ইউসুফ কামাল : ১১
ছয়দিনের দিন সকালে নিউইয়র্কের সেই পরিচিত নাম্বার থেকে ইলার সেলফোনে রিং বেজে উঠলো, একটু ব্যস্ত হয়ে ও ফোনটা হাতে নিলো। মোটামুটি শাহেদের নাম্বারের শেষ চারটে নাম্বার ওর মনেই ছিলো। হাতে নিয়ে নিশ্চিত হলো ওর অনুমানই সঠিক। ওপার থেকে শাহেদ কিছুটা আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বল্লো, আগামীকাল বিকেলে লসএ্যান্জেলস্ এ আসছি। সন্ধ্যা সাতটায় এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হোটেলে চলে যাবো। টানা পাঁচ ঘন্টার ফ্লাই, কোন বিরতি ছাড়া। আমেরিকার ডোমেষ্টিক ফ্লাইটগুলো লম্বা দূরত্বে সাধারণতঃ ষ্টপেজ দিয়েই চলাচল করে। তবে এ দুটোই মেগা সিটি তাই সরাসরি যাত্রী বেশিই পাওয়া যায়। লসএ্যান্জেলস্ বিমানবন্দর পৃথিবীর মধ্য চতুর্থ এবং সমগ্র আমেরিকার মধ্যে দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। শাহেদ জানালো, কনস্যুলেট অফিসের ওরাই টিকিট কেটে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে, সেই সাথে ওরা ফোন করে লসএ্যান্জেলস্ এ শাহেদের দেওয়া ইলার ঠিকানার কাছাকাছি ‘হলিডে ইন’ হোটেলে রুম রিজার্ভ করে দিয়েছে।
গত কয়েকটা দিন মোটামুটি একটা ঘোরের মধ্যেই কেটে গিয়েছিল ইলার। দীর্ঘ নয় বছর পর ইলার মন যেন আবার সেই কলেজ জীবনের দিনগুলোতেই ফিরে গেলো, অধীর আগ্রহ নিয়েই অপেক্ষা করে কাঁটালো কয়েকটা দিন। চিন্তা করলো কালই অপেক্ষার শেষ হবে। এরই মধ্যে একদিন উর্মিলার সাথে দেখাও হয়ে গেলো, ইলার স্বভাবজাত ধীরস্থির চলাফেরার বদলে ব্যাতিক্রমি একটা পরিবর্তন দেখেই উর্মিলার কেমন যেন একটু সন্দেহ হোল। মন মরা হয়ে থাকা চেহারা দেখতেই সে অভ্যস্ত ছিলো, হঠাৎ করে কি হলো – কোথাও নতুন করে কারো সাথে কোনো সম্পর্ক হয়ে গেলো নাকি? এই চিন্তার জট থেকে বের হতে উর্মিলা বুদ্ধি করে একটু টোকা দিলো, আর তাতে ইলা নিজেই শাহেদের নিউইয়র্কে আসার কথাটা আর না বলে থাকতে পারলো না।
উর্মিলার কাছে শাহেদের বিষয়ে বলতে যেয়ে ওরা যে ভিন্ন ধর্মীয় অনুসারী সেটাও খুলে বল্লো। বিষয়টাকে উর্মিলা গায়েই মাখলো না, বল্লো ধর্মীয় অনুশাসনের বিষয়গুলো যার যার একান্তই নিজের বিষয়। আজকাল উন্নত বিশ্বে মানুষ এগুলো নিয়ে ভাবে না। এ বিষয়ে শাহেদের মতামত কি? ইলার ইতস্তত মুখের চেহারায় উর্মিলা বিষয়টা বুঝে ফেলেছে বললো, আমি ওর সাথে কথা বলবো তুমি ভেবো না। তোমার কোন সমস্যা নাই তো? ইলা হেসে মাথা নেড়ে না সূচক সম্মতি জানাতেই উর্মিলা হেসে বলেই ফেললো, জীবনের প্রথম তো তাই কোন চিন্তাই করনি কেউ।
