ভজন সরকার : জীবনে পরিমিতির বড্ড প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ অনেক জায়গায় এ পরিমিতির কথাই নানাভাবে বলেছেন। “ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজের ভিড়ের ঠ্যালাতেই হয়ে যেত মাঝারি”- রবীন্দ্রনাথের কথাটির সারমর্ম কিন্তু ওই পরিমিতিবোধই। বলতে পারেন এ তো উপন্যাসের কথা; ‘শেষের কবিতা’-র নায়ক অমিত রায়ের আঁতালামো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনাচরণের ক্ষেত্রে তো বটেই লেখালেখিতেও আতিশয্য বর্জন করছেন। ছোট গল্প তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি সংগীতের কথা এবং সুরেও যে পরিমিতির পরিচয় দিয়েছেন, তা ঈর্ষণীয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সংগীতচিন্তা’ প্রবন্ধে বলেছেন,
“তাজমহলের প্রধান লক্ষণ তার পরিমিতি-ওতে এক টুকরো পাথরও নেই যাতে মনে হতে পারে হঠাৎ তাজমহল কানে হাত দিয়ে তান লাগাতে শুরু করেছে। তাজমহলে তান নেই; আছে মান, অর্থাৎ পরিমাণ। সেই পরিমাণের জোরেই সে এত সুন্দর। পরিমাণ বলতেই বোঝায় উপাদানের সংযম।”
বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গর্ব করেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করেন না। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য পড়েন শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষার বৈতরণী পাড় হওয়ার জন্য। রবীন্দ্রসংগীত করেন পরিচিতি এবং আভিজাত্যের ঠাট বাড়ানোর জন্য। তাই পরিমিতিও যে বাঙালি শিখবেন না রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে তা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়।
রবীন্দ্রনাথের কথা বাদই দিলাম। এপার বাংলায় ইদানিং সলিমুল্লাহ খানেরা রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু বানিয়ে বিরুদ্ধপক্ষে ঠেলে দিচ্ছেন প্রানপনে। ওপার বাংলাতেও কট্টর হিন্দুরা রবীন্দ্রনাথকে “ব্রাহ্ম ম্লেচ্ছা” বলে প্রপাগান্ডা করে আসছেন সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সময় থেকেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বাঙালির কাছে এমনই এক দেদীপ্যমান জ্যোতিষ্ক যে তাঁকে বাদ দিলে এপারের সলিমুল্লাহ খানেরা এবং ওপারের শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের শিষ্যরা নিজেরাই অন্ধকারে ঢেকে যান।
রবীন্দ্রনাথের জন্য রবীন্দ্রনাথের দরকার নেই বরং বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্যই রবীন্দ্রনাথকে দরকার। কিন্তু তবুও গা-জোয়ারী গোঁয়ার বাঙালি অন্যের কাছ থেকে কিছুতেই কিছু শিখবে না। তাই বাঙালি পরিমিতিবোধ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিখবে, সে ভাবনা অবান্তর মাত্র।
বাঙালির অতিশয়োক্তি এবং পরিমাপবোধহীনতা ঐতিহ্যগত। “বসতে দিলে খেতে চায়, খেতে দিলে শুতে চায়’- এরকমের প্রবাদবাক্য আর কোনো ভাষাতে আছে বলে জানা নেই। প্রখ্যাত লেখক, কবি ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তাঁর “বাঙালিঃ একটি রুগ্ন জনগাষ্ঠী?” প্রবন্ধে বলেছেন,
“অতিশয়োক্তি ভাষাকে জীর্ণ করে, নিরর্থক করে,যার পরিচয় পাওয়া যায় বাঙালির ভাষিক আচরণে ও লিপিবদ্ধ ভাষায়। ‘দারুণ পছন্দ করি’, ‘ভীষণ ভালোবাসি’, ‘শ্রেষ্ঠতম কবি’র মতো অতিশয়োক্তিতে বাঙালির ভাষা পূর্ণ।”
বাঙালির এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শিক্ষিত অশিক্ষিত , জ্ঞানী মূর্খ সবার মধ্যেই প্রবাহমান। দেশে প্রবাসে যেখানেই বাঙালি যাক সুযোগ পেলেই বাঙালি হয়ে উঠে সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানী। ‘মাগনা (বিনামূল্যে) পেলে বাঙালি আলকাতরাও খায়’; ‘বাঙালি মাইক্রোফোন পেলে আর ছাড়ে না’, ‘নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করা’- এমনসব মানমর্যাদাহীন প্রবাদবাক্যে বাংলা ভাষা পূর্ণ।
বাঙালির প্রায় সব আলোচনা সভাতেই বক্তার এবং শ্রোতার সংখ্যা প্রায় সমান থাকে। কেউ কেউ আবার নিজের বক্তব্যের সময় সভাতে উপস্থিত হোন এবং নিজের কথা শেষ করেই চলে যান। সভা-সমাবেশে সামনের আসনে বসার জন্য প্রতিযোগীতা বাঙালি ছাড়া আর কোন জাতিসত্বার মধ্যে আছে জানা নেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, অনেকেই সভা সমাবেশে যাওয়া- আগে উদ্যোক্তাদের কাছে বক্তব্য দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
এক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিরা আবার এক ধাপে উপরে বিশেষকরে প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা। দেশের মিডিয়াতে মোটামুটি পরিচিত ব্যক্তিবর্গকে প্রবাসে ‘জুতাসেলাই থেকে চন্ডিপাঠ’ সব অনুষ্ঠানেই অতিথি করে নিজের আভিজাত্য প্রমান করতে মরিয়া প্রবাসীরা।
একবার এক ভদ্রমহিলার অর্ধশততম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। দামি হোটেলে জাকজমকপূর্ণ আয়োজন। প্রধান অতিথি বাংলাদেশের এক ‘জুতাসেলাই থেকে চন্ডিপাঠ’ খচিত কবি। জন্মদিনের আয়োজনে ‘প্রধান অতিথি’, ‘বিশেষ অতিথি’-র প্রয়োজনটা তখনো বুঝিনি, এখনো বুঝি না।
যা হোক, সেই তারকাখচিত বাক্যবাগীশ কবিবর মঞ্চে উঠে দু’এক বাক্যে জন্মদিনের কথা বললেন। তারপর শুরু করলেন, এই শহরে সেই কবিবরের আত্মীয়স্বজন এবং পরিবারের কতজন লোক থাকেন সে গল্প। সেখানেই শেষ হলে গল্পের পরিমিতিবোধ থাকতো। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই কবিবর একে একে তাঁর আত্মীয় এবং পরিবারের সবাইকে মঞ্চে ডেকে ফটো সেশন শুরু করলেন। হল ভর্তি আমন্ত্রিত অতিথিরা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
যে ভদ্রমহিলা এবং তাঁর স্বামী বিপুল অর্থ ব্যয়ে জন্মদিনের পার্টি আয়োজন করেছিলেন তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। মনে পড়ল অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধের কথা। মনে পড়ল আসলেই অহেতুক আত্মপ্রচার বাঙালির সহজাত প্রবৃত্তি।মনে পড়ল বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে আসলেই পরিমিতিবোধ কথাটার বড্ড গরমিল।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)