অনলাইন ডেস্ক : করোনা নিয়ে ‘তুই ছুঁয়ে দিলে লাশ হয়ে যাই’ শিরোনামে একটি গান করেছেন মনির খান। মিলটন খন্দকারের কথা ও সুরের এই গানটি বেশ আলোচিত হয়েছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। করোনাকালীন সময় কেমন কাটছে জানতে ফোন করলে জানা যায়, লকডাউনের শুরু থেকে তিনি ঢাকায় নেই।
আপনাকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। কোথায় আছেন? কেমন আছেন?
আমি এখন গাজীপুরের মাওনাতে। এখানে আমার বাগানবাড়ি আছে। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে লকডাউনের শুরু থেকে এখানে আছি। কাজ থাকলে ঢাকায় যাওয়া হয়।
কী ধরনের কাজে বের হন?
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইউটিউবের জন্য গান করছে। আমার নিজেরও ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম আছে, সেখানেও নতুন গান আপলোড করছি। এই করোনায় ‘তুই ছুঁয়ে দিলে লাশ হয়ে যাই’ গানটি করেছি।
কোন ভাবনা থেকে বাগানবাড়ি করেছিলেন?
১৪ বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়ি করেছি। আমি গ্রামের ছেলে, জন্মও গ্রামে। শহরে যতই বড় দালানকোঠা দেখি না কেন, আত্মা তো ভরে না। যখনই গানবাজনা শুরু করেছিলাম, ভেবেছি, যদি কোনো সুযোগ হয়, পরিবার ও সন্তানদের গ্রামীণ পরিবেশে গড়ে তুলব। সেই ভাবনা থেকে বাগানবাড়ি করা। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে জমি কিনেছিলাম। এরপর বাউন্ডারি দিয়েছি, ঘরবাড়ি করেছি। পুকুর আছে। অনেক গাছপালা লাগিয়েছি। বসবাস করার পরিবেশ করেছি ২০১০ সাল থেকে। সেই থেকে আসা–যাওয়া।
আপনার তো দুই সন্তান। বাগানবাড়িতে তাদের কেমন লাগে?
শুরু থেকেই তারা খুবই আনন্দ উপভোগ করে। তারা এ–ও বলে, ‘বাবা, এখানে ভালো স্কুল পেলে আমাদের ভর্তি করিয়ে দাও।’ আমার মেয়ে বড়, ভিকারুননিসায় ক্লাস টেনে পড়ে। আর ছেলে ক্লাস থিতে।
বাগানবাড়িতে গানের চর্চাও চলে?
আমার নিজের চর্চার জন্য তানপুরা, হারমোনিয়াম সবকিছুর একটা সেট রেখেছি। জীবনের এই সময়ে এসেও গানের চর্চার ক্ষেত্রে আমি কোনো সময় নষ্ট করিনি। আমার নিজস্ব জায়গার যেখানে কিছু সময় কাটাই, সেখানে গানচর্চার ইনস্ট্রুমেন্ট আছে, অবসর সময়টা যেন গানের সঙ্গে কাটাতে পারি। ঢাকার অফিসে যেমন হারমোনিয়াম আছে, তেমনি বাসায়ও আছে, গ্রামেও আছে, এখানে তো আছেই।
তাহলে তো লকডাউনের এই সময়টা ভালোই কেটেছে?
নিজেকে রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধির যা যা মানা দরকার, মেনে চলেছি। আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এখানে একদমই আলাদা। বাইরের লোক এখানে ঢোকে না। প্রয়োজনে কাউকে ডাকলে আসেন, দূর থেকে কাজ সেরে নিই। আমার বাগানবাড়িতে চাল আর আনুষাঙ্গিক কিছু জিনিস ছাড়া মাছ, মুরগি, শাকসবজি, তরিতরকারি সবই আছে। গরুও আছে। এরই মধ্যে ১০০ ছাগল নিয়ে ফার্ম শুরু করতে যাচ্ছি। মাছের একটা প্রজেক্টও (বায়োফ্লক) শুরু করছি। নতুন কিছু ফলের গাছও লাগাব। কৃষিভিত্তিক কিছু চিন্তা চলছে।
ভিন্ন ধরনের চিন্তা করছেন কেন?
