হিমাদ্রী রয় : অনেকতো হলো চেতনার চাষ ক‚টনীতি আর রাজনীতির বাহাস
এমনি করে কেটে গেছে কত
বছর দিন মাস
মানুষের বুকে যেমন পাপ
মানুষের বুকেই ভালোবাসার বসবাস
হৃদয় দিয়ে দেখো
একাত্তরের উদ্বাস্তু জীবনের
সেই দুঃস্বপ্নের ইতিহাস খুঁড়ে
কতশত মানবিক মুখ আসে ঘুরেফিরে
মানুষ সেদিন দাগ মানেনি ভাগ মানেনি
বাধা হতে পারেনি কাঁটাতার
পূর্ব বাংলার আর্তনাদে
জাগ্রত হয়েছিল মানুষেরই বিবেক
ভাষার আত্মীয়তায়, ভালোবাসার রোদে
মৈত্রীময় এপার-ওপার একাকার।

আমি কখনো বালাট দেখিনি, একাত্তরে সেখানকার আহত মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন কেন্দ্রের গল্প শুনেছি বাবার কাছে। যশোর রোডকে জানি এলেন গিন্সবার্গের কবিতায় “শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল”।

আমি সেই জলের কাছে যাবো যেখানে মিশেছে আমার পূর্বপুরুষদের চোখের শ্রাবণের জলধারা সমস্ত ভাষায়। সেই কাদামাটি গায়ে মেখে লাখো আধমরা পায়ের ঘ্রাণ নেবো তাদের, যারা মাথার ভিতরে ভারি বুটের আওয়াজ আর বুকের ভিতরে জন্মভিটা থেকে বিতারিত হওয়ার বেদনা নিয়ে হয়েছিল উদ্বাস্তু।

আমি শরণার্থী শিবির দেখিনি, বেদনা হত কবি আমায় পাঠ দিয়েছেন “অভিধান থেকে নয় আশি লক্ষ শরনার্থীর কাছ থেকে জেনে নাও নির্বাসনের অর্থ কি”? সর্বশেষ যা এক কোটিতে দাঁড়ায়। আমি পাঠ করেছি সেই ইতিহাস। গড়ে প্রতিদিন চল্লিশ হাজার শরনার্থী প্রবেশ করেছিল ভারতের বিভিন্ন সীমান্তে ১৯৭১ সালে। ১৬ই মে ১৯৭১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী হলদি বাড়ি ও দেওয়ানগঞ্জ শরণার্থী শিবির পরিদর্শন কালে তিনি বলেছিলেন, “ভারত গরীব দেশ, আমার ভারতের মানুষ গরীব তবু আমরা সাধ্যমতো আপনাদের সেবা করবো”। মানবতার সামিয়ানার তলে সমবেত হয়েছিলেন বিভিন্ন পেশার মানুষ যার যার মত কেউ ত্রাণ দিয়ে, চিকিৎসক শুশ্রূষা দিয়ে, পথে নেমেছিলেন শিল্পী সমাজ, রাজপথে ভিক্ষা করেছেন ঋত্বিক ঘটক। সীমান্তের এপার ওপারের মানুষের একাত্মতা অনুপ্রাণিত করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। রক্ত, আগুন, ভয় আর নয় মাসের দীর্ঘশ্বাস পেরিয়ে স্বাধীন হয়েছিল দেশ, আমার বাংলাদেশ।

সীমান্তের ওপারের মানুষ লাখো লাখো শরণার্থীদের যে প্রীতিময় বন্ধনে বেঁধে ছিলেন তা ছিলো সকল রাজনীতির এবং ক‚টনীতির উর্ধ্বে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোই ছিলো চরম সত্য, এই সত্যেকে মাথায় তুলে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ দিল্লিতে তাঁকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জনতার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “ভারতবর্ষের সরকার এবং আপনাদের জনগণ আমার দুঃখি মানুষদের যে সাহায্য সহযোগিতা করেছে বাংলার মানুষ তা চিরকাল মনে রাখবে”।

এর পর দ্বিপাক্ষিক ক‚টনীতিতে অনেক ক‚টনামি হয়েছে, সীমান্ত নিয়ে হয়েছে স্বার্থপর রাজনীতি, আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে চেয়েছে সেই পুরনো প্রেতাত্মা যারা একদিন দিখন্ডিত করেছিল এই বাংলা। তবে এপার-ওপারের স¤প্রীতির সেতুটিতে পারাপারের যাত্রীরা জানে এক আকাশে একই সকাল, দিন গড়িয়ে আসে একই সন্ধ্যা, আমার চোখে সুরমা যদি তোমার অলকানন্দা।

সেই সত্যের কাছে আমারো মাথা নত আজ অশেষ কৃতজ্ঞতায়। ১৯৭১ সনে যে চায়ের দোকানদার জয়বাংলার লোক বলে চায়ের পয়সা নেয়নি, বাসের কন্ডাকটার ছেড়ে দিয়েছে জয়বাংলা হাঁক দিয়ে, লাল সবুজের পতাকাকে সমর্থন করতে যেয়ে মার্কিন রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রিচার্ড নিক্সনের কাছে ওল্ড বীচ হয়েছিলেন প্রীয়দর্শিনী শ্রীমতি গান্ধী। আমরা কি যাবো সেই ইতিহাস ভূলে? আমার মাথা নত হয়ে আসে সেইসব মানুষের আত্মত্যগের আসন তলে।
৬ ডিসেম্বর ছিল ছিলো বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী দিবসের ৫০ বছর। কানাডাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং ভারতীয় দূতাবাসের যৌথ উদ্যোগে চিত্র প্রদর্শনী ও মিলন মেলার আয়োজন হয়। এই গৌরবময় উদযাপনের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল মান্যবর হাইকমিশনার ডঃ খলিলুর রহমানের আমন্ত্রণে। জানাই প্রাণের অভিবাধন।
ইতিহাসের পথ ধরে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীময় পথচলা দীর্ঘজীবী হউক।
আমরা “এক মন এক মানুষ এক মাটি এক মমতা,
পরস্পর আমরা পর নই, আমরা পড়শী
আর পড়শীই তো আরশি”।