ফরিদ আহমেদ : ধর্মের মূল ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস ছাড়া ধর্মবিশ্বাস সম্ভব নয়। আপনার মধ্যে যদি বিশ্বাসের অনুপস্থিতি থাকে, সবকিছুকে যুক্তি-তর্ক প্রমাণের ভিত্তিতে মেনে চলার স্পৃহা থাকে, নিশ্চিত থাকতে পারেন যে ধর্মবিশ্বাস আপনাকে ছোঁবে না। তা সে যতই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ধর্মকে আপনার সামনে উপস্থাপন করা হোক না কেন। কারণ, আপনি তখন যুক্তি দিয়ে সবকিছুকে যাচাই করতে চাইবেন। বিশ্বাস আর যুক্তির চিরন্তন দ্বন্দ্বের কারণে বিশ্বাস তখন আপনার যুক্তির সামনে থেকে পালাবে। আর যদি যুক্তিবোধ না থাকে, তবে, সহজেই যে কোনো একটা বিশ্বাসকে আপনার মস্তিষ্ক গ্রহণ করে নেবে।
এইসব ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় যে বাবা-মায়ের ধর্ম বিশ্বাসকেই সন্তানেরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাস হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। এর কারণ হচ্ছে, ছোটবেলাতে বাবা-মায়েরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ থাকে বাচ্চাদের শিক্ষা দেবার। সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা নিজেদের ধর্ম বিশ্বাসকে ঢুকিয়ে দেন সন্তানের অবুঝ মস্তিষ্কের ভিতরে। সন্তানরা বড় হয়ে যখন নিজেরা চিন্তাভাবনা করতে শেখে তখনও তাদের পক্ষে বাবা-মায়ের শেখানো ধর্মবিশ্বাস থেকে সরে যাবার কিংবা সেটাকে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা যায় না। যাবার কথাও না। খুব ছোটবেলা থেকে দিনের পর দিন সেই বিশ্বাসকে প্রবেশ করানো হয়েছে, ফলে তা ছড়িয়ে পড়েছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে। এই প্রক্রিয়াটাকে ইংরেজিতে বলে ইনডকট্রিনেশন। বাংলাতে আমরা এটা মতদীক্ষাদান বলতে পারি।
ধর্মবিশ্বাসীরা কি তাহলে সবাই যুক্তিবোধবিহীন মানুষ? না, সেটাও না। যুক্তিবোধ ব্যতিরেকে আসলে কোনো মানুষ হয় না। ধর্মবিশ্বাসীরাও যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হন। তবে, সেখানে একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা থাকে। ওই সীমারেখার মধ্যেই তাদের যুক্তিগুলো ঘোরাফেরা করে। আগেই বলেছি যে ছোটবেলা থেকে এদেরকে মতদীক্ষাদানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সেই প্রক্রিয়ার কারণে ওই ধর্মের বিষয়ে তাদের যুক্তিবোধ কাজ করে না। যুক্তিবোধ কাজ করে অন্য ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি। সেগুলোকে তারা অনায়াসে যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করে দিতে পারে মিথ্যা বলে। নিজের ধর্মের ক্ষেত্রে এই কাজটা তারা করতে পারে না। যুক্তির যে সীমাবদ্ধতা দিয়ে তারা আবদ্ধ থাকে, সেই সীমারেখাগুলো অবশ্য ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। কারো যুক্তির সীমারেখা হয় খুবই ছোট। কারো বা সেটা থাকে অনেক বেশি বিস্তৃত। যে কারণে ধার্মিকদের মধ্যেও আমরা গোঁড়া দেখি, মধ্যপন্থী দেখি, সেই সাথে দেখি উদারপন্থীও।
