো, তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছো বুঝতে পারছি, আর কেন তাও বুঝছি। তোমার মনের অবস্থা আর আমার মনের অবস্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। তুমি কাউকে কিছু বলতেও পারছো না, আর তেমনি আমাকেও কিছু বলতে পারছো না। ইলা’ই শুরু করে দিলো পুরনো কথা, সে সব দিনের কথাগুলো তো ভোলাই যায় না। একেকটা দিন চলে গেলে অপেক্ষা করে বসে থাকতাম পরের দিনের জন্য, কলেজে যাবার জন্য তৈরী হয়ে বসে থাকতাম জানালার কাছে। অনেক দূর থেকে তোমার কলেজে আসা দেখা যেত, তুমি আমাদের বাসা পার হবার একটু আগেই আমরা বেরিয়ে পরতাম। এমনভাবে দূরত্ব বজায় রাখতাম যেন সবটুকু সময়ই তুমি আমার দৃষ্টির মধ্যেই থাকো। বিশ/পঁচিশ মিনিটের রাস্তাটা’র স্মৃতি রসদ জোগাতো পরের দিন পর্যন্ত।
আমার সেই বান্ধবী জোস্না’ই বলতো কখন ঘর থেকে বেরোতে হবে। অথচ দেখো, সেই জোস্নাই মায়ের কাছে ঘটনা অতিরঞ্জিত করে বলাতেই আমার বাবা ভয় পেয়ে দ্রæত হবিগঞ্জে বদলী হয়ে চলে গেলেন। তোমাকে আমি হারিয়ে ফেল্লাম আমার ভালো লাগার স্বর্ণালী জীবন থেকে। কিন্তু তবু আমার মন থেকে কিন্তু তুমি কখনই হারিয়ে যাওনি। তোমাদের ওখান থেকে চলে যাওয়ার পর প্রায় তিন মাস আমি কলেজে ভর্তি হইনি রাগ করে, পরে সবার কথায় ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট আশানুরুপ হয়নি। ভালো করতে পারিনি। বাবা দারুন রক্ষণশীল মানুষ, তোমাকে নিয়েই উনি ভয়ই পেয়েছিলেন। উনি ভেবেছিলেন আমি ধর্মান্তরিত হয়ে গেলে মানুষের কাছে উনি মুখ দেখাবেন কেমন করে। আমি নিজেও তখন তোমার ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতেও পারতাম না। ঘুণাক্ষরেও আমি বাবার বদলী হয়ে যাওয়ার কথা জানতেও পারি নাই । মাকেও বলে দিয়েছিলেন কাউকে না জানাতে। এটাও ঠিক তখন তোমার কথাতে আমি যে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারতাম। তোমার অদ্ভুত একটা সম্মোহনী শক্তি যেনো তখন কাজ করতো আমার উপর। আমার পরিস্থিতি তখন এমন হয়ে গিয়েছিলো যে, তোমার কোন কথাই আমি তখন হয়তো ফেলতে পারতাম না। তখনকার মতোই আমি এখনো ধর্মীয় চিন্তা চেতনাকে অত প্রাধান্য দিই না। আমার কাছে মানুষত্বই বড়, ধর্ম নয়। ধর্মীয় বিধি নিষেধকে আমি মনুষ্যত্যের উপরে কখনোই চিন্তা করি না।

তোমার সাথে আমার সেই দেখাই হলো, একটা বছর আগে কেন হলো না? তাহলে হয়তো আমার জীবনের ধারাটাই বদলে যেতো। অতীতের সেই কষ্টগুলোকে এখনো যেমন পুষে রেখেছি, তা হলে আর রাখতে হতো না। আগামী জীবনের দিনগুলোতেও আমাকে এমনি করেই কষ্ট বয়ে বেড়াতে হবে না। তখন বাবা আমার উপরও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাই কিছুই আমাকে জানতে দেননি। এত গোপনীয়তা রক্ষা করেছিলেন যে, তোমাদের ওখান থেকে চলে আসার আগের দিন বিকেলেই আমাদের চলে যাওয়ার কথা জানতে পেরেছিলাম। রোজার বন্ধের কারণে কলেজও বন্ধ ছিলো, তোমাকেও বলে আসতে পারিনি। শাহেদ চুপ করে শুনলো, কি বলবে । আর বলার কিইবা আছে। অস্ফুট স্বরে বল্লো, তোমার সাথে আমার এখন দেখা না হলেই বোধ হয় ভালো হতো, ভুলেই তো গিয়েছিলাম। প্রথম জীবনের ভালো লাগা, আর তা নিয়ে কতো কিছুই না চিন্তা করতাম তখন। তোমাকে নিয়েই মনের মধ্যে সারাক্ষণ আবর্তিত হতো আমার সমস্ত চিন্তা চেতনা। সামান্যতম সময়ও তুমি আমার মন থেকে বাইরে থাকতে না, সারাক্ষণই তুমি জড়িয়ে থাকতে আমার অস্তিত্ব্যের সাথে। শেষের দিকে শাহেদ আর কথা লম্বা করতে পারলো না। স্তদ্ধ হয়ে বসে রইলো, দুজনই যেন সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোতেই ফিরে গেলো। ইলা চলে গেলো নতুন পরিবেশে নতুন সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নতুন জীবনে। যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, বিভাগীয় পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে শাহেদ ও সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে নতুনভাবে নতুন জীবন শুরু করলো। জীবনের চলমান যাত্রায় ইলা উপাখ্যান মোটামুটি আবারো দ্বিতীয় বারের মতো হারিয়ে গেলো শাহেদের জীবন থেকে। কিন্তু তবুও কিছু কিছু মানুষ জীবনে যেন বার বার ফিরে আসে এটাই হয়তো ভাগ্যের লিখন। আর এটাকে প্রমাণ করার জন্যই মনে হয় ইলা শাহেদের জীবন থেকে হারিয়েও গেল না। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউস্টন, টেক্সাস, ইউএসএ