ইউসুফ কামাল : পনের.
গত দুই দিনের এক টানা ঘুরাঘুরিতে শাহেদ ক্লান্ত হয়ে উর্মিলার বাসার গেষ্ট রুমে বিশ্রাম নিতে যেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলো। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলো বলতে পারবে না, পকেটে থাকা সেল ফোনের ভাইব্রেশন এ ঘুম ভেংগে গেল। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বারটা চিনতে পারলো না, জরুরি কল ভেবে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ, স্যার আমি কনস্যুলেট অফিসের পিআরও জাহাংগীর। আগামী নয় তারিখ সকাল নয়টায় আপনার লসএ্যান্জেলস্ থেকে নিউইয়র্ক আসার ফ্লাইট ঐ দিনই রাতে কনস্যুলেট অফিসে আপনাদের সবার সাথে আমাদের অফিসিয়ালী একটা ‘গেট টু গেদার’ এর ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আবার পরের দিন দশ তারিখ বিকাল পাঁচটায় আপনাদের দেশে ফেরার ফ্লাইট। আপনাদের সবাইকে ব্যাক্তিগতভাবে জানিয়ে দেবার জন্য আমাকে অফিসিয়ালী বলা হয়েছে। শাহেদ হিসাব করে দেখলো হাতে সাতদিন সময় আছে এখনো এর মধ্যেই সব কাজ গুছিয়ে উঠতে হবে। শাহেদের কথা’র আওয়াজে ইলা কখন যে রুমের ভিতরে এসে দাঁড়িয়েছে ও খেয়ালই করেনি। কথা শেষে খেয়াল করলো।

ফোনে ওদের কথোকথনের শেষ কথাগুলো শুনে ইলা বুঝতে পারলো শাহেদের ফিরে যাবার ডাক এসেছে। মুখটা বিমর্ষ করে বল্লো, আমি তোমাকে ডাকতে এসে দেখি তুমি ঘুমিয়ে গেছো তাই আর ডাকিনি, উর্মিলা তোমার জন্য বসে আছে। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। শাহেদ ইলার দিকে তাকিয়ে ওর কথাগুলো শুনে বল্লো, বুঝতেই পারিনি যে ঘুমিয়ে যাবো। আমি আসছি, তুমি যাও। ইলা রুমের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শাহেদ জানালা দিয়ে বাইরে দেখলো আশেপাশের ভবনগুলোতে আলোর ঝলকানি শুরু হয়ে গেছে। নীচে রাস্তায় গাড়ির হেড লাইটের আলোর সাথে আশেপাশের ভবনের লাল নীল বর্ণের বৈদ্যুতিক আলো যেন একটা মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছে।

শাহেদ হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত প্রায় আট’টার কাছাকাছি, তার মানে অনেকক্ষন ঘুমিয়েছে। বাথরুমে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে শাহেদ ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো উর্মিলা আর ইলা ওর জন্যেই বসে আছে। ইলার মুখ দেখে শাহেদের মনে হলো টেলিফোন আলাপ শোনার পর সম্ভবত ওর যাবার বিষয়ে দু’জনের মধ্যে একটা আলোচনা হয়েছে আর তারই পরবর্তি প্রতিক্রিয়া এটা। শাহেদ চিন্তা করলো কোথা থেকে অথবা কি ভাবে শুরু করা যায়! কিন্তু পরিস্থিতি যে খুব একটা সুখকর নয় সেটা ওদের চেহারাতেই স্পষ্ট। সবাই যে একটা অজানা আশংকার মধ্যে তা চেহারায় স্পষ্ট। তাছাড়া সে নিজেও উর্মিলার সাথে ইলা প্রসংগে আজ একটা আলোচনা করতে চায়। শাহেদ বিশ্বাস করে সবার জীবনেই কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে যা থেকে কেউই সহজে বেড়িয়ে আসতে পারে না। এটাকে নিয়তি অথবা ভাগ্য বলেই মেনে নিতে হয়। শাহেদ ওর নিজের জীবনের পরিধি নিয়েও মাঝে মাঝে চিন্তা করে করে দেখেছে, জীবনের পরিধি কতটুকু হতে পারে? এই চিন্তা নিয়ে ও খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি, ও বিশ্বাস করে একটা নিদৃষ্ট পরিসীমার মধ্যেই জীবনের গন্ডি সীমিত রাখাটাই মঙ্গলজনক। বেশি কিছু কল্পনা করে জীবনকে সে কখনই অতৃপ্ত হাহাকারে জড়িয়ে ফেলতে চায় না। নিজের জীবন নিয়ে খুব পরিস্কার একটা মূল্যায়ন ও করে ফেলেছে, কি করলে জীবনে সব দিক থেকে ভালো থাকা যায়। বরাবরই সে ভালো ছাত্র ছিলো আর এ নিয়ে কখনোই উন্নাসিকতা ওর মধ্যে কাজ করে নাই বরং মাঝারী ভাব ধারার জীবন কাটানো টাই ছিলো ওর নিজের পছন্দের। ইলার সাথে সব সময়ই ওর যোগাযোগ ছিলো, সব খবরই সে রাখতো।