ধর্মের সাথে সাথে ধর্ম প্রচারকদের বিষয়েও বিশ্বাস সমানভাবে কাজ করে। অনেক ধর্মের প্রধান ধর্মপ্রচারক বা অবতারদের হয়তো ঐতিহাসিক সত্যতাই নেই। ঐতিহাসিক সত্যতা থাকলে দেখা যাবে যে ইতিহাসে হয়তো তাঁদের ভূমিকা খুবই ধূসর। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের দেখা না মিললেও মিথোলজি বা পৌরাণিক কাল্পনিক গল্পে তাঁদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। পৌরাণিক কল্প-গল্প হলেও সেই ধর্মের অনুসারীরা সেগুলোকেই ধ্রæব সত্যি বলে বিশ্বাস করেন। বেশিরভাগ প্রাচীন এবং পৌত্তলিক ধর্মের ক্ষেত্রেই এটা আমরা বলতে পারি। অবতারদের অধিকাংশই মূলত কবি সাহিত্যিকদের কল্পনা থেকে এসেছে। আবার কোনো কোনো ধর্মের ধর্মপ্রচারক বা ঈশ্বরের অবতার হয়তো আসলেই ঐতিহাসিক চরিত্র। যেমন, উদাহরণ হিসাবে আমরা ইসলাম, ধর্মের কথা বলতে পারি।। এই ধর্মের প্রেরিত পুরুষ ছিলেন নবী মুহাম্মদ। তিনি একজন ঐতিহাসিক চরিত্র। কল্পনা থেকে সৃষ্ট কোনো কাল্পনিক চরিত্র তিনি নন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মেছিলেন তিনি।
শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে এই অঞ্চলটি অনেকটাই পরিত্যক্ত ছিলো। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন কিছু ছিলো না। রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে ব্যবসা বাণিজ্য সমুদ্র পথের মাধ্যমে হতো। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে রোমান শক্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ফলে, সমুদ্র পথে জলদস্যুদের উৎপাত শুরু হয়। এ কারণে সমুদ্র পথে জাহাজ চালানো বিপজ্জনক এবং ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। জলপথে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার ফলে স্থলপথ বিকল্প হিসাবে উঠে আসে। আরবের পশ্চিম সীমান্ত হিজাজে কাফেলা বাণিজ্যের মাধ্যমে আবার এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয় মক্কাতে। এই কাফেলা ব্যবসার মূল অবশ্য মক্কাতে ছিলো না। সেটা ছিলো ইয়েমেনে। এই ব্যবসার কারণে ইয়েমেন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিলো এবং আরবের অন্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি উন্নত ছিলো। এ কারণে এখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এসে বসবাস করা শুরু করে। এতে করে জনসংখ্যার এক বিস্ফোরণ দেখা দেয় সেখানে। ইয়েমেনের এই বাণিজ্যতে মক্কাবাসীরা পরিবহন ব্যবসা নিয়ে আসে সহায়ক হিসাবে।
মক্কার এই ব্যবসায়িক জাগরণের সময়ে সেখানকার কুরাইশ বংশে জন্মেছিলেন তিনি। জন্মের আগেই বাবাকে হারান তিনি। জন্মের পরে মায়ের সাথে সাথে মক্কাকে ছাড়তে হয় তাঁর। তাঁর দুধ মাতা ছিলেন তায়েফের অধিবাসী। নবী মুহাম্মদ আবার মক্কাতে ফিরে আসেন তাঁর পাঁচ বছর বয়সে। চাচা আবু তালিবের তত্ত¡াবধানে তিনি বড় হতে থাকেন। যুবক বয়সে বিবি খাদিজার ব্যবসাতে সংযুক্ত হন তিনি। মক্কা থেকে মালামাল নিয়ে বহু দূরের সিরিয়াতেও যেতেন তিনি। এই ব্যবসা করতে গিয়েই বিবি খাদিজার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়েটা অসম বয়সী ছিলো। বিবি খাদিজা তাঁর