সোনা কান্তি বড়ুয়া : পূজনীয় গৌতমবুদ্ধকে বুদ্ধ বন্দনষয় আমার দেশ আমার পরম তীর্থভূমি এবং বৌদ্ধ জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়, বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি! সবাইকে শুভ আষাঢ়ী পূর্নিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা। আষাঢ়ী পূর্ণিমার আলোক উদ্ভাসিত বুদ্ধের সত্যধর্ম এবং শুধু আমি আমার বিদ্যাবুদ্ধিতে এটুকু বলতে পারি প্রাচীন বৌদ্ধ ভারত ও বাংলাদেশের বুদ্ধমূর্তির চিত্রে এমন একটা কিছু আছে যার জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা যায়। বাব বার ফিরে ফিরে এঁকে দেখলে ও চোখ ক্লান্ত হয় না, পীড়িত হয় না। বাংলাদেশে একাধিক বুদ্ধমূর্তি আছে যা নাকি শুধু বিভিন্ন পদার্থ দিয়ে বানানো নয়, যেন তাঁর মধ্যে হাজার বছর ধরে বন্দী হয়ে আছে শিল্পীর অনুক্ত কথা, একটি অপ্রকাশিত ধ্যানের মন্ত্র। যা খোলা নয়, ঢাকা। মন বলে, “প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী / দাঁড়াব তোমার সন্মুখে।” তবু তা যে অছে তা অনুভব করা যায়, উপলব্ধি করা যায় পবিত্র মন ও শ্রদ্ধা নিয়ে উক্ত বুদ্ধমূর্তির সামনে এসে দাঁড়ালে! পরবর্তীকালে দান, শীল, নৈষ্ক্রম্য, ক্ষান্তি, প্রজ্ঞা, বীর্য্য, সত্য, অধিষ্ঠান, মৈত্রী ও উপেক্ষা এই দশ পারমীর ঋদ্ধতা সাধন করে একদা ভবদুঃখের অন্তঃসাধন করবে।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা উপলক্ষে গৌতমবুদ্ধকে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদনের নৈবেদ্য সাঁজিয়ে মহামানব পূজনীয় বুদ্ধের নামে উৎসর্গ করছি আমার লেখা কবিতা:
হে মোর চিত্ত অর্ঘ্যে সারনাথের মৃগদাবে (ভারত) বুদ্ধ তীর্থে জাগোরে ধীরে-
আষাঢ়ী পূর্ণিমায় বুদ্ধের প্রথম ধর্মপ্রচার স্মৃতির সাগরে তীরে।
হেথায় দাঁড়িয়ে দু’বাহু বাড়ায়ে নমি : বুদ্ধের ধর্ম গৃহত্যাগ জয়ন্তি
বুদ্ধের প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন পরমানন্দে নীতি বিশ্বশান্তি।
বুদ্ধের প্রথম ধর্মদেশনা ছিল পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের ধর্মচক্র তলে-
তথাগত বুদ্ধ ৪৫ বৎসর বছর ধর্মপ্রচার করেছিলেন ধরনীতলে!
