হিমাদ্রী রয় : কবির ভাষায় ‘ফাগুন এলেই কোকিল ডাকে থেকে থেকে ডাকে’। কোকিলের বুলি কার না ভালো লাগে। আর এক হচ্ছে কাক- যখনি সে ডাকে দুর-দুর করে তাড়াতে আসি! কেন ভাই কাক কি কারো দাওয়ায় চুরি করতে আসে, অবশ্যই না। আর কোকিলও আমাদেরকে মণি-মাণিক্য দিতে আসে না। তবু তার কুহুতান শ্রবণের পথ ধরে ধরকনে গিয়ে নাড়া দেয়। বুলিই সবকিছু। তাই কোকিলের মধুর তান শুনে যে শব্দ জাগে কানে তা হলো মা, মায়ের ভাষা। আমাদের অস্তিত্বের ধুন শোনায় আমার ভাইয়ের, মায়ের খুনে রাঙানো ফাগুন।
ফাগুন এলেই কেবল মা’য়ের কথা মনে হয়। না মা’য়ের জন্মদিন বা মৃত্যু দিন কোনটিই নয়। আমাদের মা’য়ের জন্মদিন কোনটি মা আমাদের বলেননি, আমরাও জানতে চাইনি কোনদিন। ভগীরথ যেমন গঙ্গার ধারার উৎস তেমনি পৃথিবীর জন্মলগ্নে মমতার ধারার যেদিন জন্ম, মা’য়েদের জন্মদিনও নিশ্চয় সেটি মা’রা শরীর ছেড়ে চলে যায়। যেমন আমার গেছেন অনেকের মতো, শুধু মা’য়ের বুলি থেকে যায় কাছে।

‘গ্রীষ্ম দগ্ধায়, শ্রাবণ, বর্ষায়, শীত আসে ফিরে যায়’। ফাগুনে কৃষ্ণচূড়া ভেসে যায় মা’য়ের পায়ের আলতার রঙের বন্যায়।

কোকিলের বুলির জন্য তাও ঋতু বদলের অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু মা এমন এক বুলি, এক ভাবনা- এমন এক কান্না যা বর্ষণের জন্য কোন ঋতুর অপেক্ষা করতে হয় না।

আমাদের উৎসবে, বসনে, রসনায় মা সর্বদা বিরাজমান। তা তিনি এই ধরাধামে থাকুন আর নাই থাকুন। আসুন তবে জীবনের ক্যামেরায় দেখি। আমার বৌ প্রায়শই তাদের ফিলিপিনো ট্রেডিশনাল ডিশ রান্না করে যাকে তারা বলে কনজি। চাল, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, চিকেন যোগ করে রান্না। আমাদের বাংলার যাউ ভাতের মতো। গত আঠারো বছর যাবৎ সে এই ডিশটি কোন না কোন সময় রান্না করেছে। প্রতিবারই আমি তাকে বলতে শুনেছি যে, মাম আরো আদা দিত কিংবা রসুন কম দিতেন। আমাদের বাঙালির রসুই ঘরে, বৌদি কিংবা ভাবীরা যখন রান্না করেন এই কথাটি বহুশ্রুত যে, আমার শাশুড়ী কিংবা মা এইভাবে কষাতেন ঐভাবে মশলা দিতেন। সর্বশেষ এটি শুনেছি সাহানা চৌধুরীর মুখে। তিন কাল যেয়ে অভিজ্ঞতার কালের ওপারে এসে তিনিও রান্নার গুণ করতে যেয়ে শাশুড়ির উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমার শাশুড়ি এইভাবে রাঁধতেন’। আবার তারই মেয়ে শাঁওলি যখন রান্না করে খাওয়ায়, বলবে- আম্মার মতো যদিও হয় না। তাই মা থাকা কিংবা না থাকা যে অবস্থাই হোক না কেন কখনই ভাবনা ছেড়ে যান না। সুতরাং মা শরীর ছেড়ে চলে যান কিন্তু তাঁর অস্তিত্বের মৃত্যু হয় না।

পৃথিবীতে একমাত্র বুলি মা’য়ের যা কখনোই বেসুরো হয় না। তাঁর ঘুম পাড়ানিয়া সুরে আমাদের গানের হাতেখড়ি। ঠাকুর ঘরে ধুপের ধোঁয়ায় লক্ষীর পাঁচালী আমাদের আত্মস্থ কবিতার উচ্চারণ শেখায়। মহাভারতের কর্ণ-কুন্তি মা’য়ের কাছ থেকে জানি, এখন পড়ি রবীন্দ্র কবিতায়। মা গালি দিয়ে আবার নিজেই কেঁদে উঠেন, বিঁধে উঠেন অনুতাপবাণে। কতবার মা আমাদের জীবন ফিরিয়ে দিয়ে নিজেই চলে যান বুঝতেই পারি না।
আমার মনে আছে জন্ম পরে আমাদের জশ যখন প্রথম স্তন মুখে নিল, কতবার রক্তাক্ত হয়েছে তার মায়ের স্তন। কিন্তু এতে মা’য়ের কোন ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। তবে উদ্বেগ থাকতো মুখ জুড়ে, সন্তানের দুধ খাওয়া হচ্ছে না ভেবে। এক স্তনে সন্তানের লাথ খেয়ে মা আরেক স্তন তুলে দেয় মুখে। এই শক্তি সৃষ্টি কেবল মা’য়েদের দিয়েছেন। মা ত্যাগের নাম, তপস্যার নাম, জীবনের বাগিচায় আত্মার কৃষ্ণচূড়া। গুচ্ছে গুচ্ছে উথলে উঠে ফুল, উড়ে আসে কালো কোকিল, ডাকে বসে শাখায়, ঠিক তখন মা’য়ের কথা মনে পড়ে যায়। প্রশ্ন আসতেই পারে যে, দেশে শুভ্রতায় মোড়ানো শহর আর গাছগুলো শুকনো মাটির কঙ্কাল সেখানে কৃষ্ণচূড়া কোথায়? আমাদের আবেগের দরিয়া সকল সমুদ্রের সঙ্গম স্থল। ‘দ্বীনের নবী মোস্তফায় রাস্তা দিয়া হাইটা যায় হরিণ একটা বান্ধা ছিলো গাছেরি তলায়’। মরুর দেশে হরিণ নাই গাছও নাই। আবেগে যদি নবীকে পাওয়া তবে বরফের দেশে কৃষ্ণচূড়াকেও পাওয়া যায়, যদি আবেগি হৃদয় দিয়ে দেখা যায়।

আমাদের আবেগের একটি মর্ম সঙ্গীত আছে তা হলো একুশের সুর, যে সুরে আমরা একুশের ভোরে পা’য়ে পা মেলাই, যে সুরে কোরানে পোরাণে কোন বিভেদ নাই। আর একুশের শহীদ মিনার হলো আমাদের মায়ের মজবুত কান্ধা যা শত কান্নায় স্যাঁতসেঁতে হয় না। সন্তানের ভারকে ভারি মনে করে না, শত্রুর থেকে মেহফুজ রাখে আমাদের।

আমাদের এই প্রাণের শহরে মা’য়ের মজবুত কান্ধা পেয়েছি আমরা, প্রাণের শহীদ মিনার। আশি হাজার অভিবাসী বাঙালির আশ্রয়, বনের কোকিলের অপেক্ষা না করে মনের কোকিলের সুরে আমরা সমবেত হবো একুশের প্রথম প্রহরে তুষার শীত উপেক্ষা করে। জন্মভূমি স্তনে মাতৃদুগ্ধ পান করা অজশ্র বাঙালি। করোনা নিয়ম বিধির কারণে এ বছর নয় হয়তো সামনের বছরগুলোতে। মা’য়ের পায়ের তলা যদি জান্নাত হয় তবে তবে মায়ের ভাষার মর্যাদা ধরে থাকা স্তম্ভ পূণ্যধাম।

মনে রাখতে হবে দেশদ্রোহী আর গরীবের হক মারা ইজ্জতদারদের দুর্নীতির অর্থে যেন এর একটি ইটের গাঁথুনি না হয় এই আবেগ আমি, তুমি, এর কিংবা ওর নয়- এই আবেগ আশি হাজার অভিবাসী বাঙালির। এ আমাদের অস্তিত্বের অধিকার। আর যদি তা হয় তবে ‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার অশ্রুধারা ধরার ধুলায় হবে হারা’। আমরা কি তেমন সন্তান? আমরা কি তবে ঐতিহ্য হারা? নিশ্চিত জানি আমরা তা নই। কেননা বাঙালি যতদুর মায়ের ভাষা ততদুর ‘তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’।