থেকে বয়সে পনেরো বছরের বড় ছিলেন। তাঁর চল্লিশ বছর বয়সের সময়ে তিনি এক নতুন এক ধর্মের প্রচার শুরু করেন। তাঁর প্রচারিত সেই ধর্মই মক্কার ক্ষুদ্র গণ্ডি পেরিয়ে আজকে অন্যতম একটা প্রধান ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে। তাঁকে নিয়ে মুসলিম-অমুসলিম, সব ধরনের ঐতিহাসিকেরাই প্রচুর পরিমাণে লিখেছেন। ফলে, তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে কোনো সংশয় নেই কারোরই।
এতো লেখালেখির পরেও ইসলামের অনুসারীরা কি নবী মুহাম্মদকে পুরোপুরি জানতে পেরেছেন? কিংবা আসলেই জানার চেষ্টা করেছেন সম্পূর্ণভাবে? খুব সম্ভবত না। নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে যে জ্ঞান তাদের রয়েছে, সেটা মূলত ওই বিশ্বাস থেকেই আগত, ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ থেকে নয়। বিশ্বাস থেকে আগত বলেই সেখানে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মিথ এবং সযত্নে ছড়ানো মিথ্যা। একজন ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসাবে নবী মুহাম্মদের আসল চরিত্র সেখানে অনুপস্থিতই বলা যায়। অথচ, তাঁকে নিয়ে খুব সহজেই একটা অথেনটিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ লেখা সম্ভব। সম্ভব সব মিথকে সরিয়ে দিয়ে মানুষ হিসাবে নবী মুহাম্মদের সাফল্য এবং ব্যর্থতাকে তুলে আনা। সমস্যা হচ্ছে এই কাজটা কেউ করতে চাননি।
তবে, ব্যতিক্রমও আছে। এফ, ডাবিøউ, বারলেই নবী মুহাম্মদকে নিয়ে একটা বিস্তারিত বই লিখেছেন। বইটার নাম হচ্ছে, ‘It’s all about Muhammad”. এটার ভূমিকাতে তিনি বলেছেন যে এই বই লেখার জন্য তিনি সাহায্য নিয়েছেন মূলত ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ঐতিহাসিকদেরই। ইসলামি ঐতিহাসিকেরা নবী মুহাম্মদের যে জীবনীগুলো লিখেছেন, সেখান থেকেই সবকিছু তুলে এনে সুনির্দিষ্টভাবে সংকলিত করেছেন তিনি। তাঁর ভাষাতেই বলি,
“ইট’স অল এবাউট মুহাম্মদ বইটা সম্পূর্ণভাবে ইসলামের মূল গ্রন্থসমূহের উপরে ভিত্তি করে লেখা। ইবনে ইসহাকের লেখা জীবনী, তাবারির ইতিহাস, বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ এবং ওয়াকিদি এবং তাঁর ছাত্র ইবনে সাদ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা লিপিবদ্ধ আদি ধর্মীয় ধারাবাহিক উৎসসমূহের একত্রিত রূপ বলা যেতে পারে এটাকে। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উৎস উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীর ইসলামিক স্কলার ইবনে কাসিরের কোরানিক ভাষ্য এবং তাঁর লেখা নবী মুহাম্মদের জীবনী গ্রন্থ। প্রতিটি অধ্যায়ের নোটে এই উৎসগুলোকে যথেষ্ট পরিমাণে উদ্ধৃত করা হয়েছে।”
প্রশ্ন হচ্ছে, ইসলামি উৎস থেকেই যদি সব তথ্য সংগৃহীত হয়ে থাকে, তবে এখানে নতুনত্ব কী আছে? নতুনত্বের মধ্যে যেটা অন্যতম, সেটা হচ্ছে এই বইতে সবকিছুকে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে করে কোনটা সত্যি এবং কোনটা মিথ, সেটা খুব সহজেই পাঠক আলাদা করে ফেলতে পারবে। ফলে, আসল নবী মুহাম্মদ উঠে আসবে পাঠকের কাছে। এটাই এই বইয়ের মূল কৃতিত্ব।