ফরিদ আহমেদ : বারোক যুগের (১৬০০-১৭৫০) সেরা নারী চিত্রশিল্পী হিসাবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে। রোমে জন্মেছিলেন তিনি। নাম তাঁর আর্তেমিসিয়া জেনটিলেসকি। জন্মেছিলেন ১৫৯৩ সালে।
আর্তেমিসিয়ার আঁকা একটা ছবি আছে, নাম হচ্ছে ‘জুডিথ সিভিয়ারিং দ্য হেড অব হলোফারনেস’। এই ছবিতে দেখা যায়, একজন ইহুদি বিধবা নারী জুডিথ তার চাকরানি আবরাকে সাথে নিয়ে ছুরি দিয়ে আসিরিয়ান জেনারেল হলোফারনেসের গলা কেটে দিচ্ছে। না কেটে কোনো উপায়ও নেই তাদের। তারা এই কাজটা না করলে এই জেনারেল তাদের পুরো স¤প্রদায়কেই ধ্বংস করে দেবে। জেনারেলের গলা থেকে ফিনকি দিয়ে ছিটে আসা রক্তে ভেসে যাচ্ছে জুডিথের কাপড়।
এই থিমটা বাইবেল থেকে এসেছে। আর্তেমিসিয়ার আগেও আরো অনেক শিল্পী এটা নিয়ে কাজ করেছেন। তা সত্তে¡ও আর্তেমিসিয়ার এই ছবিটা চোখে পোড়ে। যে ঘৃণা, ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা এবং তীব্র সংকল্প নিয়ে জুডিথ গলা কাটার কাজটা করছে, সেটা এতোই জীবন্ত যে দর্শকের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে।
এই তীব্র ঘৃণা কি কল্পনা থেকে এসেছে, নাকি শিল্পীর নিজের মন থেকেই উঠে এসেছে? খুব সম্ভবত এই ঘৃণার চাষ আর্তেমিসিয়ার নিজের মন থেকেই উঠে আসা। যে কারণে এটা বলছি, সেটা ব্যাখ্যা করলেই বুঝতে পারবেন।
মাত্র আঠারো বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন আর্তেমিসিয়া। তাঁকে ধর্ষণ করেছিলো তাঁর নিজেরই শিক্ষক। এই প্রসঙ্গে যাবার আগে আর্তেমিসিয়া সম্পর্কে একটু ধারণা নিয়ে নেই আমরা।
আর্তেমিসিয়ার বাবা ওরাযিও জেনটেলেসকিও ছিলেন একজন বিখ্যাত শিল্পী। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ফুমাটো কৌশলের বিপরীতে সেই সময়ে আরেকটা কৌশল জনপ্রিয় ছিলো। এটাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন শিল্পী কারাভাগিও। তাঁর নামে এটা কারাভাগিও কৌশল নামে পরিচিত ছিলো। ফুমাটো কৌশলে যেখানে প্রান্ত গুলো মিশে যেতে থাকে, সেখানে কারাভাগিও কৌশলে আলো এবং ছায়ার তীব্র বৈপরীত্য এনে প্রান্তগুলোকে উজ্জ্বলতা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে চিত্রের মাঝে নাটকীয়তা নিয়ে আসা হয়। ওরাযিও এবং কারাভাগিও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ফলে, খুব সহজেও ওরাযিও এই কৌশলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আর্তেমিসিয়াও সারাজীবন এই কৌশলে ছবি এঁকেছেন।
ওরাযিও-র চার সন্তানের মধ্যে আর্তেমিসিয়াই ছিলো একমাত্র কন্যা সন্তান। কন্যাকে চিত্রশিল্পী বানানোর উদ্দেশ্যে নিজেই তাঁকে শেখানো শুরু করেন তিনি। আর্তেমিসিয়ার যখন বারো বছর বয়স, তখন তাঁর মা মারা যায়। সেই সময় থেকে শুরু করে বাকিটা সময় পুরুষদের মাঝেই সময় কেটেছে তাঁর। ঘরে বাবা আর তিন ভাই। স্টুডিওতে বাবার ছাত্ররা সবাই পুরুষ।
চিত্রশিল্পে কন্যার দক্ষতা দেখে, সেটাকে আরো উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য ওরাযিও শিক্ষক নিয়োগ দেন। আর্তেমিসিয়ার শিক্ষক হিসাবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো, সেই আগোস্টিনো টাসি নিজেও একজন নামকরা শিল্পী ছিলেন। ইলুশোনিস্টিক আর্কিটেকচারাল পেইন্টিং এ দক্ষ ছিলো টাসি। আর্তেমিসিয়া টাসির কাছ থেকে পারসপেক্টিভ এর সূক্ষ্ম বিষয়গুলো শিখবে, এটাই ছিলো ওরাযিও-র আশা।
