ঋতু মীর : ১.
নীল অপরাজিতা রঙ আকাশ ছিল সেদিন! বৈশাখের প্রথম প্রহরের সূর্যটা গাছের পাতায় পাতায় টকটকে লাল আভা ছড়িয়ে আস্তে আস্তে হয়ে উঠছিল সোনা রঙ ঝলমলে। ভোরের নির্মল বাতাসে সেতারের ঝংকারে ভৈরবী রাগের পবিত্র মূর্ছনা। রমনা লেকের শান্ত জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে, কচি সবুজ ঘাসের ডগায় দোল দিয়ে কোমল সেই সুর বার্তা পৌঁছিয়ে দিচ্ছিল বটমূলে উপস্থিত প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। রমনা চত্বরের নুড়ি বিছানো লাল মাটির পথ ধরে ছায়ানট বিদ্যায়তনের শিল্পীদের সমবেত দলটি ধীর পায়ে এগিয়ে চলছিল বটতলা মঞ্চের দিকে। তাঁতের শাড়ী আর খোঁপায় ফুলের মালায় ছায়ানট ললনারা কি ভীষণ দৃষ্টিনন্দন! খদ্দরের পাঞ্জাবীতে ছেলেদের দলটিও যেন এক দীপ্ত সংস্কৃতি যোদ্ধা! সবার সমবেত কণ্ঠে উচ্চকিত সেই গান- ‘আলোকের এই ঝর্না ধারায় ধুইয়ে দাও’। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো অগণিত মানুষ ফুল ছড়িয়ে শিল্পীদের আহহ্বান জানাচ্ছে বর্ষবরণের। ভোরের বাতাসে নানা ফুলের মিশ্রিত সুবাসে মাতাল জোয়ার। সবাই যেন একাত্ম এক অনুভূতির আনন্দে সিক্ত, স্নাত, উদ্বেলিত-আজ ১লা বৈশাখ!
২.
ছায়ানটের সাথে গভীর সম্পৃক্ততার এই দৃশ্যপট এখন শুধুই স্মৃতি হলেও মনের মণিকোঠায় তা উজ্জ্বল, ভাস্বর! হৃদয়ের গভীরে কি অসাধারণ যত্নে লালিত এখনও! গান আত্মার নিরন্তর সঙ্গী, হৃদয়ের ডালে সবুজ এক পাখি, জীবনের এক নির্ভেজাল আনন্দ! গানেই আশ্রয়, গানেই প্রার্থনা গানেই সমর্পণ। হৃদয়ে বোধের মাত্রার এই ঐশ্বর্য অটল বিশ্বাসে ধারণ করি বলেই জাগতিক দীনতা এখনও করেনি ভিখারী, কোন অশুভ করেনি ম্লান, কোন প্রতিক‚লতায় আসেনি পতন। শুদ্ধ সংস্কৃতি বিকাশের মন্ত্রে, দীক্ষায়, আদর্শে উজ্জিবীত ছায়ানটের প্রতিটি নিবেদিত প্রাণ শিল্পী। ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েসন টরন্টো প্রবাসে ছায়ানটের যোগ্য প্রতিনিধি হয়ে বাঙলা বর্ষবরণের গুরু দায়িত্বটি পালন করে আসছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইখতিয়ার ওমর, আনোয়ার কবীর রুমি, জীবিনা সঞ্চিতা হক, মাহমুদুল আনাম, বিন্দু আনাম প্রমুখ সংগঠক যাঁদের ঐকান্তিক উত্সাহ এবং সংশ্লিষ্ট সদস্য শিল্পিদের নিরলস প্রচেষ্টা, সহযোগিতায় ২০০১ থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় ২২ বছর সময়কাল ধরে ছায়ানট এলামনাই প্রবাসে বাঙলা সংস্কৃতির ঐতিহ্যময় চেতনাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
৩.
