Home কলাম আমার দেখা নয়াচীন

আমার দেখা নয়াচীন

ফরিদ আহমেদ : ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে পিকিং এ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ওই শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তখন উদীয়মান এবং প্রতিশ্রæতিশীল রাজনৈতিক নেতা। বয়স মাত্র বত্রিশ বছর। ওই বছর ফেব্রæয়ারি মাসে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেবার অপরাধে তাঁকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি জেলে নেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে তিনি মুক্তি পান। এর মধ্যে কারাগারে অনশনও করেছিলেন তিনি।

শান্তি সম্মেলনে তাঁর সাথে ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানও ছিলেন। এঁরা ছাড়াও ছিলেন মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং ইউসুফ হাসান।

এর মাত্র তিন বছর আগে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজাচ্ছে নতুন আদর্শের সরকার। বিপ্লবের পরে সত্যি সত্যি বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে এমন তথ্য ভেসে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। এ কারণে, চীন দেখার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর একটা আগ্রহ ছিলো। সেই আগ্রহে জ্বালানি সরবরাহ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। তাঁকে প্রায়শই বলতেন, ‘যদি সুযোগ পাও একবার চীনদেশে যেও। অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে।’
বঙ্গবন্ধু নিজে কম্যুনিস্ট ছিলেন না। কিন্তু শান্তির পক্ষের শক্তি বলে নিজেকে মনে করতেন। ফলে, বিপ্লব পরবর্তী চীনের কর্মকাণ্ড দেখার লোভ এবং শান্তির প্রতি আকর্ষণে চীন সফরে যান তিনি।

চীনে পঁচিশ দিন ছিলেন তিনি। সেই পঁচিশ দিনের অভিজ্ঞতাকে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। চীন থেকে ফিরে এসেই সেই কাজটা তিনি করেন না। রাজনীতিবিদ হিসাবে ব্যস্ত সময় পার করতে হতো তাঁকে। স্বাভাবিক সময়ে লেখালেখি করার মতো অবস্থা তাঁর ছিলো না। তিনি যা কিছু লিখেছেন, সবই জেলে বসে। চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও তাই। ১৯৫৪ সালে জেলে গিয়েছিলেন তিনি আবার। সেই সময়ে চীন সফরের বিবরণ খাতায় লিপিবদ্ধ করেন তিনি।
তিনি জেলে গেলে তাঁর স্ত্রী রুল টানা খাতা দিয়ে আসতেন তাঁকে। সেই খাতাতেই তিনি অবসরকালীন সময়ে তাঁর চিন্তাভাবনা লিখে রাখতেন। সেই খাতাগুলো থেকে লেখা উদ্ধার করে কখনো বই প্রকাশ করবেন, সেই ভাবনা তাঁর ছিলো না। তিনি মূলত সময় কাটানোর জন্যই লিখতেন। যে কারণে এই খাতাগুলো দীর্ঘকাল তাঁর বাড়ির আলমারির উপরে পড়ে ছিলো। ১৯৭১ সালে এই খাতাগুলোকে উদ্ধার করেছিলেন শেখ হাসিনা। যে কারণে আজকে আমরা তা৬র তিনটে বই পেয়েছি। এতে করে তাঁর চিন্তা-ভাবনা কেমন ছিলো, মননশীলতা কোন পর্যায়ে ছিলো, সেটা জানার এক দুর্দান্ত সুযোগ আমরা পেয়েছি।

চীন সফরের অভিজ্ঞতা তিনি যে খাতায় লিখেছিলেন, সেটার শিরোনাম দিয়েছিলেন নয়াচীন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর, চীনকে সবাই নয়াচীন বলে অভিহিত করতো। বই আকারে বের হবার সময়ে সেটার শিরোনাম দেওয়া হয় ‘আমার দেখা নয়াচীন’।

স্বল্প সময়ের জন্য বিদেশ ভ্রমণে গেলে মানুষ সাধারণত নৈসর্গিক দৃশ্য, বিখ্যাত স্থাপনাসমূহ বা দ্রষ্টব্য জায়গা দেখার চেষ্টা করে। তিনি এর ব্যতিক্রম ছিলেন। চীনে গিয়ে অবসরকালীন আনন্দ মুখর সময় কাটানোর পরিবর্তে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চীনকে দেখার চেষ্টা করেছেন তিনি, বোঝার চেষ্টা করেছেন কোন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এতো অল্প সময়ের মধ্যে সুসংবদ্ধ একটা সিস্টেম তারা তৈরি করেছে, উন্নতি করছে অত্যন্ত দ্রæতগতিতে। অপার কৌতূহল নিয়ে সবকিছুকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। কনফারেন্স চলার সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে গেছেন, ঘুরে দেখেছেন কৃষি স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, কল-কারখানা এবং কৃষি খামার।

ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার কারণে দোভাষীর উপরে নির্ভর করতে হতো তাঁর। দোভাষী সবকিছু সঠিকভাবে বলছে কিনা, তথ্য গোপন করছে কিনা, সেটা বোঝার জন্য ক্রসচেকও করতেন তিনি। যেমন, একটা কথা তখন প্রচলিত ছিলো যে চীনের নতুন সুরকার মুসলমানদের ধর্ম কর্মের অধিকারকে হরণ করেছে। তিনি বেশ কিছু মুসলমানকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছেন। দোভাষীর মাধ্যমে জানতে পারতেন, সেই প্রচারণা আসলে সত্যি না। মুসলমানরা জানাতো তারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের ধর্ম কর্ম করছে। দোভাষী মুসলমানদের বক্তব্য সঠিকভাবে দিচ্ছে কিনা, সেটা তিনি আবার অন্য সোর্সের মাধ্যমে যাচাই করে দেখতেন।

একই ধরনের ঘটনা তিনি ঘটিয়েছেন শ্রমিকদের অবস্থা দেখতে গিয়েও। তারা কীভাবে বসবাস করে সেটা দেখার শখ তাঁর ছিলো। কারণ, তিনি শুনেছেন চীনের নয়া সরকার শ্রমিকদের জন্য বাসস্থানের সংস্থান করে দিয়েছে। আগে থেকে বললে তাঁকে সাজানো গোছানো বাসা দেখানো হবে, এই ভাবনা থেকে শ্রমিকদের কলোনির একেবারে কাছে গিয়ে হুট করে বলেছেন যে তিনি শ্রমিকদের বাসস্থান দেখতে চান।

তাঁকে এক শ্রমিকের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই শ্রমিক, নব বিবাহিত। স্বামীটি কাজে ছিলো বলে তার দেখা তাঁরা পাননি। নারী শ্রমিকটি তাঁদের চা দিয়ে আপ্যায়ন করেন।

এখানে বঙ্গবন্ধুর বিশাল মনের পরিচয়ও পাই আমরা। আপ্যায়নকারী মেয়েটার সদ্য বিয়ে হয়েছে। সেই বাড়িতে তারা এসেছেন। তাকে কিছু একটা উপহার দেওয়া উচিত। অথচ তাঁদের কাছেও কিছু নেই মেয়েটাকে দেবার জন্য। এর পরের অংশ আমি তাঁর লেখা থেকেই তুলে দিচ্ছি শুধু এটা বোঝাতে যে একজন মানুষ এমনি এমনি মহান হয় না, তাঁর ভিতরের মহান হবার গুণ থাকা লাগে। তাঁর লেখা অংশটুকু পড়লে, আপনারাও সেটা বুঝতে পারবেন।
“আমরা এক মুশকিলে পড়ে গেলাম। বিবাহ বাড়িতে গিয়েছি, কিছু উপহার না দিয়ে কী করে ফিরে আসি। আমাদের এত যতœ করেছে চীনের জনসাধারণ, খাওয়া-দাওয়া থাকা যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছে আমাদের। ইলিয়াসকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোর কাছে কিছু আছে? বললো, না। ফজলুল হককে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কাছে কিছু? বললো, না। একটু সুবিধা ছিল বাংলা ও উর্দুতে কথা বললে বোঝার উপায় নাই। আমি ভাবছিলাম, হঠাৎ আমার হাতের দিকে খেয়াল পড়লো – দেখি আমার তো একটা আংটি আছে। আমি খুলে সেই শ্রমিকের স্ত্রীকে উপহার দিলাম। দোভাষীকে বললাম, পরাইয়া দিতে। কিছুতেই গ্রহণ করতে চায় না, তারপর নিলো। আমরা ফিরে এলাম।”

আমার দেখা নয়াচীন অত্যন্ত সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা। তিনি যে ভাষায় কথা বলতেন, একেবারে সেই ভাষাতেই বইটা লিখেছেন। আলংকারিক ভাষা ব্যবহার করে এটাকে উন্নত করার চেষ্টা তিনি করেননি। পুরো বই জুড়ে রয়েছে সারল্য মাখা এক আন্তরিকতার ছোঁয়া। এর মূল কারণ হয়তো এটাই যে তিনি এই পাণ্ডুলিপি বই হিসাবে ছাপানোর জন্য লেখেননি। অবসর সময়ে নিজের চিন্তাকে অবমুক্ত করা জন্য তিনি লিখেছেন। যে কারণে এটা রয়ে গিয়েছে কৃত্রিমতা বিবর্জিত।

তিনি নিজে কম্যুনিস্ট ছিলেন না। এ কথা আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি। কম্যুনিস্ট না হয়েও তিনি সমাজতান্ত্রিক নয়াচীনকে দেখেছেন ভালবাসার এবং শ্রদ্ধার চোখে। প্রচণ্ড সংবেদনশীল এক ইতিবাচক মানসিকতা দিয়ে তিনি চীনের সমাজব্যবস্থাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, সেটাকে রূপায়িত করেছেন, এর সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করেছেন। স্বল্প সময়ের মাঝে যে গভীরতা নিয়ে তিনি চীনকে দেখেছেন, আমার ধারণা অনেক বামপন্থীও চীনকে সেভাবে দেখেনি। তাঁর এই গভীর পর্যবেক্ষণটা শুধু কৌতূহল থেকে আসেনি। তিনি চেয়েছেন এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নিজের দেশের এবং দেশের মানুষদের কীভাবে উন্নত করা যায় সেটা খুঁজে বের করা। একজন বত্রিশ বছরের তরুণ রাজনীতিবিদের জন্য এটা একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ওই বয়সে অতোখানি পরিণত আচরণ সবাই দেখাতে পারে না। দেখাতে পারে না বলেই সবার পক্ষে শেখ মুজিব হওয়া সম্ভব হয় না।

অসম্ভব এক সম্ভবের নাম ছিলেন তিনি। যে কারণে এর মাত্র উনিশ বছর পরে একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

Exit mobile version