ধর্ম কি? একটি বৃহৎ প্রশ্ন বটে! লোভ দ্বেষ মোহসহ ষড়রিপুকে জয় করার নাম বৌদ্ধ ‘ধর্ম! বৌদ্ধধর্মে নারীর মানবাধিকার এবং বোধিসত্ত¡ পন্থায় নারী ও বুদ্ধত্বলাভ করতে পারেন! হিংসা ও লোভের নাম ধর্ম নয়! গৌতমবুদ্ধের উপদেশ ছিল, “যে আমার দেহকে দেখে সে আমাকে দেখে না, যে আমার উপদেশ মেনে চলে সে আমাকে দেখে ও মেনে চলে।” আষাঢ়ী পূর্ণিমার যে পাঁচটি স্মৃতির বিষয় পথ অবলম্বন প্রারম্ভে মডেল বা প্যারাডাইমে ইঙ্গিত করা হয়েছে সেগুলো হলো (১) মাতৃগর্ভে সিদ্ধার্থের প্রতিসন্ধি গ্রহণ, (২) গৃহত্যাগ, (৩) পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের ধর্মদেশনা ছিল যেটি বুদ্ধের প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা; (৪) শ্রাবস্তীর গন্ডম্ব মতান্তরে গন্ডাম্র বৃক্ষমূলে যমক প্রাতিহার্য ঋদ্ধি প্রদর্শন এবং (৫) মাতৃদেবীকে তাবতিংস স্বর্গে অভিধর্ম দেশনা।
মহামতি সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ভারত গোলেমালে হিন্দু ইন্ডিয়া এবং মুসলমান পাকিস্তান হল কেন? সারা দিন রাত জুড়ে বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে হিন্দু এবং মুসলমান রাজনীতি অসংখ্য ষড়যন্ত্র করে চলেছে। মনস্তত্বের দৃশ্যকাব্যের মতো মানব সভ্যতা বা মানব জাতির জীবন নদী স্থির নয়, সদা অনিত্য পরিবেশে চল ও চলমান। বিশ্বপ্রবাহের নির্মমতা আজ প্রাচীন হিন্দুরাজনীতির বৈদিক সভ্যতার মানবাধিকারহীন জাতিভেদ প্রথাকে কাঁধে চাপড়িয়ে একবিংশ শতাব্দীর মহাকালের মোহনায় দাঁড় করায়!
বাংলাদেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশের ভিক্ষু সংঘের কাছ থেকে ত্রিশরনসহ পঞ্চশীল প্রার্থনা, নিমন্ত্রিত বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে সঙ্ঘ দান, পিন্ডপাত প্রদান, নিমন্ত্রিত উপাসক উপাসিকাগণকে আহার প্রদান এবং পুণ্যানুমোদনের পুণ্য অনুষ্ঠানসমূহ সুচারুভাবে সুসম্পন্ন হয়। মানুষ নিজের ভুবনে নিজেই সম্রাট। জগজ্জ্যোতি বুদ্ধের বিশ্বমৈত্রীতে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্ঠানসহ সর্ব ধর্মের মানুষ একত্রে মানুষের ভাই বোন আত্মীয় স্বজন। কোন মানুষ অন্য মানুষের শত্রু নয়। মানব মনে উদীয়মান সকল ধর্ম সর্বশক্তিমান এবং “যেথায় আছি যে যেখানে / বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে।” কানাডা এবং আমেরিকা দেশের প্রায় আড়াই হাজার বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপিত হচ্ছে। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে- যখন সম্রাট অশোক আফগানিস্তান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায় :
“নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে
রয়েছ নয়নে নয়নে,
হৃদয় তোমারে পায় না জানিতে
হৃদয়ে রয়েছ গোপনে।”
গৌতমবুদ্ধের অহিংস নীতিতে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোকের (After three hundred years of Lord Buddha) মানবাধিকারের ঘোষণা ছিল “অহিংসা পরম ধর্ম” শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায়, “জগতের মধ্যে শ্রেষ্ট সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্রুতিগোচর করিতে চাহিয়া ছিলেন, তাহাদিগকে পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিয়া ছিলেন, পাহাড় কোনকালে মরিবে না, সরিবে না, অনন্তকালের পথের ধারে অচল হইয়া দাঁড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা প্রতিদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতেই থাকিবে। পাহাড়কে তিনি কথা কইবার ভার দিয়াছিলেন। তোমার কীর্তির চেযে তুমি যে মহৎ, / তাই তব জীবনের রথ,/ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমারে,/ বারম্বার। / তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে,/ তুমি হেথা নাই।”
বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে এবং বাবরি মসজিদ ধবংস যজ্ঞে অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণস্থল থেকে উদ্ধার সম্রাট অশোক এবং বৌদ্ধ রাজাদের আমলের বুদ্ধ মূর্তি, ধর্ম চক্র (Hindustan Times dated 30 July 2020) এবং প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন বিদ্যমান। বৌদ্ধযুগে অযোধ্যা ছিল সাকেত বৌদ্ধ প্রধান অঞ্চল এবং আজকের অযোধ্যার স্থাপত্যেকীর্তির পুরাতাত্বিক অতীত অনুসন্ধান করতে গিয়ে বৌদ্ধ প্রাধান্যের যুগে ফিরে যাওয়া সহজ।
অযোধ্যায় বৌদ্ধ স্থাপত্যের একটি থামের শালভঞ্জিকায় ঐতিহাসিক ছবি বিরাজমান, যেখানে গৌতমবুদ্ধের মাতা শালপাতা তুলছেন। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর ভ্রমণ কাহিনি থেকে জানা গিয়েছে যে সপ্তম শতকে অযোধ্যায় ছিলেন তিন হাজার বৌদ্ধভিক্ষু। বৌদ্ধ বিহার ছিল প্রায় একশোটি। রামমন্দির নির্মাণের জন্য জমি সমতলীকরণের কাজের সময়ই উদ্ধার বুদ্ধ মূর্তি, ধর্ম চক্রসহ অন্যান্য সামগ্রী। রামজন্মভূমির বাবরি মসজিদ ভেঙে বের হলো বৌদ্ধ বিহার!
দক্ষিণ এশিয়ার যাদুঘরসমূহ, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, আফগানিস্তানের বামিয়ান পর্বতমালা, পাকিস্তানের ডায়ামার ভাসা বাঁধ, রাজশাহীর পাহাড়পুর এবং নরসিংদীর উয়ারী বটেশ্বরে আবিস্কৃত হলো লক্ষ লক্ষ বুদ্ধমূর্তি। মিশরের মুসলমানগণ তাঁদের পূর্বপুরুষগণের পিরামিডকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। গৌতমবুদ্ধের বোরোবুদুর বৌদ্ধ জগতের পূজনীয় ধর্মস্থান ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের কাছে “জাতীয় ঐতিহ্যের সুতিকাগার।” বাংলা বিশ্বকোষে (১৩শ ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৫) রাজপুত্র সিদ্ধার্থের (গৌতমবুদ্ধ) বঙ্গলিপি অধ্যয়ন করার ঐতিহাসিক প্রমাণ বিরাজমান এবং ২৬০০ বছর পূর্বে গৌতমবুদ্ধ বঙ্গলিপিকে ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। চর্যাপদে গৌতমবুদ্ধ বাংলা ভাষার জনক।
সম্রাট অশোকের রচিত শিলালিপির (নেপাল) মতে, গৌতমবুদ্ধের পূর্বে কাশ্যপবুদ্ধ এবং কনকমুনিবুদ্ধসহ আরও বুদ্ধ ছিলেন। তাই গৌতমবুদ্ধ বৈদিকধর্মের উত্তরাধিকারী নন। গৌতমবুদ্ধের পূর্বে দেবভাষা বা সংস্কৃত ভাষার কোন গ্রন্থ ছিল না। বাংলাভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে জন্ম নেয়নি, অশোকের শিলালিপির ভাষা ব্রাহ্মলিপি (প্রায় ৪০টা ভাষায় বর্ণমালার জনক), অনুসরণ করে দেবনাগরী লিপি বা বর্ণমালা প্রতিষ্ঠিত হয়! গভীর গবেষণার পর পন্ডিতগণ উপলব্ধি করেছেন যে, গৌতমবুদ্ধ বঙ্গলিপিকে ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রক্ষা করেন। সমস্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে লিপির কোন স্থান নেই। সরস্বতি বাগদেবী লিপির দেবী নন। তাই কলকাতা কেন্দ্রীয় (ইম্পেরিয়াল) লাইব্রেরীতে বাংলা ভাষার জনক গৌতম বুদ্ধের ছবি