সাজ্জাদ আলী : যাক, বেঁচে আছি তাহলে! কপালগুণে ২০২২ সালের শুরুটা দেখতে পেলাম। গত দুই বছরে প্রতিদিনই মনে হয়েছে, এই বুঝি লীলা সাঙ্গ হলো। একটা কাশি এলে চাপিয়ে রাখার চেষ্টা। হাঁচিটা বেফাস বেরিয়ে গেলে ভয় পাই, চমকে উঠি। মনে হয় যেন নাকের ডগায় করোনা ভাইরাসগুলো লাফালাফি করছে। গলাটা মোটেই ব্যথা করছে না, তবুও সারাদিন তা টিপে টিপে দেখি। সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ, অথচ দিনে ১০ বার থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মাপি। যন্ত্রের রিডিং বলে ব্যটা তুমি ঠিকঠাক আছো। কিন্তু আমি তা মানবো কেন? রতœা কোথা থেকে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’ টাইপের সস্তা থার্মোমিটার কিনে থাকবে! এখন তা ভুল রিডিং দিচ্ছে।

একদিন নিজে ফার্মাসিতে গিয়ে তিন পদের তিনটি জ্বর মাপার মেশিন কিনে আনলাম। একটা কানে ঢুকিয়ে মাপতে হয়, আরেকটা বগলে। অন্যটা তো ১০০% ইলেকট্রনিক। কাছাকাছি দূরত্ব থেকে কপাল তাক করে সুইচ টিপলেই হলো। দিনে ৮/১০ বার মাপামাপি চলে। কিন্তু মনটা বেজার। কারণ কোনো থার্মোমিটারই গায়ে এতটুকু জ্বর খুঁজে পায়নি। ঘরের লোক আমার এমনতর কাণ্ডকীর্তি দেখে মুখ টিপে হাসে। তা সে হাসে হাসুক, আমি জ্বর মেপেই চলেছি। করোনা মহামারীর ভয়ে গত দুইটি বছর একেবারে জবুথবু হয়ে আছি।

আরো একটা মহামারীর আতঙ্ক স্মৃতিপট ঘিরে আছে। সেটি ছিলো কলেরার। তখন বয়স আর কত হবে? ওই যে বয়সে পরনের হাফপ্যান্ট খুলে পড়ে গেলেও কিচ্ছুটি যায় আসে না, সেই রকম বয়স। তো সে মহামারীর শুরুটা হয়েছিলো গাঁয়ের পশ্চিম পাড়ায়। এক ঘোর অমাবস্যার রাতে কলেরা-শাকচুন্নি নাকি ও পাড়ায় আছর করেছিলো। শেখদের বাড়ি আর বড়বাড়ির কারো কারো ঘরের চালে গিয়ে বসেছিলো। তা ৮/১০ ফুট লম্বা হবে। পরনে ধবধবে সাদা থান। দফাদারের বৌ নাকি আবছা আবছা দেখেছে, শাকচুন্নির গলা কাটা, মুন্ডু নাই! এমন সব গুজব নিয়ে গাঁয়ের লোকদের মধ্যে তুমুল জল্পনা কল্পনা! তবে অবিশ্বাস করার সাহস কারোরই নেই। কারণ প্রমাণ তো হাতেনাতে! পরদিন সকাল থেকেই তো ওই দুই বাড়িতে কলেরা মড়ক লেগেছে!

ছোঁয়াচে রোগ। কেউ পশ্চিম পাড়ার পথ মাড়ায় না। গোসলবিহীন, বিনা জানাজায় লাশ দাফন হচ্ছে। ঔষধ নেই, পথ্য নেই, চারিদিকে শুনশান হাহাকার! ঘরের দাওয়ায় শুয়ে রোগী পানির জন্য কাতরাচ্ছে। বাড়ির নেড়ি কুকুর ছাড়া আর কেউ তার কাছে যায় না। যে যাবে, তারই ওই একই দশা হবে। ক্ষিতিশ কবিরাজের বটিকাও এবার কোনো কাজে এল না। আর হরেন ডাক্তার তো সাফ বলেই দিয়েছে, সে কলেরা রোগের চিকিৎসা করে না। শুধু মুনতাজ পাগলা নিজের গরজে সারারাত পশ্চিমপাড়া পাহারা দেয়। ঘন ঘন হাঁক ছাড়ে, সাবধান! ইবলিসের বংশ হুশিয়ার!

দাদী বাড়ির দক্ষিণ দিকের অংশে আমাদের বাস। উত্তরের দিকটিতে জ্ঞাতিগোষ্ঠির অন্য স্বজনেরা থাকেন। হঠাৎ একদিন আমাদের উত্তর খলটের আছিরণ ফুফুর ভীষন দাস্ত-বমি শুরু হলো। পরদিন শেষ রাতেই সে চলে গেল। রোকেয়া ফুফুকে চারদিন ভুগিয়ে তারপরে মারলো। এরই মধ্যে আবার এসকেন কাকার মা আক্রান্ত! তার বমি উপসর্গ দেখা দিল বিকালে, পরদিন সকালেই লাশ দাফনের ব্যবস্থা নিতে হলো। মাত্র ৬ দিনের ব্যবধানে একই বাড়ির পাশাপাশি খলটে তিনজনের মৃত্যু। ভয়ের চোটে আমরা ঘর বন্দি। কখন শাকচুন্নি এসে ঘরের চালে বসবে, সেই ডরে নির্ঘুম রাত কাটে। দাদী আগে সকাল বিকাল তসবী টিপতেন, এখন দিনভর।

