ইউসুফ কামাল : চৌদ্দ.
‘কিং ক্যাফে’ থেকে বেরিয়ে উর্মিলা শাহেদকে বল্লো কোথাও যেতে চান? চাইলে বলেন ঘুরে আসি। শাহেদ ইলার দিকে তাকালো, ওর তাকানোর ভংগিতে ইলা বুঝে ফেল্লো শাহেদ ওর অভিমত জানতে চায়। সকাল থেকে মোটেই রেষ্ট হয়নি শাহেদের উপরন্তু কাল রাতে ভালো ঘুমও হয়নি সেটা মাথায় আছে ইলার, উর্মিলাকে বল্লো ঘন্টা খানেক ঘুরে তোমার বাসায় চলো। সিদ্ধান্তটা শাহেদের মনপূতঃ হলো, পর পর কয়েকদিন জার্নিতে এমনিতেই সে ক্লান্ত। ব্যাস্ততম এলাকা ছেড়ে গাড়ি একটা হাইওয়ের পথ ধরলো, দুপাশে দিগন্ত জোড়া মাঠ। গাড়ির ছুটে চলার গতি দেখে শাহেদ অনুমান করলো পরবর্তি লোকালয় হয়তো বা আরো বেশ দূরে। কিছু দুর পর পর হাইওয়ে থেকে ডানে বামে এক্সিট নিয়ে কয়েকশ মিটার দূরে দূরে বড় বড় রিফুয়েলিং ষ্টেশন আর তার সাথে রিফ্রেশ হবার ব্যবস্থা। লং ড্রাইভের যাত্রীরা তাদের ক্লান্তি কাটানোর জন্য নেমে ওয়াশরুমের কাজ সেরে, অনেকে আবার একটু হেঁটে শরীরের আড়ষ্টতা কাটিয়ে কফি’র ওয়ান টাইম কাপ হাতে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে। এটাই যেন এদের ভ্রমণ বিলাসিতার প্রাত্যহিক চিত্র। কফিকে এদেশের মানুষ জীবনের অপরিহার্য পানীয় হিসেবে গ্রহণ করেছে, সকালে কাজে বেরোনোর সময় হাতে কফির মগ যেন একটা সাধারণ দৃশ্য। হাসপাতাল, সিনেমা হল, পথের মোড়ে মোড়ে কফির সহজলভ্যতাই প্রমাণ করে আমেরিকানরা কি পরিমাণ কফি রোজ পান করতে অভ্যস্ত। উইকএন্ডের এদের ভাবটা এমন হয় যেন এটা কোন মতেই নষ্ট করা যাবে না, আসলে এরা সময়ের সদ্বব্যাবহার করতে অভ্যস্ত। সপ্তাহে দুই দিন তো নরমাল ছুটি সেটাতেও এরা ঘড় ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ে সমুদ্র স্নানে কিম্বা পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে। রাস্তার পাশে পাশে ভালো ভালো হোটেল যেখানে চমত্কার সব রকম ব্যবস্থা, ভাড়াটাও অনুপাতে অনেক কম। ইচ্ছে করলে এখানে রাত কাটিয়ে আবার রওয়ানা হওয়া যায় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। উর্মিলা বল্লো জীবনকে এরা উপভোগ করতে জানে, সমুদ্র পার্শ্ববর্তী শহর হওয়ায় ছুটির দিনগুলো তে বিচিত্র মানুষের মেলা বসে যায় সারা শহরময়। উইকএন্ডে এদেরকে কোনমতেই ঘরে পাওয়া সম্ভব না, পরিবারের সবাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আউটিং এ যদি আগে থেকে কোন কাজের কথা ঠিক করা না থাকে। লসএ্যান্জেলস্-ক্যালিফোর্নিয়ার আবহাওয়া আমাদের এশিয়ার মানুষদের জন্য উপযোগী, সব কিছুই যেন মানানসই।