উর্মিলা ভালো করে লক্ষ্য করলো দু’তিন দিনের মধ্যেই কেমন যেন একটা সতেজতা ফিরে এসেছে ইলার মধ্যে, আর সেটা দেখে প্রচন্ড খুশীই হলো। অনেক চিন্তার শেষে উর্মিলা বুঝতে পেরেছে, অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসাই ওর প্রতি উর্মিলার দুর্বলতার প্রধান কারণ। ইলাও ভিতরে ভিতরে উর্মিলাকে বর্তমানে একমাত্র অভিভাবক হিসেবেই গণ্য করে, আর বিশ্বাসের প্রশ্নে কোন বিকল্প সে ভাবতেও পারে না। রাতে শুয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করে, কোন ভাগ্যে যে এমন একটা মানুষের সংস্পর্শে সে আসতে পেরেছে তা বিধাতাই জানেন। যার কল্যাণে ও জীবনের নিশ্চিন্ত অন্ধকার দূর হয়ে একটা আলোর পথে আসতে পেরেছে। পরেরদিন রাতে পরিচিত সেই নাম্বার থেকে আবার কল এলো, শাহেদের লসএ্যান্জেলস্ পৌঁছার সংবাদ নিয়ে। শাহেদ চলে এসেছে ইলার নাগালের ভিতরে খুব কাছাকাছি। গতকাল ফোন পাওয়ার পরই ও নেটে সার্চ দিয়ে শাহেদের হোটেলের অবস্থানও দেখে ফেলেছে। ইলার কর্মস্থল ‘সিয়ার্স’এ যাওয়ার পথেই পড়ে, ইলার ডরমিটরির খুব কাছে ইচ্ছে করলে হেঁটেই যাওয়া যায় তিন চার মিনিটের পথ।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো লসএ্যান্জেলস্ এর রাতের দৃশ্য। চারিদিকে ঝলমল করছে নিয়নের লাল সবুজ সাদা বাতিগুলো, জ্বলছে আর নিভেছে। দ্রæতগতিতে গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে যার যার নিজ গন্তব্যে। ইলা চিন্তা করলো রোজই তো এমনি করে আলো জ্বলে কই, কোন দিন তো এমনি করে সে জানালা দিয়ে তাকিয়েও দেখে না। কাজ থেকেও তো এমনি আলোর মধ্যে দিয়েই রোজ ফিরে আসে কিন্তু সেটা গভীরভাবে তো খেয়ালও করে না নিয়নের আলোর রং কত প্রকার? বুঝলো মন ভালো থাকলে সব কিছুই হয়তো ভালো লাগে, আবার বার বার দেখতেও ইচ্ছে করে। শাহেদের পৌঁছার খবর জানানোর ঘন্টা দুই পর ফোন হাতে নিয়ে ইলা ভাবলো শাহেদকে ফোন দেবে কিনা? এতদূর থেকে এসেছে ক্লান্ত হয়ে, শুয়েই বা পড়েছে কিনা? কি করবো? কি করা উচিত? বেশি আর দেরী করতে পারলো না। চিন্তা করলো খাওয়া হয়েছে কিনা, সেটা তো অন্তত জানা উচিত। ইলা নিজের মনের মধ্যে একটা বিশেষ তাগিদও অনুভব করলো। হয়তো অবচেতন মনে শাহেদ এর সাথে একটু কথা বলতেও মন চাইছিল। কল লগ দেখে মনে থাকা শেষ চার অক্ষরের নাম্বারটা বের করে কল দিলো। ধারণা করলো ফোনটা মনে হয় শাহেদের হাতেই ছিলো, এক বার রিং বাজতেই শাহেদ ধরলো ইলা জানতে চাইলো, কি করো? তোমার ডিনার কি শেষ?
