কামাল কাদের : জীবনের চলার পথে কত কি ঘটে যায়, আমরা কেউ আঁচ করতে পারি না। কারণ আমাদের জীবনটা রহস্যময়। ইরফান এবং নাজমা এক আদর্শ দম্পতী। কলেজ জীবনে একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। দুজনেই উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের টিচার। ইরফান অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার আর নাজমা হোম ইকোনোমিক্স এর শিক্ষীকা। মধ্যবিত্তের জীবন, অন্য পাঁচজনের মতো দিন চলে যাচ্ছে। দেশ নব্য স্বাধীনতা লাভ করেছে, তারই জোয়ারে দেশের তরুণ তরুণীদের মাঝে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতার হিড়িক পরে গেছে। এদের মধ্যে ইরফান এবং নাজমা ব্যতিক্রম রইলো না। ভাবলো বিদেশে যেতে পারলে অন্ততপক্ষে ছেলে মেয়েদেরকে ভালো ভাবে ভরণ-পোষণ এবং উচ্চ মানের শিক্ষা-দীক্ষা দিতে পারবে। যেই ভাবা সেই কাজ, কয়েকটি দেশে বিশেষ করে “ইংলিশ স্পিকিং” দেশগুলিতে অভিবাসী হিসাবে থাকার জন্য চেষ্টা করা শুরু করলো। অনেক চেষ্টা তদবির করে কানাডায় থাকার অনুমতি পেয়ে গেলো। সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে একদিন কানাডার পথে পাড়ি জমালো।
ইরফান, বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যে “ডক্টরেট” ডিগ্রীধারী। কিন্তু কানাডাতে ওই ডিগ্রী মূল্যহীন। তাই অনিচ্ছাসত্তে¡ টরন্টোর এক হোটেলে “ওয়েটারের” কাজ নিতে বাধ্য হলো। এদিকে নাজমা কোনো দ্বিধা না রেখে এক “গ্রোসারি সপে” সেলস গার্ল হিসেবে যোগ দিলো। মানব জীবনে ডিগ্রী অর্জন করা যে শুধু ভালো চাকরী পাওয়া নয়, বুদ্ধিমত্তার বিকাশেরও ক্ষেত্রস্থল। বাস্তব জীবনকে কিভাবে সুপন্থায় মোকাবেলা করা যায় তারই শিক্ষাকেন্দ্র হলো কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। এরই জ্বলন্ত প্রমাণ হলো ইরফান এবং নাজমা।
ছেলে “ইউনিভার্সটি অফ টরন্টো” থেকে এবং মেয়ে “ইউনিভার্সিটি অফ ইয়র্ক” থেকে ডিগ্রী করে তাদের নিজেদের পেশায় নিয়োজিত। মেয়ে তার পছন্দ মতো এক কানাডিয়ান বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করে অটোয়া শহরে বসবাস করছে, ছেলেটি এক মেক্সিকান মেয়েকে বিয়ে করে নিউইয়র্কে সংসার ধর্ম পালন করছে। ছেলেমেয়েরা রীতিমতো মা-বাবার ভালো মন্দ খবরা খবর নেয়, সময় এবং সুযোগ পেলে বয়স্ক মা-বাবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে যায়। এদিকে ইরফান এবং নাজমা নিজেদের বুদ্ধি খাটিয়ে প্রথমে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছে একটা ইন্ডিয়ান “টেকওয়ে” খাবারের দোকান খুলে এবং সেটাকে আস্তে আস্তে উন্নতি করে একটা বড় রকমের “ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে” রূপান্তরিত করে। মোট কথা তারা আর্থিক দিক থেকে সফল। আর তারা তাদের জীবনটাকে যে ভাবে সাজাতে চেয়েছিলো, সে ভাবেই অগ্রসর হচ্ছে।