ওরাযিও-র সেই আশার গুড়ে বালু ঢেলে দেয় টাসি। শিক্ষকের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে সে এবং একজন ছাত্রীর শিক্ষকের প্রতি যে আস্থা এবং বিশ্বাস থাকে, সেটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। এক প্রতিবেশী নারীর সহায়তায় আর্তেমিসিয়াকে ধর্ষণ করে সে।
ধর্ষণ করার পরেই নিজে বিপদ বুঝতে পারে টাসি। ওরাযিও তাঁর কন্যার এই অসম্মানকে সহজভাবে নেবেন না। ফলে, টাসি শরণাপন্ন হয় আর্তেমিসিয়ারই। তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় সে। পুরুষতান্ত্রিক সেই সমাজে ধর্ষণের শিকার নারীকেই সামাজিক লজ্জা এবং ধিক্কার বহন করতে হতো। সামাজিক সেই বিড়ম্বনা ভয়ে আর্তেমিসিয়াও চেপে যায় তাঁর ধর্ষণের কথা। টাসিকে প্রেমিক হিসাবে বেছে নেন তিনি।
সমস্যা দেখা দেয় কয়েক মাস পরে। টাসি বিবাহিত, তার বউ আছে, এই খবর প্রকাশ পেয়ে যায়। টাসির বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন আর্তেমিসিয়ার বাবা ওরাযিও। বিচার চলাকালে কুমারীত্ব পরীক্ষা করা হয় তাঁর। দুইজন মিডওয়াইফ তাঁকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করে রায় দেয় যে আর্তেমিসিয়া কুমারী নন, তাঁর হাইমেন অক্ষত অবস্থায় নেই।
আদালতে তাঁর ধর্ষণের বিষয়ে আর্তেমিসিয়া যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেটা হৃদয় বিদারক। তিনি বলেছিলেন, “সে আমার কাপড় খোলার চেষ্টা করলো। আমি প্রচুর বাধা দিয়েও তাকে ঠেকাতে পারিনি। আমার চিৎকার থামানোর জন্য সে আমার মুখে রুমাল গুঁজে দিলো। আমি চিৎকার করার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, তুজিয়াকে ডাকতে চাইলাম। আমি তার মুখে খামচি দিলাম, তার চুল ধরে সজোরে টান দিলাম। …. সে তার কাজ শেষ করে আমার উপর থেকে উঠে পড়লো। আমি নিজেকে মুক্ত পেয়েই টেবিল ড্রয়ারের দিকে ছুটে গেলাম। সেখান থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে আগোস্টিনোর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমার অসম্মান করার জন্য এই ছুরি দিয়ে আমি তোমাকে খুন করবো।
শুধু মুখের কথায় হয়নি, মধ্যযুগের এক ধরনের তীব্র যন্ত্রণাদায়ক লাই ডিটেক্টর পদ্ধতি, যার নাম ছিলো ‘সিবিল’, সেটার মধ্য দিয়ে গিয়ে তাঁকে এই বর্ণনা দিতে হয়েছে, যাতে করে আদালত বুঝতে পারে যে তিনি সত্য কথা বলছেন।
বিচারে ওরাযিও জয়ী হন। টাসিকে রোম থেকে বিতারিত করার রায় ঘোষিত হয়। যদিও এটা আসলে কার্যকর করা হয়নি কখনো। বিচারে জয়ী হলেও আসল ক্ষতিটা হয়ে যায় আর্তেমিসিয়ার। রোমে ওরাযিও-র উচ্চ মর্যাদা থাকলেও ধর্ষণের শিকার তাঁর ‘অসম্মানিত’ কন্যাকে কেউ বিয়ে করতে আসে না। ফ্লোরেন্সের একজন ছোটখাটো শিল্পীর সাথে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। রোম থেকে ফ্লোরেন্সে চলে যান তিনি। বিয়ের কারণে না, অনেকটা রোম থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। রোমে যখনই তাঁর নাম আসতো, ‘নষ্টা মেয়ে’ হিসাবে হাসাহাসি করতো লোকে, ঘৃণা প্রদর্শন করতো তাঁর প্রতি।
ফ্লোরেন্সেই নিজেকে শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। যদিও এই কাজটা খুব একটা সহজ কোনো কাজ ছিলো না। নারী শিল্পীদেরকে পুরুষতান্ত্রিক ইতালিয়ান সমাজ খুব একটা মূল্য দিতো না। মেয়েরা শিল্প-সাহিত্য বোঝে না, তাদের দ্বারা ভালো কোনো কাজ করা সম্ভব না, এই রকম একটা বদ্ধ ধারণা নিয়ে তারা চলতো। আর্তেমিসিয়াকেও নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য তাই সংগ্রামই করতে হয়েছে। নিজের মূল্য বোঝানোর জন্য চিঠি লিখতে হতো তাঁকে। সেই রকম এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘You think me pitiful, because a woman’s name raises doubts until her work is seen.” ‘I will show Your Mosr Illustrious Lordship what a woman can do.’ ‘You will find the spirit of Caesar in this soul of a woman.”
ফিরে আসি আবার সেই ‘জুডিথ সিভিয়ারিং দ্য হেড অব হলোফারনেস’ ছবিতে। যদিও বাইবেলের থিমকে এঁকেছেন তিনি, কিন্তু এই ছবিতে কি আর্তেমিসিয়ার নিজের ঘৃণাও প্রকাশ পেয়েছে? জুডিথ নয়, তাঁর কি মনে হয়েছে যে তিনিই টাসিকে হত্যা করছেন। ধর্ষণের পরে যেমন ছুরি হাতে হত্যা করতে গিয়েছিলেন টাসিকে, সে রকম কিছু? খুব সম্ভবত। কারণ, ছবিতে আসিরিয়ান জেনারেলের চুল কালো, গালে দাঁড়ি রয়েছে। টাসিরও ঠিক এরকমই ছিলো।
শুধু ‘জুডিথ সিভিয়ারিং দ্য হেড অব হলোফারনেস’-ই নয়, আর্তেমিসিয়ার আঁকা ছবিগুলোর প্রায় সবগুলোতেই জুডিথের মতো শক্তিশালী নারীদের উপস্থিতি রয়েছে। তাঁর আরেকটা ছবি হচ্ছে ‘সুজানা এন্ড দ্য এল্ডার্স’। এটাও ওল্ড টেস্টামেন্টের থিম থেকে আঁকা। ছবিটা এঁকেছিলেন তিনি মাত্র সতেরো বছর বয়সে। সুজানা নামের এক তরুণী স্নান করছিলো। দুই বাদমায়েশ বুড়ো লুকিয়ে লুকিয়ে সেই তরুণীর সেই স্নান দেখছিলো। শুধু দেখাতেই তারা থামেনি। কামোত্তেজিত হয়ে সুজানাকে কাম প্রস্তাব দেয় তারা। সুজানা রাজি না হওয়ায় তাকে ভয় দেখায় যে তার বিরুদ্ধে ব্যাভিচারের অভিযোগ আনবে তারা। ব্যাভিচারের সাজা তখন মৃত্যুদণ্ড। মেয়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগটুকু আনলেই হলো, সেগুলো খতিয়ে দেখারও কোনো অবকাশ থাকতো না। মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেওয়া হতো প্রবল আক্রোশে। দুই বুড়ো ভামের এমন ভয় দেখানোর পরেও সুজানা থেকে যায় ঋজু এবং দৃঢ়, প্রত্যাখ্যান করে অনৈতিক প্রস্তাবকে।
বিংশ শতাব্দীতে এসে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হন আর্তেমিসিয়া জেনটিলেসকি। বিশেষ করে নারীবাদীরা তাঁকে নিয়ে উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠেন। মধ্যযুগের সেই চরম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে থেকেও তিনি তাঁর ছবিতে নারী চরিত্রগুলোকে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন, ঋজুতা দিয়েছেন, দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়েছেন, ঠিক যেভাবে তিনি নিজেও ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।