বিরাজমান। অধিকন্তু প্রাচীন কালের ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি লেখাকে নরকের দ্বার স্বরূপ ফতোয়া জারি করে সাধারণ মানুষের মৌলিক জনশিক্ষার অধিকার হরণ করেছিলেন। এই অন্ধকার যুগে একমাত্র গৌতমবুদ্ধই লোভী ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণ্যবাদী দলিত ঐতিহ্য ও সভ্যতা বিকৃতির হাত থেকে দক্ষিণ এশিয়ার জনগণকে রক্ষা করেন (দেশ, কলকাতা, ১ ফেব্রয়ারি, ১৯৯২)। ২০১৩ সালের ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা থেকে পালি ভাষাকে বাদ দিয়ে অবতারবাদী ষড়যন্ত্র আর ও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে।
খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ বছর পূর্বে ঋগে¦দের (প্রথম বেদ; ১/১০৫/৮ ও ১০/৩৩/২) মতে বৈদিক ধর্মপন্থী আর্য্যদের রাজা ইন্দ্র মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্ম ধ্বংস করেন। প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধদর্শনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ বৈদিক সাহিত্যে বিরাজমান এবং প্রাচীন উপনিষদের বিভিন্ন উপদেশ বৌদ্ধধর্ম থেকে নকল করা হয়েছে বলে গৌতমবুদ্ধ ত্রিপিটকের (মধ্যম নিকায়ের ৭৫ নন্বর) মাগন্দিয় সূত্রে ব্যাখ্যা করেছেন। বৈদিক উপনিষদ সাহিত্যসহ বিভিন্ন পুরান কাহিনীতে বৌদ্ধধর্মকে নকল করে হিন্দুধর্ম করা হয়েছে ।
দশরথ জাতক থেকে বানানো রামায়ণ রচনায় রাম লঙ্কা জয় করেননি, বিজয় সিংহই লঙ্কা জয় করলেন এবং এর সচিত্র বাস্তব ইতিহাস অজন্তায় বিদ্যমান। রামের কোন ইতিহাস নাই। মনে উৎকৃষ্ঠ চিন্তায় রাম এবং সুমতির নামই রাম। রাজনীতির গোলেমালে ইসলামিক ১৪৪২ হিজরি ১৪ ২৭ বঙ্গাব্দ কেন? রাজা শশাংক ও পুরোহিত শংকারাচার্য্যরে বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞ সম্বন্ধে রাশি রাশি বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংসের প্রতিবেদন (সম্পাদকীয়, আগষ্ট ২২, ১৯৯৩ আনন্দবাজার), এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের জঘন্য চাতুরীর ইতিহাস লিখতে গেলে একটি মহাভারত লিখতে হয়। প্রাচীন ভারত জুড়ে (দক্ষিণ এশিয়া) সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের’ নামে শুরু হয়েছিল ব্রাহ্মণ শাসক পুষ্যমিত্র (খৃষ্ট পূর্ব ১০০), রাজা শশাংক এবং শঙ্করাচার্যের ঐতিহাসিক বৌদ্ধ হত্যা মহাযজ্ঞ।’
বিজয় সিংহের সিংহলে (লঙ্কা) ধর্মবিজয়ী সম্রাট অশোকের ধর্ম সাম্রাজ্য স্থাপন!
এই প্রসঙ্গে ইহা ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, রাজা বিজয় সিংহের শ্রীলঙ্কা জয়ের তিন শত বছর পরে ভারত সম্রাট অশোক ২৩০০ বছর পূর্বে তাঁর পুত্র বৌদ্ধভিক্ষু মহেন্দ্র (মহিন্দা) এবং কন্যা ভিক্ষুনী সংঘমিত্রাসহ সম্রাটের ভারতীয় বৌদ্ধ মিশন বঙ্গবীর বিজয় সিংহের সিংহল দ্বীপে (শ্রীলঙ্কা) প্রেরণ করেন বৌদ্ধধর্ম ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মানসে। বিভিন্ন কারনে ভারতে বুদ্ধাব্দ ও বৌদ্ধধর্মের পতনের পর শ্রীলঙ্কায় আজ সগৌরবে বৌদ্ধধর্ম ও বুদ্ধাব্দ বিরাজমান। তখন বুদ্ধাব্দই ছিল বঙ্গাব্দ। জনতার প্রশ্ন : বঙ্গবীর রাজা বিজয় সিংহ, সম্রাট অশোক এবং চর্যাপদের বুদ্ধাব্দকে বাদ দিয়ে, তদুপরি হিজরি সালকে বিকৃত করে ভ্রষ্ঠাচারের মাধ্যমে হিন্দুরাজনীতি কি ষড়যন্ত্রে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠা করেছে?