অতিমারী করোনায় ‘ঘরে থাকা’ সামাজিক বিচ্ছিন্নতার এই সময়ে ১৪২৮ বাংলা বর্ষ বরণে ছায়ানট এলামনাই এসোসিয়েশন টরন্টো আয়োজিত ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান কি এক নষ্টালজিয়ায় নিমেষেই নিয়ে যায় রমনা বটমূলে। ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে’- গানের সাথে ছায়ানট এলামনাই আয়োজিত পুরানো অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপে চোখ আটকে যায়। এই প্রবাস, এই মঞ্চ, এই উত্সব, আয়োজন, সম্মিলিত কণ্ঠ, এই সতীর্থ সুহৃদ, নিজ সংস্কৃতির আজন্ম রোপিত শিঁকড় মননে ধারণ, একসাথে এই পথ চলা- এই প্রাপ্তি যে আসলেই পরিমাপহীন! এই অর্জন যে আসলেই জীবনের অমুল্য ধন! কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বকবি নজরুল ইসলাম এবং বিশ্ব বরেণ্য পঞ্চ কবিদের গান থেকে বাছাইকৃত গানে সমৃদ্ধ অনলাইন ভার্চুয়াল আয়োজনটি প্রযুক্তির সব সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে স্ব-মহিমায় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ‘প্রথম যুগের উদয় দিগঙ্গনে, প্রথম দিনের ঊষা, নেমে এলো যবে’ কুমকুম বলের সাবলীল কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের এই গান দিয়েই অনুষ্ঠানের সূচনা পর্ব। নজরুলের গানের অমুল্য সম্ভার থেকে পরিবেশিত গান ‘ভোরের হাওয়ায় এলে’ জুলফিয়া আহমেদ ইন্টুর কণ্ঠে আলাপের অলংকারে ভোরের ব্যঞ্জনাময় আবহ তৈরি হয়। ইয়াসমিন আনাম বিন্দুর কণ্ঠে ‘তুমি যতই দহনা দুখের অনলে আছে এর শেষ আছে’ এবং শিখা রউফের ‘মুসাফির মোছরে আঁখি চল ফিরে চল আপনারে নিয়া’ গান দু’টি বর্তমান সংকটপূর্ণ সময়ে এক অসাধারণ মন ছোঁয়া পরিবেশনা। নজরুলের লোক সংগীত ভিত্তিক গান আশরাফুল বারী মনজুর কণ্ঠে ‘আমার গহীন জলের নদী’ সারা বিল্লাহর ‘ভেসে আসে সুদুর স্মৃতির সুরভী হায় সন্ধ্যা’ এবং সুরাইয়াক সাদির গাওয়া ‘শুভ্র সমুজ্জল হে চির নির্মল’ গানগুলো নজরুল গীতিতে শিল্পীদের নিজ নিজ দক্ষতার প্রমাণ রাখে। পুজা পর্যায়ের গান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান নির্বাচন ছিল সময়পোযোগী এবং প্রশংসনীয়। মামুন কায়সারের কণ্ঠে ‘মহাবিশ্ব মহাকালের’, নিঘাত মুর্তজা শরমীর কণ্ঠে ‘জগতের আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’, রুমা রহমানের কণ্ঠে ‘আমার মন তুমি নাথ’ আনোয়ার কবীর রুমির কণ্ঠে ‘কোলাহলতো বারণ হল’, জ্যানেট গোমেজ এর কণ্ঠে ‘আলো যে যায়রে দেখা, ওই আলো’ জিবিনা সঞ্চিতা হকের কণ্ঠে ‘আমি বহু বাসনায়’, ইখতিয়ার ওমরের কণ্ঠে ‘হৃদয় শশী হৃদ গগনে’ এবং নাদিরা ওমরের কণ্ঠে অতুল প্রসাদের ‘আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে’র মত গানের নির্বাচন এবং শিল্পীদের পরিবেশনার মুন্সিয়ানা বারবার একথাই মনে করিয়ে দেয় যে- ছায়ানট আজ শুধু নাচ, গান বা কবিতা অনুশীলনের জন্য নির্দিষ্ট একটা কেন্দ্র নয়, ছায়ানট বাংলা সংস্কৃতির ধারক এবং বাহকও বটে! রাশেদা মুনীরের কণ্ঠে মহাদেব সাহার কবিতা ‘আমি যখন বলি ভালোবাসি’ এবং মাহমুদুল আনামের কণ্ঠে কবিগুরুর ‘সুপ্রভাত’ কবিতার নিবেদন নিঃসন্দেহে এক ভিন্ন আমেজ তৈরি করেছে।
৪.