সুদূরপ্রসারী চিন্তা করছি। আমার মনে হয়, বর্তমান পৃথিবীর আগের সেই স্বাভাবিক পর্যায় ফিরে পেতে বহু সময় লাগবে। সৃষ্টিকর্তা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নিয়ে যাবেন কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। আমরা শিল্পী মানুষ। মানুষের জীবনে স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশ না থাকলে সংগীত হয় না। সংগীত মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু পাঁচটি চাহিদা পূরণ শেষে ছয় বা সাত নম্বরে। চিন্তা করলাম, গান বাজনা তো আছে, এটা থেকে দূরে সরা যাবে না, তবে নিজের বাঁচার জন্য কারও কাছে হাত পাততে তো পারব না। বিকল্প একটা আয়ের ব্যবস্থা করে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকলাম, পরিশ্রমও করলাম। শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকল। ঢাকা থেকে গাজীপুর যেতে এখন দেড় ঘণ্টা লাগে। অনেকগুলো কাজ একসঙ্গে নিয়ে ঢাকায় গেলাম, শেষ করে পরদিন চলে এলাম। এবার গেলেও কয়েকটা গানের রেকর্ডিং শেষ করে আসব।
করোনায় তো সংগীতাঙ্গন কঠিন সংকটে পড়েছে?
ভীত হলে চলবে না। মানুষের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত সংগ্রামের। সংগ্রাম করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এটাও একটা যুদ্ধ সময়, অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে। তবে এই সময় থেকে মানসিক শক্তি নিতে হবে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে, পরিচ্ছন্নভাবে যার যতটুকু কাজ করার সামর্থ্য আছে, তা দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নতুনদের মধ্যে অনেক মেধাবীরা আছে। অনেকে আবার খুব ভালো করছে। আমার একটাই অনুরোধ, চর্চার মাধ্যমে নিজস্ব কিছু গানের পুঁজি করতে হবে। অন্যের গান গেয়ে নিজেকে প্রমাণ করার কিছু নেই। নিজেদের সৃষ্টির দিকে নজর দিতে হবে বেশি। আমাদের দেশে এখনো গুণী অনেকেই আছে, তরুণদের উচিত তাঁদের কাছ থেকে ভালো কিছু গান নিজেদের জন্য তৈরি করে রাখা উচিত। এই যেমন আমার সন্তান বুক ফুলিয়ে বলে, এটা আমার বাবার গান। আমার পরের প্রজন্মের বন্ধু, ভাই ও সহকর্মীদের সন্তান, ভাইবোন আর পরিবারের সদস্যরাও যেন এটা বলতে পারে।
আপনার সন্তানেরা আপনার গান শোনে?
খুব শোনে। ইউটিউবে আমার একটা গান আপলোড হলে, ভিউ বাড়তে থাকলে—দুই সন্তান মুঠোফোন হাতে নিয়ে প্রতি ঘণ্টায় আমাকে রিপোর্ট করে। বলে, ‘বাবা, তোমার গান তো ঘণ্টায় এত হাজার ভিউ হয়েছে, এক দিনে এত লাখ পেরিয়েছে।’
গানে আপনি অঞ্জনার কথা বলেছেন। এখনো বলছেন। সন্তানেরা কি অঞ্জনা কখনো কিছু জানতে চেয়েছে?
আমার মেয়েটা খুব চুপচাপ। বাড়তি কথা একদমই বলতে চায় না। তবে অঞ্জনার ব্যাপারটা সে জানে, কারণ ওর জন্মের আগে থেকে তো এসব হয়ে আসছে। গাড়িতে তেলের ট্যাংকে যেমন লেখা থাকে, জন্ম থেকে জ্বলছি, তেমনি জন্ম থেকে শুনছি। (হাসি) তবে ওভাবে জিজ্ঞেস করেনি।
আপনার স্ত্রী কখনো জানতে চায়নি?
বিয়ের আগেই ওর সঙ্গে অঞ্জনা নিয়ে আলোচনা করেছি। বলেছি, দেখো এটা আমার গানের একটা চরিত্র। যেমন ফকির আলমগীর ভাইয়ের সকিনা, নচিকেতার নীলাঞ্জনা, অঞ্জন দত্তের রঞ্জনা। আমার অঞ্জনাও এ রকম একটা চরিত্র।
রাজনীতি করতেন, এখন আর রাজনীতিতে নেই। এ নিয়ে কোনো দুঃখবোধ আছে কি?
রাজনীতির কারণে আমার ক্যারিয়ারে ক্ষতি হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি সব অর্থে বড় নয়। রাজনীতির কারণে আমার শ্রোতারা মানসিক কষ্ট পেয়েছে। আমার প্রতি শ্রোতাদের যে আশা ছিল, রাজনীতির কারণে তা দিতে পারিনি। তবে এটা বুঝতে পেরেছি, যে কটা বছর এভাবে রাজনীতিতে ছিলাম শ্রোতারা অনেক কষ্ট পেয়েছে।
শুধুই কি শ্রোতারা কষ্ট পেয়েছে? আপনি?