এভাবেই ইরফান এবং নাজমার বিয়ের কয়েক দশক ভালোবাসা এবং ভক্তির সাথে অতিবাহিত হতে চললো। একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন এক মুহূর্ত কাটে না, আগের মতো তেমনি অটুট, অমলীন। যখন তাদের দুজনার বয়স ৬০ এর মধ্যে তখন তারা পরিকল্পনা করছে, ছেলে মেয়েরা তো যার যার জীবন বেছে নিয়ে সংসার করছে, তাহলে তারা কেন তাদের বাকী জীবনটা আদর্শগতভাবে তাদের নিজেদের মতো কাটিয়ে দিতে পারে না! এই রকম ভেবেই কিছুটা পাগলামী করে ঢাকা শহর থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে এক মফস্বল শহরে একটা “ফার্ম হাউস” কিনে নিলো। সেই ফার্ম হাউসটিকে ঢাকার এক নামকরা আর্কিটেক্ট দিয়ে নুতন করে ইংলিশ স্টাইলে একটা বাংলো বানালো। সেরা এবং দামি আসবাবপত্র দিয়ে ঘরগুলিকে সাজালো। বাংলোটার চারিধার ঘিরে নানা জাতের ফুল এবং ফলের গাছ দিয়ে বাড়িটাকে সবুজের সমারোহে একটা শান্তি নিকেতন তৈরি করলো। আশা করছে অবসর নেয়ার পর বাকী জীবনটা দুজনা সুন্দর করে এখানেই কাটিয়ে দিবে এবং ইরফান তার শখের লেখালেখীর কাজ চালিয়ে যাবে। তার এই লেখা হবে তার একান্ত নিজের, শুধু নাজমা ছাড়া আর অন্য কারোর জন্য নয়। কিন্তু ভাগ্যের অন্য ধারণা ছিল। কথায় আছে না! “যদি ভগবানকে হাসাতে চাও, তাহলে ভবিষ্যতে তোমার কি প্লান অথবা কি পরিকল্পনা তাকে জানাও, তাহলে দেখবে ভগবান কেমনভাবে তার ইচ্ছায় তোমার ভাগ্যকে ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে দিতে পারে”।
ইরফানের বেলায় তাই হলো। সেই দুঃস্বপ্নটা ঘটে গেলো। ঢাকা থেকে তারা কয়েক দিনের জন্য সিলেটে বেড়াতে বেড়িয়ে ছিল। পথে খাবারের জন্য বিরতি নিলো। রেস্টুরেন্টের খাবার টেবিলে বসার কয়েক মিনিট পরেই নাজমা মূর্ছিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। পরে তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়া হলো, প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার পর সিলেট যাত্রা ভঙ্গ করে ঢাকায় এনে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। টেস্টে ধরা পড়লো তার শরীরে ধষুযবরসবৎং রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। তার বয়স তখন মাত্র ষাট বছর হয়েছে। এই ঘটনার পর নাজমাকে নিয়ে ইরফান তাদের দেশ ভ্রমণ বাদ দিয়ে কানাডায় ফিরে আসলো। এক বছরের মধ্যে যেখানে ফার্ম হাউসে থাকার পরিকল্পনা করছিলো, তার পরিবর্তে নাজমাকে “কেয়ার হোমে” রাখতে ইরফান বাধ্য হলো। ইরফানের জীবনটা এক নিমেষে ওলোটপালট হয়ে গেলো। নাজমা অত্যন্ত সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, রুচিশীল মহিলা ছিলÑ যা কিনা যে কোনো পুরুষই সারা জীবন তার সাথে সুখে স্বাচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু নিয়তির কি পরিহাস, তার চিত্ত ভ্রংশ (ফবসবহঃরধ) হওয়ার ফলে তাদের জীবন থেকে সুখ হারিয়ে গেলো। তার মানে তাদের কে নিয়ে ভগবানের খেলা শুরু হলো।
