ইউসুফ কামাল : ষোল.
সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই উর্মিলা বল্লো আগে শাহেদকে পৌঁছে দিয়ে আসি তারপর ইলা সবশেষে আমি। সবাই আজকে সিংগেল, তিনজন তিন জায়গায় রাত্রিযাপন – বিষয়টা কিন্তু মন্দ না কথাটা বলেই জোরে হেসে উঠলো। কথাটা উপভোগ্যের হলেও কেউ কোন মন্তব্য করলো না। ইলাকে সামনে সীটে বসতে বলতেই ও কেমন যেন একটা ভংগিতে তাকালো শাহেদের দিকে, কোন কথা না বলে ডান দিকের দরোজা খুলে পিছনের সীটে শাহেদের পাশে যেয়ে বসলো। উর্মিলা কিছু মনে করে কিনা এই ধরনের একটা চিন্তা শাহেদের মনের মধ্যে ছিলো কিন্তু ইলার পিছনের সীটে বসে পড়ায় সেটা মন থেকে সরিয়ে দিলো। সামনের ব্যাক ভিউ মিররে শাহেদ দেখলো উর্মিলাও পিছনের সীটে ইলার বসে পরার দৃশ্যটা দেখে মৃদু হাসছে। শাহেদের আর বুঝতে মোটেই বাকী রইলো না যে এটাও ওদের দু’জনের যৌথ আলোচনারই ফসল।
ইলা দীর্ঘদিন মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে নিজস্ব অধিকারের সীমারেখাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছিলো আর সেই সাথে মানসিকভাবেও যেন বেশ খানিকটা স্থবিরও হয়ে পড়েছিলো। কোন সিদ্ধান্ত নিজেও নিতে পারছিলো না। সেটা জীবন পথের অভিজ্ঞ উর্মিলার বুঝতে দেরী হয়নি তাই তো সব দিক থেকেই ইলার মনে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছিলো যাতে ও আবার আগের মতো দৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আজকের এই ঘটনায় শাহেদ সেটা বুঝে নিলো, পাশাপাশি ইলার মুখের হাস্যজ্বল ভাবটা যেন উর্মিলাকেই বুঝিয়ে দিলো ও পেরেছে। মৌনতা ভেংগে উর্মিলা বল্লো, ইলা কালকে শাহেদকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করে ফেলো। কথাটা উর্মিলা একটু জোরেই বল্লো যাতে কথাটা শাহেদের কানেও যায়।
শাহেদ কথাটায় একটু মজাই পেলো, তাছাড়া সে নিজেও এমনি কিছু করতে হবে ভেবে রেখেছিল। উর্মিলার কথাটা যেন ওর মনের সাথে মিলে গেলো ভেবে একটু স্বস্তিও পেলো। ইলার জন্য তো কেনাকাটা করতে হবে, ভাবতে গিয়ে মনে হলো বুদ্ধি দেওয়ার মতো নিজস্ব মুরুব্বি গোছের একজন অভিভাবকও তো এখানে নেই। উর্মিলার কথায় শাহেদ কৌতুক করে বল্লো, অভিজ্ঞ গাইড লাগলে কি করবো, সেটাও তো আমাদের এখন জানা দরকার। শাহেদের কথার অর্থ ধরতে পেরে দু’জনই একসাথে হেসে দিলো। ইলা জিজ্ঞাস করলো, কাল কখন পারবে? উর্মিলা সপ্রতিভ উত্তর, সকালে আমার সেই পরিচিত ল’ইয়ার এর সাথে তোমাদের বিষয়ে কথা বলতে হবে তারপর না হয় বিকেলের দিকে যাওয়া যেতে পারে। দুইটা ইন্ডিয়ান শাড়ির বড় দোকান আছে এ্যালোরি কোর্টে, ওদের ভ্যারাটি কালেকশান। ওরা সবাই মোটামুটি আমার পরিচিত। আর কসমেটিকসের জন্য ‘মেসী’তে যাওয়া যেতে পারে। সর্বোপরি কথা হলো, বোনটা যেহেতু আমার তাই স্বাভাবিক ভাবেই কিছু দায়িত্ব তো আমাকে নিতেই হবে।
