ভজন সরকার : প্রকৃতির নিয়মেই মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছি। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই হয়ত লিখতে পারছি; কথা বলতে পারছি। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই হয়ত নিজের বঞ্চনা বুঝতে পারছি; অন্যকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং সে বঞ্চনার দায়ভাগ আমারও – এ বোধটুকু মানুষ হয়েছি বলেই হয়ত অনুভব করছি। কখনো কখনো হিংস্রতার -পাশবিকতার শিকার হচ্ছি এবং অনেক সময় নিজেরাও করছি হিংস্র কিংবা পাশবিক আচরণ; ন্যূনতমভাবে গোষ্ঠীবদ্ধ পাশবিক বা হিংস্র আচরণ যে করছি কখনো কখনো সে তো বলাই যায়।
মানুষ এ বিশ্বব্রম্মান্ডের সেরা বা শ্রেষ্ঠ – এ কথা বলা আছে প্রায় সব প্রচলিত ধর্মে এবং দর্শনে। ধর্ম কিংবা দর্শন তো আকাশ থেকে পড়েনি। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের জীবন-যাপন, জীবন -আচরণ, খাদ্যাভাস, ব্যবহার এবং আধিপত্য-বিস্তার এসব কিছু থেকেই মানুষ যে শ্রেষ্ঠ এ ধারণাটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরবর্তীতে এগুলোই লিখিত হয়েছে ধর্মগ্রন্থে, দর্শনে বা নীতিশাস্ত্রে।
সময় বদলের সাথে সাথে মানুষের জীবনাচারণেও পরিবর্তন এসেছে। মানুষ সামনে এগিয়েছে জীবন জীবিকার সহজলভ্যতা এবং কখনো কখনো বোধবুদ্ধির পরিবর্তনের সাথে। শ’ কিংবা হাজার বছর আগের জীবনযাত্রা এবং জীবনযাপন প্রণালীর পরিবর্তন -পরিবর্ধন এবং অনেকাংশেই সংস্করণ ঘটিয়েছে মানুষই। মানুষ এ সুবিধেটুকু পেয়েছে প্রকৃতিগত ভাবেই।
জীব বা প্রাণীজগতে মানুষের এই উর্ধ্বতন অবস্থান নিতান্তই প্রকৃতিজাত। এ প্রকৃতিজাত সুবিধেটুকুর জন্য মানুষ বুদ্ধিমত্তা তো বটেই অন্যান্য দিকেও বেশ উপরেই অবস্থান করেছে। তেমন একটি অবস্থানের নাম খাদ্যচক্র। খাদ্যচক্রে মানুষের অবস্থান একেবারেই উচ্চতম স্থানে। অর্থাৎ মানুষই নিজেদের সুবিধে মতো প্রাণী বা জীবজগতে খাদ্য নির্বাচন করতে সমর্থ হয়েছে। নিজের বিকাশ, বৃদ্ধি এবং পরিপক্কতার জন্য অন্যান্য জীব বা প্রাণীক‚লের প্রতি চালিয়েছে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বা সন্ত্রাস।
প্রস্তরযুগে মানুষ ফলমূল-সবজি-শেকড়বাকড় থেকে মাংস সবই খেয়েছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। প্রস্তরযুগের বিস্তৃতি এখন থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর থেকে ২৬ লক্ষ বছর পর্যন্ত। এই লম্বা সময় ধরে মানুষের ব্যাপক বিবর্তন বা পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ গুহাবাসী থেকে বাইরে এসেছে। আগুনের ব্যবহার শিখেছে। আগে যেখানে কাঁচা মাংস খেতো, এ সময়ে পুড়িয়ে সুস্বাদু করে খাওয়া শিখেছে। বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পেতে মানুষ অভ্যস্থ হয়েছে নানা পরিবর্তনে-পরিবর্ধনে।