ইলার প্রশ্নের ভিন্নতায় শাহেদ চুপ করে গেল। বুঝলো পরিস্থিতি পরিবেশ ও সময়ের কারণে আলাপের ধরনে ভিন্নতা শুরু হয়ে গেছে। ভালোবাসার পাশাপাশি দায়িত্ববোধও এসে গেছে ইলার মধ্যে। ভালোবাসার গভীরতায় দুইজনই সম্পর্কের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছে গেছে, যেখানে আবেগ আর ভালোবাসা যেন কর্তব্য আর দায়িত্বশীলতায় রুপান্তরিত হয়েছে। তুমি আমার কতো কাছে আছো জানো? ইলার কথায় শাহেদ একটু আশ্চর্য্য হয়ে বল্লো, কতদূর বলো তো? আমি কেমন করে বুঝবো? পথ ঘাট তো আমি চিনি না। ইলা হেসে ফেল্লো, আসবে নাকি? বেশি দুর না, চার পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। শাহেদ একটু ভাবলো, ইলা কি কিছু বলতে চাইলো? হাতের ঘড়ি টেনে সময় দেখলো, রাত সাড়ে দশটা বাজে, চিন্তা করলো এত রাতে তার পক্ষে ইলার ডরমিটরী খুঁজতে যাওয়া ঠিক হবে না।
আর খুঁজে পেলেও শাহেদ জানে ইলা ওখানে একা থাকে, যদিও এ দেশে কে কোথায় থাকে বা কার সাথে থাকে এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সর্বাপরি শাহেদ নিজে ইলার একটা ব্যাপারে সব সময় সচেতন, কোন সময় তার কোনো ব্যাবহারে যেন ইলা তাকে ভুল না বোঝে। তা ছাড়া এত রাতে ইলাকে আসতে বলাটাও ঠিক হবে না, তার চেয়ে বরং কাল সকালে দেখা হওয়াটাই ভালো হবে। ভাবলো জীবন চলার পথটা কত বিচিত্র-যার চিন্তা করে সুদীর্ঘ একটা সময় আবর্তিত হয়েছে, সে এত কাছে তবু ভদ্রতা সৌজন্যতা আর বিবেকবোধের কাছে আমাদেরকে সংযত হতেই হয়। জীবনের সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেক রকম, তবে পারিবারিকভাবে শাহেদ শিখেছে সুন্দর জীবনের মূল মন্ত্রই হলো পরিমিতবোধ। আবেগ জীবনে অবশ্যই থাকবে কিন্তু তার মধ্যেও থাকতে হবে সৌন্দর্যবোধ।
শাহেদ প্রসংগ পাল্টানোর জন্য ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করলো, কাল ছুটি নিয়েছো তো আমার জন্য? যে কয়েকদিন থাকবো, শুধু তোমার কেয়ারেই থাকবো। দুইজন সারাক্ষন ঘুরে বেড়াবো, দেখো আবার বিরক্ত হয়ো না কিন্তু। ইলার নরম কন্ঠে বল্লো আচ্ছা সমস্যা নাই, আমি ছুটির ব্যাবস্থা করে রেখেছি তোমার জন্যই। এ নিয়ে মোটেই চিন্তা করো না। আমি সকাল ন’টার মধ্যে তোমার হোটেলের রিসেপশনে পৌঁছে যাবো। নতুন একটা ভালোলাগা যেন সারা শরীর মন জুড়ে ভর করে রইলো ইলার।
এই শাহেদ আর আগের শাহেদের মধ্যে বিরাট একটা পার্থক্য, এই শাহেদের সাথে প্রথম দেখাটা কেমন হবে? সরাসরি দেখার মধ্যে একটা ভিন্নতর অনুভুতি কাজ করে, সেটা কেমন হবে? চোখ বন্ধ করে ইলা একটা মধুর আগামী সকালের চিন্তা করতে করতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