যাক সে কলেরার কথা। মানুষ তো তাকে কব্জা করেছে। ফিরে আসি আবার এখনও অজেয় করোনার যুগে। কাছের লোকদের মধ্যে প্রথম আক্রান্ত হলো আমাদের সুমু। অশুভ সেই খবরটি ওর আম্মা ফোন করে জানালেন। একমাত্র মেয়ে হসপিটালের স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে। ভেন্টিলেশনের মাধ্যমে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। ফোনের মধ্যে ভদ্রমহিলার সেকি কান্না! কাঁদছেন, আর মেয়ের সাথে তাঁর স্নেহ-শাসনের কথাগুলো বলছেন। সুমু আমাদের প্রিয়জন। অনেক কাজেরই পার্টনার। সবার কথাই সে কম বেশি শোনে। তবে মায়ের কথার উল্টো চলাটা যেন তার “এইম ইন লাইফ”। বোধকরি সে জন্যেই মায়ের অশ্রæধারা সেদিন বাঁধ মানছিলো না।

এর ক’দিন বাদে ফেসবুকের পাতা খুলতেই দেখি করোনা ছোবল মেরে সালাম ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে। মাগো মা—এ কী শুরু হলো চারিদিকে! সালাম ভাই আর নেই? ষাটের দশকে আব্বা যখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংগঠক, সে তখন গোপালগঞ্জের তুখোড় ছাত্রলীগার। পূরোনো হিসাব মনে রেখে টরন্টোতে তিনি আমাকে পিতৃসম স্নেহে আগলেছেন। সম্পর্কটা একেবারে ভিন্ন মাত্রার। মৃত্যুর ক’দিন আগেই ফোন করে বললেন, অ্যাই মুর্খ তোর বুদ্ধি বাড়ানোর জন্যি একখান বই রাখছি। সইন্ধ্যের দিক আইসা নিয়া যাইস।

আমি বললাম, না না সালাম ভাই বুদ্ধি বাড়াবো না। আপনি খালি মোটা মোটা ইংরেজী বই ধরাই দ্যান। ও পড়তে আমার ঘাম ছুইটা যায়। নতুন ডিকশানারি কেনা লাগে।
আরে পাগলা তুই আয়। এইবারের বইখান এক্কেবারে চলতি বাংলায় লেখা, এটুকু বলে সালাম ভাই ফোন রাখলেন। সেই শেষ কথা!

আরো কিছুদিন বাদে আম্মা ফোনে জানালেন, বুড়ির করোনা হইছে, এনায়েতও পজিটিভ। ও আমার পিঠাপিঠি ছোট বোনটি। দাপুটে মাস্টার সে। হাবেভাবে মনে হয়, যেন সব সময় তার বেত হাতে! করোনার তো দেখছি বেত্রাঘাতেরও ডর নাই! এরও ক’মাস বাদে ফুফাতো ভাই শিল্পী আর আর ছোট ভাই আলভী একই দিনে আক্রান্ত হলো। আলভী ঘরকুনো স্বভাবের। তাকে নিয়ে সমস্যা নেই। নতুন বইয়ের সাপ্লাই থাকলে সে ঘরের দরজা ভেজিয়েই রাখে। কিন্তু সমস্যা হলো শিল্পীকে নিয়ে। আধা বুড়ো ব্যটা, কিচ্ছু মানতে চায় না। সে মটর বাইক নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ‘তুলির ধমক’ ছাড়া অন্য কোনো নছিহত তার ্ওপরে কাজই করে না। আর শিল্পীকে ধমকাতে তুলি বড়ই কৃপণ।

মৃত্যু নিয়ে মানুষের চিন্তা বেশ দ্বিমুখি! মরতে যে হবেই তা সবাই জানি। কিন্তু কেউই ‘আজ মরতে’ রাজি না। ঠিক কখন জীবনের শেষ ঘন্টা বাজবে তা কারো জানা নেই। আর সে জন্যেই মরণ-ঝুঁকি আমরা সইতে পারি। সব সময় এমন শান্তনার ঢেকুর তুলি যে অমুক মরলেও আমি তাড়াতাড়ি মরছি না! মৃত্যুর নোটিশ যদি আগাম জানা যেত, তবে জগত সংসার ওলট-পালট হয়ে যেতো। এই যেমন ধরুন, আমাদের নাসরিন ডিনার ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ এল। তাতে লেখা যে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারীর ২৮ তারিখ ভোর ৪:০১ মিনিটে তার মরণ হবে। সে যেন তৈরী হয়ে নেয়।

মেসেজটি যখন এলো ডিনা তখন ওর অফিসে বসে এই লেখাটি পড়ছিলো। সে আর বাকি লাইনগুলো শেষ করতে পারবে না। তৎক্ষণাত বন্দেগীতে বসে যাবে, অথবা পাগলিনীর বেশে বন বাদাড়ে ঘুরবে। নাওয়া নাই খাওয়া নাই, ক’দিনের মধ্যেই তার নন্দিনীমার্কা রুপ নিস্তেজ হয়ে আসবে। হয়তো তখন ডিনার অনশন ভাঙাতে যমরাজকে ২৮ তারিখের আগেই চলে আসতে হবে। আসলে আমরা সবাই আতঙ্কিত, জগৎ সংসার কম্পমান। করোনা মহামারী আমাদের মৃত্যুর খাদে এনে দাঁড় করিয়েছে। একটু টোকা লাগলেই পড়ে যাবো।
স্বাগত ২০২২!

তোমার কাছে কিচ্ছুটি চাইবার নেই। শুধু আমাদের আনন্দগুলো ফিরিয়ে দাও। আমরা যেন আবার গলা খুলে গেয়ে উঠতে পারি,
“আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তা কিছু নাওনি।”
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)