উর্মিলা বল্লো, আমি যখন প্রথম এ দেশে আসি এদের জীবন যাত্রা দেখে আমি হা করে চেয়ে থাকতাম। আমাদের মাতৃভূমি ভারতের মানুষের সাথে কত পার্থক্য এদের জীবন যাত্রা। পারিবারিক বন্ধনের সংজ্ঞা এদের সম্পুর্ণ ভিন্ন, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর এরা বাবা মা’র থেকে আলাদা হয়ে বাস করতে ভালোবাসে। এটাই নাকি এদের স্বাধীনতা এটাকেই এরা যেন নিয়ম মেনে নিয়েছে। ভাব খানা এমন যে আমার বয়স আঠারো বছর হয়ে গেছে এখন আমি এ্যাডাল্ট আমার জীবন আমার নিজের, আমি ভালো বুঝি কি করতে হবে। এটাই যেন এদের কাছে জীবনের সংজ্ঞা। এক শহরেই পিতা পুত্রের বসবাস, তবু ভিন্ন বাড়িতে ভিন্ন পরিবেশে। বৃদ্ধ পিতামাতারাও আলাদা বাস করে তাদের নিজস্ব পরিসরে, দেখা হয় মাসে, ছয় মাসে একবার। আশ্চর্যের বিষয় হলো এতে কারো কোন অনুযোগ অভিযোগ নেই, এটাই যেন এদের নিয়ম। অথচ দেখো আমরা কতো চিন্তা করি অস্থির হয়ে থাকি পরিবারের সবার জন্য। ধর্মীয় বিধান মেতাবেক পিতা মাতাকে আমরা সৃষ্টিকর্তার পরেই স্থান দিই, আমাদের বিশ্বাস নিয়ে কি আমরা খারাপ আছি? আমাদের দেশের মতো এমন সামাজিক বন্ধন পৃথিবীতে আর অন্য কোথাও আছে কিনা জানি না। অনেকটা মেশিনের মতো এদের জীবন ধারা।
আমার কাছে সব চেয়ে আশ্চর্য লেগেছে এদের মধ্যে জয়েন্ট ফ্যামিলি মানসিকতার অভাব দেখে। কয়েক বছর পর পর এরা এলাকা পরিবর্তন করে, শহর পরিবর্তন করে। বাড়ি পরিবর্তন করে, কোন কিছুর উপর যেন স্থায়ী মায়া মমতা ভালোবাসা কিছুই নেই। সারাজীবন এক বাড়িতে কাটিয়ে দেওয়ায় এরা বিশ্বাসী নয়। আমাদের দেশের মতো পৈতৃক বাবা দাদা’র ভিটার কনসেপ্টও এদের মধ্যে নেই।
পারিবারিক বাঁধনের অভাবের মতো সব কিছুতেই এদের চিন্তা চেতনাও এই ভাবেই গড়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদের দেশের মতো কেউ সহজে সাহায্য করতে এগিয়ে যায় না, এরা আগে পুলিশে ফোন করে। মিনিট ত্রিশেক গাড়ি চালানোর পর ডানের এক্সিট ধরে উর্মিলা একটা ফিলিং ষ্টেশনে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলো। তেল নিতে যেয়ে ইলাকে বল্লো, আমি গাড়িতে তেল ভরে আসছি তুমি শাহেদকে নিয়ে ষ্টোরে যেয়ে কফি তৈরী করতে থাকো। শাহেদ দেখলো মাঝারী ধরনের ষ্টোর, নিউইয়র্কে দেখা সেভেন ইলেভেন টাইপেরই হবে তবে এটা আকারে বড় বলে ওর মনে হলো।
দোকানে কাষ্টমারের সংখ্যাও অনেক বেশি সেই সাথে ফুড সেকশনটাও বেশ বড়। ইলা তিনজনের জন্যেই কফি তৈরী শুরু করে দিলো। দুইটা গøাসে কেটলি থেকে গরম কফি ঢেলে দুধ চিনি মিশিয়ে নিলো আর একটায় দুধ চিনি ছাড়া শুধু ‘র’ কফি ঢেলে দিলো। উর্মিলা ষ্টোরে ঢুকে কাউন্টারে কফির দাম মিটিয়ে ঠিকই ‘র’ কফির গ্লাসটা তুলে নিলো। শাহেদের দিকে তাকিয়ে বল্লো, আমি দুধ চিনি ছাড়া কফিই পছন্দ করি। দুধ চিনি দিলে তো কফির আর আলাদা কোন বৈশিষ্টই থাকলো না। কফি’র আসল স্বাদ পেতে হলে কোন কিছু মেশানো চলবে না। ইলা হেসে বল্লো, তুমি দুধ চিনি ছাড়া কফি কেমন করে যে খাও! এত তিতা আমার পক্ষে তো খাওয়া মোটেই সম্ভব না। ইলার কথা শেষ হতেই ওর দিকে তাকিয়ে উর্মিলা কৌতুকের স্বরে বল্লো, এই কারণেই তো আমার ভিতরে দয়া মায়া কম। ইলার দিকে তাকিয়ে বল্লো, এখন বুঝলাম মানুষ কেন আমাকে পছন্দ করে না। শাহেদ ওদের দুজনের কথা মন দিয়ে শুনছিলো, উর্মিলার শেষ কথায় বিস্ময়ের সাথে বল্লো, ও এখন বুঝলাম সবই তাহলে এই ‘র’ কফির কল্যাণে? আর তোমাকে কেউ অপছন্দ করে জানা ছিলো না তো? আমি তো দেখি সবাই সব সময় তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সবাই বলতে শাহেদ যে কাকে বোঝালো সেটা বুঝতে ওদের দু’জনের বাকী থাকলো না। শাহেদের কথায় সবাই একসাথে জোরে হেসে উঠলো। ফেরার পথে গাড়িতে উঠতে যেয়ে এবার ইলাকে সামনের সীটে বসতে বলে শাহেদ নিজের থেকেই গাড়ির পিছনের সীটে উঠে পরলো।
ইদানীং ইলার উর্মিলার বাসায় আসা কমে গেছে , ইচ্ছা করেই এখানে আসতে মন চায় না। অকারণে অবিনাশের কথা মনেই আনতে চায় না ও। দোতলায় উঠার সিঁড়ির সামনে আসলেই সেদিনের কথাগুলো আজ আবার ওর মনে পড়ে গেল। শাহেদকে সিড়িতে আগে উঠতে বলে নিজে সবার পিছনে উঠতে লাগলো। দরজাটার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলো এই সেই জায়গাটা অবিনাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে যেখানে দাঁড়িয়ে নিঃস্বের মতো উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো। ভেবে পাচ্ছিলো না কি করবে? কোথায় যাবে? ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়ে উর্মিলার ঘরের দরোজায় দাঁড়ালো। শাহেদ ঘরের ভিতরে ঢুকতে যেয়ে ইতস্তত করছে দেখে ইলা তাড়া দিলো, আরে চলো বাসায় এখন আর কেউ নেই আমরা তিনজন ছাড়া। ইলা ড্রয়িং রুমে ঢুকে শাহেদকে বল্লো- গেষ্ট রুমে যেয়ে একটু শুয়ে থাকতে পারো, দুই দিন তো তোমার ঠিকমতো রেষ্ট হয়নি। বাসায় আর কেউ নেই তুমি সংকোচ করো না, উর্মিলার বর পনেরো দিনের ছুটিতে দেশে গেছে। একরকম জোর করেই শাহেদকে গেষ্ট রুমে নিয়ে বল্লো, একটু শুয়ে রেষ্ট নাও আমি উর্মিলাকে কিচেনে হেল্প করি ও একা রান্না করছে। রাতে আমাদেরকে না খাইয়ে তো ছাড়বে না, আমি গেলাম তুমি শুয়ে থাকো কিছুক্ষণ।
শাহেদ ইদানীং লক্ষ্য করছে ইলার এই নজরদারীর বিষয়গুলো, একান্তই নিজস্ব মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধের প্রতিফলন যেন। ওর এই বিশেষ পরিবর্তনগুলো বেশ ভালোই লাগতে শুরু করেছে শাহেদের কাছে। শাহেদ বিছানায় শুয়ে চিন্তা করলো ইলার কথা-সেই মফস্বলের রেলের শহর, রেলের বড় মাঠটার পাশ দিয়ে সুরকী বিছানো পথে হেঁটে হেঁটে কলেজে যাওয়া কৈশর উত্তীর্ণ এক যুবতী, এখনো যেন সেই স্মৃতিগুলো অমলিন। যেতে যেতে মাঝে মাঝে ফিরে তাকানো, ঝাউ গাছ পার হওয়ার সময় ঝড়ের সেই শব্দ তো এখনো পরিস্কার শুনতে পায়। জীবন থেকে তো এখনো সে সব হারিয়ে যায়নি, হয়তো আর কখনো যাবেও না। অবিরাম ভালোলাগার সেই দিনগুলো এখনো জ্বল জ্বল করছে সযতেœ লালিত করা প্রিয় অ্যালবামের পাতায় পাতায়। ভাবতে ভাবতে শাহেদ এক সময় ক্লান্তিতে ঘুমিয়েই পড়লো মনের অজান্তে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