ওরা নামিয়ে দেবার পর হোটেলে ঢোকার সময় শাহেদ রিসিপশনের ঘড়িতে দেখলো রাত এগারোটা প্রায়। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো। ভেবেছিলো ঘুম আসবে, না তা হলো না বরং মাথার মধ্যে কেন যেন আজ বেশি করে ‘মা’এর স্মৃতিগুলো ঘুরতে থাকলো। সব মায়ের মতোই শাহেদের মা’ও বেঁচে থাকতে শাহেদের বউ নিয়ে কত যে কল্পনা করতেন, গল্প করতেন শাহেদের ভবিষৎ নিয়ে কিন্তু দেখে যেতে পারলেন না প্রিয় সন্তানের সাফল্যের সময়গুলো। কষ্টের কথাগুলো মনে আনতে চায় না শাহেদ, মনে আসলেই সমস্ত শরীর মন জুড়ে একটা হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। পিতৃ হারা সন্তানকে অসীম ধৈর্য্য নিয়ে নিজে কি ভাবে যে মানুষ করেছেন সেটা বুদ্ধি হওয়ার পর সব বুঝতে পেরেছে শাহেদ। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার ওর চাকরী পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই মা চলে গেল। মাঝে মাঝে এখনভাবে ওকে মানুষ করার পর্যন্তই বোধ হয় আল্লাহ মাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ও ভুলতে পারে না ছোট মামার অবদান, বিপদে আপদে নিজে ঢালের মতো দাঁড়িয়ে স্নেহময়ী বোনকে রক্ষা করে গেছেন। পিঠেপিঠি ভাইবোনের মাধ্যে যে এত মমত্ববোধ থাকতে পারে শাহেদ সেটা মা আর ছোট মামার মধ্যেই দেখেছে। বাবার তৈরী মার্কেটের আয় রোজগারও সঠিকভাবে মায়ের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও ছোট মামাই করে দিয়েছিলেন। যা দিয়ে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়াসহ যাবতীয় সংসারের খরচ চলতো। সত্যিকারের অভিভাবকের ছায়া সে ছোট মামার কাছ থেকেই পেয়েছে।
শুয়ে শুয়েই ভাবলো একমাত্র অভিভাবক বলতে এখন উনিই, একবার ছোট মামাকে এখনকার বিষয়গুলো জানানো উচিত। সরকারি এই চাকরী হওয়ার পর ছোটমামা কি যে খুশী হয়েছিলেন তা বলে প্রকাশ করার মতো না। এলাকার সবাইকে ডেকে ডেকে মিষ্টি খাওয়াতেন। কেন যেন মায়ের মুখটা ইদানীং ওর খুব মনে পড়ে, ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরলে কি যে খুশী হতেন মা। বাড়ির কাজের লোক দিয়ে সাথে সাথে ছোট মামাকে খবর পাঠাতেন ভালো বাজার করে দিতে। চিতাই পিঠা আর হাঁসের মাংসের ব্যবস্থা করে ফেলতেন দুই ঘন্টার মধ্যে। মা জানতেন এটা ওর সবচেয়ে প্রিয় খাবার। খুশীর চোটে সারা বাড়ির সবাইকে অস্থির করে ফেলতেন। সেই মায়ের কথা এখন মনে হলে আর কিছুই ভালো লাগে না শাহেদের। শাড়ীর আচল দিয়ে সমস্ত মুখটা মুছিয়ে দিতেন পরম যত্নে। ও জানে মায়ের শাড়ীর আঁচলের সেই শান্ত পরশ আর কোনদিন পাওয়া যাবে না। অদ্ভুত স্নেহময়ী আবেশে ভরা শান্তির এক পরশ যা চিরতরে হারিয়ে গেছে ওর জীবন থেকে। সারাজীবন খুঁজেও সে আর পাবে না। মা চলে যাওয়ার পর সে বুঝেছে মা এর বিকল্প পৃথিবীতে আর কিছু হয় না। এখন ভাবে মা’রা এমন হয় কেন? কেন মা’য়েরা সারাজীবন বেঁচে থাকে না? রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো ক’টায় মনে নাই, সকাল ন’টায় টেলিফোনের ওয়েকআপ কলে ঘুম ভেংগে গেল সেই সাথে রিসিপশনে ইলা অপেক্ষা করছে সেটাও জানিয়ে দিলো। ইন্টারকমে দু’জনের জন্য ব্রেকফাস্ট আর সেই সাথে ওয়েটিংলাউঞ্জে অপেক্ষারত ইলাকে রুমে পাঠিয়ে দিতে বল্লো। তাড়াতাড়ি ওয়াশ রুমের কাজ শেষ করে বসলো, ব্রেক ফার্স্ট সেরেই ইলাকে নিয়ে ‘মেসী’তে যেতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই কেনাকাটা এই দুইদিনের মধ্যেই শেষ করে ফেলতে হবে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