অবশ্য ওই ঘটনাটি ঘটার আগেই ইরফান নাজমাকে প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখতো। সে প্রায় সময় কোন জিনিষটা কোথায় রাখতে হবে, বেমালুম ভুলে যেত, যেটা ওর সহজাত অভ্যাস ছিল না। তাছাড়া সে এক কথা বার বার বলতো। কিন্তু ও নিয়ে ইরফান বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। “ডিমেনশিয়া” রোগটি সনাক্ত হওয়ার পর ইরফান একবারে ভেঙে পড়লো, তবুও নাজমাকে সাহস জুগিয়ে যেতে লাগলো যেন ব্যাপারটা খুব একটা গুরুতর না। বললো, “সব কিছুই ভালোভাবে সেরে যাবে। কোনো চিন্তা ভাবনা করোনা লক্ষীটি” কথাটি শুনে নাজমা ইরফানের দিকে মৃদু হাসি দিলো, কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইরফান বুঝতে পারছিলো না তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে।
নাজমাকে কেয়ার হোম রাখার আগে তাকে দেখা শুনা জন্য এবং ইরফানের মনোবল জোগান দেয়ার জন্য বাসায় একজন খন্ডকালীন উপযুক্ত শিক্ষা প্রাপ্ত নার্স নিয়োগ করা হলো। দিনে দিনে নাজমার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে, আর তাকে নিয়ে ইরফান হাবুডুবু খাচ্ছে। রান্না বান্না ইরফানকে করতে হচ্ছে। প্রায় সময়ই খাবার-দাবার বাইরে থেকে কল করে খেতে হয়। ইরফানের হতাশার ভাব চরমে উঠলো যখন নাজমা নিজে থেকে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছিলো না, যার মানে সে মূল-মূত্র ধারণ করতে অক্ষম হয়ে পড়লো তার সাথে নিদ্রাহীনতায় ভুগতে শুরু করলো। অবশেষে জানাশুনা সবার উপদেশে নাজমাকে কেয়ার হোম রাখতে ইরফান বাধ্য হলো, যদিও নাজমা প্রথম দিকে যেতে চায়নি। যে দিন ইরফান নাজমাকে কেয়ার হোমে রেখে আসলো, সে দিনটি সে কখনো ভুলতে পারবে না। দিনটি মেঘলা ছিল। ফ্লাট থেকে একটা সুটকেস হাতে নিয়ে নাজমাকে বললো, “আমরা একটা সুন্দর হোটেলে যাচ্ছি, তুমি সেখানে খুব ভালো ভাবে থাকবে”। গত পঁচিশ বছর ধরে, তারা একসাথে বাস করছিলো ওই ফ্ল্যাটটিতে কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ একসাথে শেয়ার করেছে।
ছেলেমেয়েরা সেখানে বেড়ে উঠেছে। আজ কোথা থেকে কি হয়ে গেলো। ফ্লাট থেকে নাজমাকে বিদায় দেয়ার সময়টা ইরফানের কাছে মনে হচ্ছিলো কে যেন তার হৃদয়ের মাঝে, সেখানে এই ফার্ম হাউস দিয়ে কি হবে!
ক্রমে নাজমার কথা বলার শক্তি হারিয়ে যেতে লাগলো।সে সব সময় শিশুর মতো চারিদিকে কি যেন খুঁজে বেড়ায়। ইরফান নাজমার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি তার কানের কাছে বাজায়, তার ধারণা যদি সে গানগুলি শুনে কিছুক্ষনের জন্যে হলেও হাসি খুশীতে তার মন ভরে রাখতে পারে। শেষ বেলায় ইরফানের শুধু কামনা তার হাসি মুখটি দেখতে ,আর কিছু না।
নাজমা যখন মারা যায় তখন তার বয়স ছিল তেষট্টি। ইরফান এবং নাজমার বিবাহিত জীবন ছিল প্রায় চল্লিশ বছর। ইরফানের বেঁচে থাকার আর কোনো আগ্রহ রইলোনা, জীবনের প্রতি এক রকম বিতৃস্না এসে গেলো। নাজমার মারা যাওয়ার এক বছেরর মধ্যে কোনো রোগের উপসর্গ ছাড়াই ইরফান এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলো। সেই সাথে ভগবান তার খেলার সমাপ্তি টানলো। শেষ