পৃথিবী জুড়েই মানুষের জীবনে প্রযুক্তি কেন্দ্রিক ‘ভাল না মন্দ’ এই তার্কিক দ্ব›দ্বকে কেন্দ্র করে ঘটছে বাধ্যতামুলক পরিবর্তন। প্রযুক্তির ব্যবহার এবং তাতে নির্ভরশীলতা, শুদ্ধ, অশুদ্ধ, পরিমিত, অপরিমিত, আবশ্যকীয়, অনাবশ্যকীয়ভাবে মনের সুকুমার বৃত্তি বা আবেগকে কতটা এগিয়ে নিচ্ছে বা ধ্বংস করছে সেই বিতর্ক আজ এই পরিসরে নয়। আমি শুধুই এক বিমুগ্ধ শ্রোতা! ছায়ানট সতীর্থদের সাথে একসাথে এক মঞ্চে এক আদর্শে গান গাওয়া গর্বিত সদস্য। আমার মুগ্ধতা আজ আকাশ ছুঁয়েছে! আমার মগ্নতা আজ সবুজ এক পাহাড়ের উচ্চতায় হেলান দেয়া আবেশে বিহ্বল! গানের, কবিতার, কথার, গায়কীর, পরিবেশনার শুদ্ধ, অশুদ্ধ, পরিমিতি, অপরিমিতির চুলচেরা বিশ্লেষণের ক্ষমতা এই কলমের নেই। এই ভার ছায়ানটের অগণিত গুণমুগ্ধ দর্শক শ্রোতার। আমি আজ সত্যি অভিভূত, বিস্মিত এই ভেবে যে- হৃদয়ে কোন অনির্বাণ শিখা জ্বলে উঠলে শিল্পীর কণ্ঠ, তাঁর গান, গায়কী সীমাবদ্ধতার সীমানা ছাড়িয়ে সুরের ইন্দ্রজালের মোহে এই দুঃসময়েও মনকে জাগিয়ে তুলতে পারে। অন্তরালে যাদের অক্লান্ত অবদান অনুষ্ঠানকে সাফল্যের পূর্ণমাত্রায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করেছে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। শুধু বলার জন্যই এই বলা নয়! ছায়ানট এলামনাই আজ সামগ্রিকভাবেই ঋণী আয়েশা আক্তার জলি, স্নেহাস্পদ মুনিক আনাম এবং ছায়ানট এলামনাই শিল্পীদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি। অন্তরালে এই কাজের প্রসারিত হাত না থাকলে একটা সার্থক অনুষ্ঠান উপহার দেয়া সম্ভব হতো না। উল্লেখ্য করা বাহুল্য হবে না যে, সংঘটনের আহ্বায়ক আনোয়ার কবীর রুমির নিপুণ পরিকল্পনা নিরলস প্রচেষ্টা এবং দায়িত্ববোধ এই মহান উদ্যোগকে পূর্ণ মাত্রায় সাফল্যে পৌঁছে দিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ জ্ঞাপন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি না শ্রদ্ধাস্পদ ইখতিয়ার ওমর স্যারের হাতে ধরে গান শেখানোর কঠিন দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালনের প্রসঙ্গ এখানে এড়িয়ে যাই। প্রতিনিয়ত শঙ্কায় আজ প্রশ্ন জাগে মনে- বাঙলা গানের যে অসাধারণ মাধুর্য, বাণী, সুর, ছন্দ, তান, লয়ের মিশ্রণে যে অপরূপ লাবন্য সেগুলো কি সংরক্ষণ আর চর্চার অভাবে হারিয়ে যাবে চিরতরে? আজকের প্রজন্ম বাঙলা সংস্কৃতির অন্তঃস্থিত নির্যাসটা নিজ তাগিদে খুঁজে নেবে কি? অন্তরের অভিনন্দন প্রিয় সতীর্থ! প্রজন্মকে উত্সাহিত করে নিজ সংস্কৃতির বলয়ে ধরে রাখা, ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব যে এই মুহূর্তে আমাদেরই! শুদ্ধ সংস্কৃতির প্রজ্বলিত মশালটি বয়ে নিয়ে চলার গুরুভার আজ আমাদেরই হাতে। আমরা যেন বিনয়ে, নম্রতায় আরও শুদ্ধ হতে পারি, হতে পারি সা¤প্রদায়িকতা মুক্ত এক মানবিক মানুষ! মহাদেব সাহার কবিতার পংতি আমাদের মিছিলে হোক শ্লোগান -‘আমি যখন বলি ‘ভালবাসি’ তখন শুদ্ধ হয় জীবন… /আমি যখন বলি ‘ভালবাসি’ তখন শীতের দেশে আসে বসন্ত/ তখন মরা গাঙে আসে জোয়ার…/ আমি যখন বলি ‘ভালবাসি’ তখন পৃথিবীতে সব যুদ্ধ থেমে যায়!