আমি সৃষ্টিকর্তার প্রতি সব সময় আস্থা রাখি। ২০১৮ সালের ৯ নভেম্বরে যে সংবাদ সম্মেলন করেছি, কারও বুদ্ধি নিইনি। আমাকে যখন বিএনপির গুলশান অফিস থেকে বলা হলো, মনোনয়ন দেওয়া যাচ্ছে না, তখনই ঠিক করেছি, এখানে আর যুদ্ধ করার দরকার নেই। আমি ব্যর্থ। সৃষ্টিকর্তার নির্দেশেই এটা হয়েছে, হাসিমুখে মেনে নিয়ে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি। যা বলেছি, বীরদর্পে বলার চেষ্টা করেছি।
আবার কখনো কি রাজনীতি আসবেন?
সম্ভাবনা কম। দ্বিতীয়বার যেতে ভয় করে।
সম্ভাবনা কম বলছেন, তার মানে সম্ভাবনা কিছুটা আছে কি?
আর কোনো দিন রাজনীতিতে আসব না। আমৃত্যু গান নিয়ে থাকব। ইদানীং কৃষিকাজে আগ্রহ জন্মেছে আবার। আমি গ্রামের মানুষ, এগুলো জানিও। গান আর এই কৃষিভিত্তিক কাজগুলো করে যাব। জীবন আর কদিন, আমার দুই সন্তানকে মানুষ করতে পারলেই সার্থকতা।
বহুদিন পর অঞ্জনা সিরিজে আপনার গাওয়া ‘অঞ্জনা বড় বেইমান’ গানটা বেশ আলোচিত হয়েছিল। অনেকে গানটাকে রাজনৈতিকভাবে দেখেছেন। গানটি নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
এটা ঠিক, কিছু মানুষ গানটাকে পলিটিক্যালি ভিডিওচিত্র করে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছে। আমি যেহেতু রাজনীতি থেকে দূরে চলে আসছি, অনেকের তা ভালো লাগেনি। তারা যেকোনোভাবে আমাকে বিতর্কিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত পারেনি।
গান তৈরির গল্পটা কী তাহলে?
রাজনীতির কারণে আমি চার বছর অঞ্জনা নিয়ে গান করিনি। এই বিরতি থাকার কারণে আমি আর মিলটন ভাই অঞ্জনা সিরিজের গান কীভাবে শুরু করব, ভাবছিলাম। আমি বললাম, চার বছর যেহেতু অঞ্জনা নিয়ে গান করিনি, শ্রোতারাও খুব বিরক্ত, অঞ্জনা গান দিচ্ছি না। রাজনীতি ছাড়া এই সিরিজের গান না করার আরও কিছু কারণ ছিল। বিভিন্ন কোম্পানি অ্যালবাম বের করছিল না। সবই অনলাইনে। ভাবলাম, অঞ্জনা দিয়ে সবাইকে ধাক্কা দিতে হবে, যেন শ্রোতারা গানটি শুনেই ভেবে নেয়, এটাই আমরা চাইছিলাম। তখন মিলটন ভাই বললেন, তাহলে সহজ কথা দিয়ে হবে না। তখনই এমন কথার গান তৈরি করা। এটাকে রাজনৈতিক রং দেওয়াটা অবান্তর। আমি গানের কথায় বলেছি, ‘ওরে তোর শরীরে মীরজাফরের রক্ত,/ ও তোর পিতা-মাতা সীমারের ভক্ত,/ রাজাকারের মতো যে তুই করলি বেইমানি,/ বাংলাদেশের জন্ম যে তোর স্বভাব পাকিস্তানি,/ দেশের প্রতি প্রেমের প্রতি ছিল না যে তোর টান,/ তবুও তোর প্রতি আছে আমার অনেক সম্মান,/ লোকে বলে বলেরে, অঞ্জনা বড় বেইমান।’ মানুষের অন্তরে ধাক্কা দেওয়ার জন্য কৌশলটা নিয়েছি। সব কটি শব্দ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত। বিষয়টা এমন নয় যে, এই শব্দগুলো আমি রাজনীতি ছাড়ার পর আসছে।
অঞ্জনা নিয়ে আরও গান আসবে কি?
এটা যেহেতু সিরিজ, সামনে আরও গান আসবে।
রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের সেবা করতে চেয়েছিলেন। এখন কি তা চলছে?
আঁধারে, নীরবে, নিভৃতে সেবা করাটা আমার প্রতিনিয়ত চলে। লোক দেখিয়ে মানুষের সেবা করতে চাই না। এখন অনেককে দেখি, এক কেজি চাল দিচ্ছে, দশটা ক্যামেরা, এ ধরনের সেবার কোনো মানে নেই।