অনলাইন ডেস্ক : রংপুর মহানগরীর উপকণ্ঠে সেনানিবাসের পশ্চিমে ঘাঘট নদীর তীরে অবস্থিত গ্রাম নিসবেতগঞ্জ। যা শতরঞ্জি শিল্পের গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামের প্রায় বাড়িতেই শোনা যায় শতরঞ্জি উৎপাদনের ঘটাং ঘটাং শব্দ। কারিগররা আপন মনে বুনে চলেন নানান রকমের শতরঞ্জি।
অষ্টাদশ শতকের চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ নাগরিক মি. নিসবেত তৎকালীন রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। সে সময়ে নিসবেতগঞ্জ মহল্লার নাম ছিলো পীরপুর গ্রাম। সেই পীরপুর গ্রামে তৈরি হতো মোট মোটা ডোরাকাটা রং বেরংয়ের সুতার তৈরি গালিচা বা শতরঞ্জি। মি. নিসবেত এসব শতরঞ্জি দেখে মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি শতরঞ্জির গুণগতমান উন্নয়ন এবং এ শিল্পের প্রচার ও প্রসারে সহায়তা প্রদান করেন এবং উৎপাদিত পণ্যের ব্যাপক বিপণন ব্যবস্থা করেন।
এই শিল্পের মান উন্নয়ন ও বিপণন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য মি. নিসবেতের নামানুসারে গ্রামটির নামকরণ হয় নিসবেতগঞ্জ। তবে এ শিল্পে মজুরি বৈষম্যের কারণে মানবেতর জীবন যাপন করছেন কারিগররা।
আধুনিক সভ্যতায় কারু শিল্পের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শতরঞ্জির তৈরি কারিগরদের জন্য আশীর্বাদ। রংপুরের শতরঞ্জি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার প্রায় ৩৬টি দেশে রফতানি হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশেও রংপুরের শতরঞ্জির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে শতরঞ্জি তৈরির পাঁচটি কারখানা। এ কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।
বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমজাদ হোসেন জানান, বাংলাদেশের হস্তশিল্পের ৬০ শতাংশই রফতানি হয়ে থাকে রংপুরের শতরঞ্জি। বিগত তিন বছরে গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ ডলার দেশে আনা সম্ভব হয়েছে শতরঞ্জির মাধ্যমে।
নিসবেতগঞ্জের অধিকাংশ বাড়ির আঙ্গিনা কিংবা উঠানে টিনের ছাউনির নিচে চলছে সুই সুতোর কারুকাজ খচিত শতরঞ্জি বোনার কাজ। যেখানে পূর্বে হাতির পা, জাফরি, ইটকাঠি, নাটাই ইত্যাদি নামের নকশা সংবলিত শতরঞ্জি তৈরি হতো সেখানে এখন আরও বাহারি নকশার শতরঞ্জি উৎপাদিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) নির্ভর যোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নিসবেতগঞ্জ গ্রামে তাদের একটি শ্রমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মাত্র দুইটি দলের শ্রমিকদের শতরঞ্জি শিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা বলেছেন, সরকারি বরাদ্দের কারণে ব্যাপক আকারে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাচ্ছে না।
রংপুর নগরীর নিসবেতগঞ্জ শতরঞ্জি নামক শিল্পের কারিগর গীতারানী (৩৫), সৈকত হোসেন (৩৭), ফারুক হেসেন (৪০) বলেন, একজন কারিগর দিনে ১৫ থেকে ২০ ফুট শতরঞ্জি তৈরির কাজ করতে পারে না। আর এ কাজের জন্য মজুরি মিলে প্রতি ফুট মাত্র ১২ থেকে ১৫ টাকা।
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) সরকারের বরাদ্দ পেলে কিছু কারিগরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ৫০ হাজার টাকার ঋণ দেন। তারা সময় মতো এসে কিস্তিও নিয়ে যান। বর্তমানে এই শতরঞ্জি শিল্প চলছে ব্যক্তি মালিকানায়।
রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সরোয়ার টিটু বলেন, রংপুর নগরীর নিসবেতগঞ্জ শতরঞ্জি নামক প্রাচীন শিল্প। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারকে সাহায্যের আহবান জানাচ্ছি।
রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, শিল্পীদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণসহ ঋণ সুবিধা প্রদান করছি। রংপুরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে চাই।