সব শেষে যখন জানতে পেরেছিলো পিতামাতাসহ সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একা হয়ে গিয়েছিলো। ঠিক তখনই ইলার জীবন নিয়ে শাহেদের মনের ভিতর একটা সংশয়ও কাজ করছিলো। সেই সাথে ভিতরে ভিতরে একটা প্রচন্ড মায়াও কাজ করছিলো ইলার জন্য। ভাবছিলো কি ভাবে একা একা বেঁচে আছে মেয়েটা? সব সময়ই মনে মনে ওর মংগল কামনা করতো, ও যেন ভালো থাকে। নিরাপদে থাকে। সবশেষে আশ্বস্ত হয়েছিলো উর্মিলার মতো একজন মানুষের সাথে ওর সখ্যতার খবরে। উর্মিলা হাল্কা কুকি আর সাথে কফির মগটা শাহেদের দিকে এগিয়ে দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রসংগটা তুল্লো। এখন আপনার প্লানিং কি? আপনাদের বিষয়ে কথা বলাটা কি ভাবে নিবেন জানি না, আপত্তি না থাকলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন। এমন একটা প্রশ্নই যেন শাহেদ আশা করছিলো, একই ভংগিতে সে পাল্টা প্রশ্ন করলো উর্মিলাকে, এখন কি করতে পারি বলুন তো? আপনিই তো এখন ইলার সব কিছু, লোকাল বলুন আর পারমানেন্ট গার্জিয়ান যাই বলুন না কেন! শাহেদের পাল্টা প্রশ্নে উর্মিলা একটু থমকে গেল, কিন্তু পাশাপাশি একটা সন্তুষ্টির ভাব ও ফুটে উঠলো ওর চোখে মুখে।

টেবিলের কোনার চেয়ারে বসে ছিলো ইলা নিজেকে নিয়ে এই ধরনের আলাপে অংশ নেওয়া ওর মতো মেয়ের পক্ষে তো সম্ভবই না, উপরন্তু সামনে থাকাও বিব্রতকর তাই হয়তো উঠে লিভিং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখা শুরু করলো। শাহেদের সাথে দীর্ঘ আলোচনায় উর্মিলার মুখে একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠলো। বল্লো, আমি সত্যিই খুবই দুঃশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম এই বিষয়টা নিয়ে। এই তিন বছরে আমি খুব কাছের থেকে ইলাকে দেখেছি ও বুঝেছি। আমারতো নিজের কোন বোন নেই ইলাকে আমার আপন ছোট বোনের মতোই আগলে রেখেছি। সত্যিই ও খুব ভালো মনের একটা মানুষ, আপনি সুখে থাকবেন আমি শতভাগ নিশ্চিত। তাহলে আমার পরিচিত আইনজ্ঞের সাথে আগামী কাল সব বিষয়ে আলোচনা সেরে ফেলবো। এভিডেভিট ও অন্যান্য কাগজপত্র তৈরী করতে আপনার একটা বায়োডাটা লাগবে। আমি সব জেনে আগামী কাল আপনার কাছ থেকে ওগুলো নিয়ে নেবো। বাকী যা কিছু করার সেটাও আশা করি দুই তিন দিনের মধ্যেই সেরে ফেলতে পারবো। কথা শেষ করে শাহেদকে নিয়ে উর্মিলা ডাইনিং রুমে চলে এলো বল্লো, অনেক রাত হয়ে গেছে চলুন খেয়ে নিই তারপর আপনাদেরকে যার যার জায়গায় নামিয়ে দেবো। শাহেদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো ইলা গভীর মনযোগ দিয়ে টিভি দেখছে। শাহেদ গভীর ভাবে বুঝতে চেষ্টা করলো ইলার এই নির্লিপ্ততার কারন কি? কেমন যেন একটা স্থবিরতা কাজ করছে ওর মধ্যে, কি যেন ভাবছে একা একা। এমনকি শাহেদের দিকে তাকানোর কথাই ভুলে গেছে। খাওয়া শেষে তিনজন উর্মিলার বাসা থেকে বের হলো, গাড়ির কাছে যেতে যেতে শাহেদ একটু পিছিয়ে ইলার কাছাকাছি এসে জানতে চাইলো, ইলা তোমার কি হয়েছে বলো তো? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? ইলা দাঁড়িয়ে পড়লো, শাহেদ ওকে এ ধরনের প্রশ্ন করবে সেটা ভাবেনি।

সরাসরি শাহেদের মুখের দিকে গভীর ভাবে তাকালো। বল্লো, শাহেদ আজকে যে সিদ্ধান্তে আমরা এলাম সেটাই আমরা এতদিন চেয়ে এসেছি। সব বুঝেই আমি তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এতদিন পর যখন সৃষ্টিকর্তা আমাদের মনোবাঞ্চনা পূরণ করতে চলেছেন সেই কাংখিত প্রাপ্তির সূচনাতে আমার মনে কেন যেন একটা অজানা ভয় আগামী জীবনটা জানি না কেমন হয়? আগামী দিন গুলিতে সুন্দর মতো চলতে পারবো তো? (চলবে)

ইউসুফ কামাল : কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