বাঙালির আলেকজান্ডার ২৬০০ বছর পূর্বে বাংলাদেশের বিশ্ববিখ্যাত বীর পুরুষ বিজয় সিংহ লঙ্কা রাজ্য জয় করে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে বীর বাঙালির আসনে অলংকৃত করেন। তাই দুঃখের দিনেও বাঙালি বীরের জাতি। বিজয় সিংহের বিজিত শ্রী লঙ্কায় আজও ধর্মবিজয়ী সম্রাট অশোকের ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠার মহামন্ত্র স্বত:স্ফূর্তভাবে উচ্ছারিত হয় “বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি।” বিজয় সিংহ ভগবান বা রামের মহান শিষ্য বজরঙ বলী হনুমানও নহেন। বৌদ্ধ পালরাজাগণ বাংলাদেশে চারশত বছর রাজত্ব করেছিলেন এবং ১০৪১ সালে অতীশ দীপংকর তিব্বতে যাবার পর বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম রাতারাতি কোথায় হারিয়ে গেল?
হিন্দুরাজনীতির হিন্দুধর্মই শুধু বৌদ্ধ ভারতের বুদ্ধগয়া ম্যানেজম্যান্ট কমিটি নিয়ন্ত্রণসহ সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা সমূহ ভোগ করে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা তো সভ্যসমাজে গণতন্ত্রের আইন নয়। গণতান্ত্রিক ভারতে হিন্দুধর্ম কি অহিন্দু ধর্ম সমূহকে মুন্ডক উপনিষদ (বা গৃহত্যাগী জৈন, বৌদ্ধ, হিন্দু ইত্যাদি) এবং আল্লাহ উপনিষদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার কি ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে? সম্রাট অশোক বৈদিক প্রাণী হত্যা মূলক যজ্ঞ এবং জাতিভেদ প্রথা আইন করে বন্ধ করে দিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আমার লেখা কবিতা:
হাজার বছর আগে হরিসেনের বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের কথা
বল্লালসেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্রের নামও আছে গাঁথা।
বৌদ্ধগণ বন্দী আজ হিন্দুত্বের ঘৃণার অগ্নিগিরিতে
ফেলে আসা বৌদ্ধ শ্মশান ও হাজার বছরের কবর খুঁড়তে।
সম্রাট অশোকের শিলালিপি পালি ভাষায় পালি (ব্রাহ্মী) অক্ষরে লেখা আছে এবং উক্ত ব্রাহ্মী লিপি (বর্ণমালা) থেকে বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃত, থাই বর্ণমালাসহ ৩৫টি ভাষায় বর্ণমালার উৎপত্তি। বাংলাদেশের বিক্রমপূরের বজ্রযোগীনি (কালী বা তারা দেবী বোধিসত্ত¡) গ্রামের অতীশ দীপংকর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মের প্রতিনিধি এবং বঙ্গরত্ন অতীশ দীপংকরের বিশ্ববিজয়ী স্মৃতি বাংলাদেশের সর্বকালের আলোকিত সারস্বত সমাজ প্রতিষ্ঠার উৎস এবং ‘চর্যাপদ’ বাংলা ভাষার প্রথম এবং এবং ২৫৬২ বুদ্ধাব্দই আজকের বঙ্গাব্দ।
বাংলাদেশে দিন বদলের যে মডেল বা প্যারাডাইমে মুসলমান রাজনীতির (B.C.S. Text Book in 2017) পরধর্মবিদ্বেষের ভাইরাস মানবাধিকার বিরোধী!