প্রস্তরযুগের মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ মধ্য প্রস্তর যুগে -যার ব্যাপ্তি ৭ হাজার থেকে ১২ হাজার বছর আগে, সে সময়ে মানুষ কৃষিকাজের উপকরণ আবিষ্কার করতে শিখেছে। মানুষের খাদ্যাভাসের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে আরো পরে নব্য প্রস্তর যুগে, যার ব্যাপ্তি আজ থেকে সাড়ে ৪ হাজার বছর আগে। এ সময়েই নদ-নদী তীরবর্তী স্থানে বিভিন্ন সভ্যতা গড়ে উঠেছে। সিন্ধু সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমিয়া সভ্যতা এ নব্যপ্রস্তর যুগেই গড়ে উঠেছিল। এ সময়েই কৃষি নির্ভরতার সাথে সাথে কিছুটা শহরকেন্দ্রিক সভ্যতারও দেখা মেলে। ফলে খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন আসে অনেক।
প্রস্তর যুগের পরে আসে যথাক্রমে ব্রোঞ্জ এবং লৌহ যুগ। ব্রোঞ্জ যুগের ব্যাপ্তিকাল ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ কিংবা ৫ হাজার বছর পূর্বে। লৌহ যুগ বিস্তৃত আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার বছর পূর্বে। এ সময়ে নানা ধাতুর ব্যবহার থেকে শুরু করে ব্যবসা-বানিজ্যের বিস্তারও ঘটে অভূতপূর্বভাবেই। পৃথিবীর নানান প্রান্তে ঘটে শিল্পকারখানার বিস্তার। শুরু হয় নানান সভ্যতার। সংরক্ষিত ইতিহাস লেখার শুরু এ সময়েই। অর্থাৎ এ সময়ে থেকেই মানুষ তার সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ লিখিত আকারে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। অন্য কথায় এ সময় থেকেই মানুষের জীবনযাপন প্রণালীর ধারাবাহিক ইতিহাস সংরক্ষিত হয়ে এসেছে।
ইতিহাসের এ ধারাবাহিক কালপরিক্রমা উল্লেখ করার অর্থ হলো মানুষের পরিবর্তন সম্বন্ধে একটু ধারণা লাভ করা। সেই সাথে মানুষ নিজের প্রয়োজনে কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এবং নিজের চাহিদা মিটিয়েছে তারও একটা কালক্রমিক ধারনা দেওয়া। এ সময়ে আগুন এবং ধাতুর ব্যবহারের সাথে সাথে মানুষ কৃষিকাজে ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। খাদ্যাভাসেও এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। মাংস কাঁচা থেকে পুড়িয়ে খেতে শিখেছে। কৃষি থেকে উৎপাদিত পন্য ব্যবহারের সাথে সাথে মাংসাশী খাবার থেকেও নিজেদের নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে। কিন্তু মানুষ এখনো কি পেরেছে পুরোপুরি মাংস-ভক্ষণ থেকে সরে আসতে? না, পারেনি। এই অপারগতাকে অনেকাংশেই সাহায্য করেছে প্রচলিত ধর্মীয় বিধিবিধান।
পৃথিবীতে প্রচলিত যে ধর্মগুলো আছে, তার অধিকাংশই লিখিত হয়েছে তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার নিরিখে। তাই ধর্মীয় বিধিবিধানও আরোপিত হয়েছে সমসাময়িক ঘটনার প্রেক্ষাপটেই। কিন্তু মানুষ তা টেনে নিয়ে চলেছে অনাগত সময়ে। তাই অধিকাংশই ধর্মীয় বিধানই পরে আর সমসাময়িক থাকেনি। এক কালে যা প্রয়োজন ছিল, পরবর্তীতে তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু সমাজপতিরা-ক্ষমতাশীলরা নিজেদের প্রয়োজনে তা জারি বা বজায় রেখেছে। ধর্মীয় শাস্ত্রের অলৌকিকতার সহায়তায় মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক সংস্কারকে টিকিয়ে রেখেছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকেরা মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করে তার সাথে অন্যান্য প্রাণীদের তুলনা করে দেখিয়েছেন, মানুষের শরীরের কিছু অঙ্গ আছে যা মাংসাশী প্রাণীদের নেই। অর্থাৎ মানুষকে যে তার শরীরের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে মাংস খেতেই হবে এমন প্রমান মেলে না। উদাহরণ হিসেবে মানুষের দাঁতের গঠন মাংস চিবিয়ে খাওয়ার উপযোগী নয়, যেমন দেখা মেলে অন্যান্য মাংস-ভোজী প্রাণীদের ক্ষেত্রে। তাছাড়া মানুষের শরীরের খাদ্যনালীর সাথে ‘এপেন্ডিস’ নামের একটি অঙ্গ আছে যা মানুষের শরীরের তেমন কোন কাজেই লাগে না। অথচ এই অপ্রয়োজনীয় অঙ্গটি তৃণভোজী প্রাণীদের দেহে বেশ কার্যকর। তাহলে মানুষের শরীরে কেন আছে এ অঙ্গটি? কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন এক সময় মানুষ হয়ত তৃণভোজী ছিল। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মানুষের খাদ্যাভাসের পরিবর্তন হয়েছে। ফলে এক সময়ের প্রয়োজনীয় এ অঙ্গটি সময় পরিক্রমায় তেমন কাজে লাগেনি কিন্তু এখনো পূর্বের চিহ্নটি রয়ে গেছে। হয়ত আরো লক্ষ বছর পরে এ রকম আরো পরিবর্তন ঘটবে।
তবে মানুষের শরীরের পুষ্টির জন্য আমিষ বা প্রোটিন প্রয়োজন। প্রাণীর দেহে এ প্রোটিন বা আমিষ থাকে। কিন্তু প্রাণী দেহই কেবল প্রোটিনের একমাত্র উৎস নয়। যদিও অন্যান্য উৎসগুলো বেশ দুস্প্রাপ্য এবং ব্যয়বহুল। তাই সাধারণের প্রয়োজনে প্রাণীর মাংস খেতেই হয়। এটি ধর্ম নয় বরং প্রকৃতি নির্ধারিত বিষয়।
তাই অধিকাংশই মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে প্রাণী হত্যা করতেই হয়। কিন্তু এ হত্যার মধ্যে গর্ব বা অহংকার থাকতে নেই বরং অনুশোচনা-অনুতাপ এবং পাপবোধ থাকা উচিত। অথচ আমরা প্রাণী হত্যাকে উৎসব বানিয়ে ফেলছি। প্রায় সব প্রচলিত ধর্মই প্রাণী হত্যাকে উৎসাহিত করে এসেছে যুগ যুগ থেকেই। অনেকে এই নৃশংসতা থেকে বেরিয়ে এসেছে। অনেক ধর্ম এখনো সেই প্রাচীন বা মধ্য যুগেই পড়ে আছে।
প্রায় সব প্রচলিত ধর্মেই আছে যে, সব প্রাণ ঈশ্বরের দান। তাহ’লে সেই ঈশ্বরের দানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সেই ঈশ্বরকেই তুষ্ট করার পেছনে কোনো যুক্তি আছে কি? সময় বদলেছে অনেক। মানুষও হয়েছে আগের চেয়ে অনেক মানবিক। আচার-আচরণ-বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে মানুষ বুঝতে শিখেছে ভালো-মন্দ কিংবা পাপ-পূণ্য। অথচ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ পড়ে আছে সেই অলৌকিক বিশ্বাসের ঘেরাটোপেই।
মানুষের মুক্তি ঈশ্বরের কৃপায় নয়, মানুষের মুক্তি মানুষের এবং এই জগতের কল্যানের মধ্যেই নিহিত; প্রাণী কিংবা জীবজগতও তার বাইরে নয়। রবীন্দ্রনাথে এ কথাটি কী সুন্দর করে বলেছেন, “আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে”।
ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা