রাহুল আনজুম: রোমান খ্রিষ্টান সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসেবে পশ্চিমের সাহিত্যে, মননে এবং দৈনন্দিন জীবনে আয়া সোফিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ আবেগের নাম। মধ্যযুগ পর্যন্ত আয়া সোফিয়ার পরিচিতি ছিল পৃথিবীর সব অর্থোডক্স খ্রিষ্টানের সেরা তীর্থ হিসেবে। তবে বসফরাসের নীল পানির বদলের সঙ্গে সঙ্গে আয়া সোফিয়া বদল করেছে তার ধর্মীয় পরিচিতি। গির্জা, মসজিদ, জাদুঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল এই পরিচিতি। কিন্তু ১০ জুলাই তুরস্কের সাংবিধানিক আদালত মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। সাংবিধানিক আদালতের এই ঘোষণার পর সরকারের পক্ষ থেকে আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরের ফরমান জারি করা হয়।
বর্তমান সময়ের আয়া সোফিয়া তৎকালীন বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নির্দেশে ৫৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫৩৭ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে আয়া সোফিয়া ব্যবহৃত হয়। চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ক্যাথলিক খ্রিষ্টানেরা অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপল আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং আয়া সোফিয়াকে অর্থোডক্স গির্জা থেকে ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তরিত করে। যার দরুন আয়া সোফিয়া ১২০৪ থেকে ১২৬১ সাল পর্যন্ত ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান মেহমেত কনস্ট্যান্টিনোপল, তথা আজকের ইস্তাম্বুল দখলে নিলে আয়া সোফিয়া অটোমানদের অধীনে আসে।
ইস্তাম্বুল দখলপরবর্তী সময়ে আয়া সোফিয়ার ভাগ্য নিয়ে প্রধান দুটি কথন বিদ্যমান। প্রথমত, তৎকালীন যুদ্ধনীতি অনুযায়ী সুলতান মেহমেত আয়া সোফিয়াকে দখল করে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, সুলতান মেহমেত খ্রিষ্টান পাদরিদের কাছে থেকে আয়া সোফিয়াকে ক্রয় করে নিয়েছিলেন। সুলতান মেহমেতের পাদরিদের কাছে থেকে আয়া সোফিয়াকে ক্রয়ের বিষয়টি আল-জাজিরার অনুসন্ধানমূলক সংবাদে উঠে এসেছে। তবে প্রথাগত অটোমান ইতিহাসবিদেরা এই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেনি। সুলতান মেহমেত আয়া সোফিয়াকে একটি ওয়াক্ফ সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করেন এবং নিজের নামে ফাউন্ডেশন গঠন করে তার ওপর আয়া সোফিয়ার দায়িত্ব অর্পণ করেন।
১৯২৩ সালে মুস্তাফা কামাল অটোমানদের উৎখাত করলেও গণমানুষের অব্যাহত চাপে আয়া সোফিয়া মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে মুস্তফা কামাল আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং সরকার ১৯৩৫ সালে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করে। দীর্ঘ এই পরিবর্তনের পরিক্রমায় আয়া সোফিয়া ৯২১ বছর গির্জা, ৪৮২ বছর মসজিদ এবং ৮৫ বছর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
কনস্ট্যান্টিনোপল, তথা আজকের ইস্তাম্বুল বিজয় মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামোকে বদলে করে দিয়েছিল। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব অনারবদের হাতে গিয়েছিল। যার দরুন বিপুল বেগে আরব সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণ হয় ইসলামে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল স্থাপত্যবিদ্যা। অটোমানরা আয়া সোফিয়াকে নিজের মতো আপন করে নিয়েছিল। অটোমান আমলে স্থাপিত সব মসজিদ ও স্থাপনায় আয়া সোফিয়ার গর্বিত উপস্থিতি বিদ্যমান। অটোমান মসজিদগুলোর গম্বুজ আয়া সোফিয়ার গম্বুজের মতো করেই তৈরি হয়েছে, যা সম্পূর্ণভাবেই আরব বিশ্বের মসজিদের গঠন থেকে আলাদা। এক কথায়, পুরো অটোমান সভ্যতার স্থাপত্যবিদ্যা আয়া সোফিয়াকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। জন ফ্রিলি তাঁর ‘আ হিস্টোরি অব অটোমান আর্কিটেকচার’ গ্রন্থে বিশদভাবে এর বর্ণনা করেছেন।
মজার বিষয় হলো আরবরা অটোমানদের কাছে এই নেতৃত্ব হারানোর বিষয়কে হজম করতে পারেনি। আঠারো শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের সহযোগিতায় নতুন করে আরব জাতীয়তাবাদের সূচনা করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে অটোমানদের হটিয়ে দিয়েছিল। সে সময় আরব জাতীয়তাবাদীদের অন্যতম যুক্তি ছিল অটোমানদের মসজিদগুলো আমাদের মতো নয়, বরং দেখতে আয়া সোফিয়ার মতো, যা খ্রিষ্টান সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। তাই ইসলামকে অটোমানদের হাত থেকে মুক্ত করে পরিশুদ্ধ করতে হবে।
জন্ম থেকেই আয়া সোফিয়া একটি রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সম্রাট জাস্টিনিয়ান যেভাবে আয়া সোফিয়াকে অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের বড়ত্ব প্রমাণে ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, ঠিক একইভাবে অটোমানরা আয়া সোফিয়াকে তৎকালীন খ্রিষ্টান দুনিয়ার বিরুদ্ধে মনস্তাত্ত্বিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আঠারো শতকে ইউরোপীয়রা এনলাইটেনমেন্টের নামে ধর্মকে রাজনৈতিক কাঠামো থেকে দূরে রাখার পণ করলেও আয়া সোফিয়াকে ভুলে যায়নি। গ্রিস, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটোসহ ইউরোপের অন্য অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা আয়া সোফিয়াকে টেবিলে রেখে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নীতি অঙ্কন করেছে। অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির পর মুস্তাফা কামালের সংস্কারগুলো তার বড় উদাহরণ হতে পারে। মূলত, মুস্তাফা কামালের আমলে বড় পরিসরে আয়া সোফিয়ার একটি রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়। মুস্তফা কামাল আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে পরিণত করেন এবং প্রথাগত পোশাক, শিক্ষাসহ সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে পশ্চিমা ধাঁচের ধর্মনিরপেক্ষতা রপ্ত করে ইউরোপীয় সমাজের অংশ হতে চেয়েছিলেন।
মুস্তাফা কামালের মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরের বিষয়টি যেমন রাজনৈতিক ছিল, তেমনি এরদোয়ানের জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তরের বিষয়টিও পরিষ্কারভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সময় হিসেবেও এই সিদ্ধান্ত বেশ পর্যালোচনার দাবি রাখে। বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আঙ্কারাকে এই সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেছে। প্রথমত, এরদোয়ানের রক্ষণশীল ভোটব্যাংক রক্ষা। এরদোয়ানের এবং একেপির ভোটারদের প্রায় ৯০ শতাংশ রূপান্তরের এই বিষয় সমর্থন করেছে। মূলত, রক্ষণশীল ভোটাররা প্রায় ছয় দশক ধরে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করার জন্য আন্দোলন করে আসছিল।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের শতাব্দীর চুক্তির নামে জেরুজালেমসহ ফিলিস্তিনিদের ভূমিকে ইসরায়েলের হাতে তুলে দেওয়ার জবাব। মার্কিনরা বহুকাল ধরে দুই রাষ্ট্রব্যবস্থা আর সব ধর্মের সহাবস্থানের কথা বললেও আদতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার জন্য কাজ করেছে। জেরুজালেম ও মসজিদুল আকসা তুরস্কে রক্ষণশীল রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে সেক্যুলার রাজনীতিরও আবেগের অংশ। তুরস্কের সব মতাদর্শের মানুষ, রক্ষণশীল ও সেক্যুলার—কেউই ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি মানতে পারেনি। কারণ, এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা মসজিদুল আকসা এবং নিজ ভূমির ওপর অধিকার হারায়। মার্কিনদের এই স্বীকৃতির দরুন তুরস্কের সমাজে বিদ্যমান মার্কিনবিরোধী জোটের পালে হাওয়া লেগেছে। আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের বিষয়ে এই মার্কিনবিরোধী আবেগকেই ব্যবহার করেছেন এরদোয়ান।
তৃতীয়ত, বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোতে চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান নীতিনির্ধারণী অবস্থান পশ্চিমের একক ক্ষমতাচর্চাকে সীমাবদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব ব্রেক্সিট, উগ্র ডানপন্থীদের উদয়, করোনা মহামারি এবং মার্কিনদের একলা চলো নীতি পশ্চিমের এই সীমাবদ্ধতাকে আরও বেশি মজবুত করেছে। মোটাদাগে, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে ভারত, পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন যেভাবে মার্কিন মিত্র, সেই একইভাবে পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় চীন ও রাশিয়াকে রুখতে আঙ্কারাকে পাশে চায়। এই সুযোগের ব্যবহার করেই আঙ্কারা সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রধান পক্ষ হয়েছে এবং পশ্চিমের এই নীরব সমর্থন ব্যবহার করে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, গ্রিসসহ প্রায় কয়েক ডজন দেশের আপত্তির মুখে এরদোয়ান আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করেছেন। পশ্চিমা বিরোধিতার দরুন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আঙ্কারা আরও বেশি নিঃসঙ্গ হতে পারে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই সিদ্ধান্তের বিশাল প্রভাব পড়বে। ক্ষমতাসীন একেপি নানান দলে ছড়িয়ে থাকা রক্ষণশীল ভোটারদের আগামী নির্বাচনে কাছে টানতে পারে। তাই এই গ্রীষ্মের শেষে তুরস্কে আরেকটি সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
রাহুল আনজুম: তুরস্ক প্রবাসী গবেষক।