পূজনীয় গৌতমবুদ্ধকে মুসলমান রাজনীতি নারী বিদ্বেষী বানিয়ে গোলে মালে আধুনিক সমাজের চোখে ধূলো দিচ্ছেন। বৌদ্ধ ত্রিপিটকে বুদ্ধের মহাউপাসিকা বিশাখা, মহাভিক্ষুনী ক্ষেমা ও উৎপলা বর্ণা এবং বাংলা ভাষার প্রথম বই চর্যাপদে Great scholars and Meditation Masters বৌদ্ধ মহিলাগণ (সিদ্ধার্যগণের) অভিধর্ম মনস্তত্ত¡ দিয়ে কবিতা রচনা করেছেন! বোধিসত্ত¡ পন্থায় নারী ও বুদ্ধত্বলাভ করতে পারেন এবং শ্রীমালাদেবী (the daughter of King Prasanjit) সিংহনাদ মহাযান বৌদ্ধধর্মের সূত্র মতে গৌতমবুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করার বোধিসত্ত¡ পন্থা (অনেক জন্মের সাধনা) নির্দেশ করেছেন। উক্ত পথ অবলম্বনে নারী ও বুদ্ধত্বলাভ করতে পারেন!
সম্রাট অশোকের শিলালিপি পালি ভাষায় পালি (ব্রাহ্মী) অক্ষরে লেখা আছে এবং উক্ত ব্রাহ্মী লিপি (বর্ণমালা) থেকে বাংলা, হিন্দী, সংস্কৃত, থাই বর্ণমালাসহ ৩৫টি ভাষায় বর্ণমালার উৎপত্তি। বাংলাদেশের বিক্রমপূরের বজ্রযোগীনি (কালী বা তারা দেবী বোধিসত্ত¡) গ্রামের অতীশ দীপংকর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মের প্রতিনিধি এবং বঙ্গরত্ন অতীশ দীপংকরের বিশ্ববিজয়ী স্মৃতি বাংলাদেশের সর্বকালের আলোকিত সারস্বত সমাজ প্রতিষ্ঠার উৎস ‘চর্যাপদ! বাংলা ব্যাকরণের সাথে পালি, থাই, বার্মা, কম্বোডিয়া, লাওস ও শ্রীলংকার ব্যাকরণের সাদৃশ্য বিদ্যমান!
এই সব কথা কি করে আমি আপনাদেরকে সবিস্তারে বর্ণনা করবো? বিদেশী সভ্যতার হাজার বছর আগে বাঙালির গৌরব সন্তান অতীশ দীপঙ্কর বিশ্বমানবতা, মানবাধিকার ও অহিংসার মন্ত্র দিয়ে তিব্বত ও চীনসহ পৃথিবী জয় করেছিলেন। অতীশ দীপঙ্করের দেশ বিক্রমপূরের বজ্রযোগিনী অন্ধকারে ডুবে গেল কেন?
বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায় :
“হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি নিত্য নিঠুর দ্ব›দ্ব
ঘোর কুটিল পন্থ তার লোভ জটিল বন্ধ।
নতুন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী
কর ত্রাণ মহাপ্রাণ আন অমৃত বাণী
বিকশিত করো প্রেম প্রদ্ম চিরমধু নিষ্যন্দ
শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য
করুণাঘন ধরণীতল করহ কলংক শূন্য
এস দানবীর দাও ত্যাগ কঠিন দীক্ষা
মহাভিক্ষু লও সবার অহংকার ভিক্ষা।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্ত কলুষ গ্লানি
তব মঙ্গল শঙ্খ আন, তব দক্ষিণ পাণি
তব শুভ সঙ্গীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য
করুণাঘন ধরনীতল করহ’ কলঙ্ক শূন্য।”
বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ট, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!