খুরশীদ শাম্মী : রাতটা বড্ড অফুরান। ঘুটঘুটে আঁধার টই-টই পাহারারত। রেলস্টেশনের দুই সীমান্তে জোনাকির মতো মিটমিট জ্বলে বৈদ্যুতিক বাতি। স্টেশনে মাত্র একজন লোক কর্মরত। রাত চারটার দিকে আসবে পরবর্তী ট্রেন। এর আগে তার তেমন কোনো কাজ নেই। সুতরাং সেও টেবিলে মাথা রেখে নাক ডেকে ঘুরে বেড়ায় স্বপ্নের দেশ। বিশ্রামকক্ষের দোর গোড়ায় চট মুড়িয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে গৃহহীন একজন মানুষ। কামরার বেঞ্চিতে মাত্র দুইজন যাত্রী। তারা ঘুমকে পাহারা দেয় অতন্দ্র। ঝিমুনি ধরলেও মশার উপদ্রবে ভেঙে যায় আবেশ। একটা ইঁদুর দৌড়ে পালায় খসখস শব্দে। ভয়ে লাফিয়ে ওঠে একজন যাত্রী, ‘ওরে বাবা! ইঁদুরটা পারলে গায়ের উপর দিয়ে চলে’।
মুখোমুখি বসা অন্যযাত্রীর ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য, ‘এই আধা-গ্রামের স্টেশনে রাইতের বেলায় এউক্কা ইন্দুর দেইখাই হয়রান হইলেন। মনে হয় গাঁও-গেরামে আসা-যাওয়া নাই। সাহেবের বাড়ি কোথায়?’
– এই তো পরের স্টেশন, চৌমুহনী।
– চৌমুহনী! কোন বাড়ির পোলা আপনে? আমার ফুপু হইলো তালুকদার বাড়ির বউ। সেইখানে যাইতেছি আমি।
– আমিও তালুকদার বাড়ি যাচ্ছি। আপনার ফুফার নাম কী?
– লবণ তালুকদার।
– সে তো আমার চাচতো চাচা। আমি পবন তালুকদারের ছেলে পরশ। আপনাকে আগে কখনো দেখি নাই। অবশ্য আমারও দেশের বাড়ি তেমন আসা হয় না।
– আমিও কোনোদিন ফুপু বাড়ি আসি নাই। এইবার আসলাম ফুপুরে নেতে। আব্বার শরীর ভালো নাই। সে তার ভগিনীরে দেখতে চায়। আমার ফুপা কোর্ট-কাছারি লইয়া এতই ব্যস্ত থাকে যে দুইদিন ছুটি নেওনের সুযোগ নাই তার।
– লবণ চাচা এমনই। কাজ ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। আমরা বাড়িতে এলে এমনও হয় যে যাওয়ার দিন তার সাথে দেখা হয়। তবে চাচী, অর্থাৎ আপনার ফুফু অনেক মায়া করে আমাদের।
– ফুপু আমার মায়া জানে। আমার নাম কিসলু, সে মায়া কইরা ডাকে কিশমিশ।
গোঙানির উৎস খুঁজতে বাহির পানে তাকায় দু’জনই। আঁতকে উঠে পরশ। চট প্যাঁচিয়ে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটি উঠে বসেছে। পাকা জাম রাঙা চোখের একজন মধ্যবয়সী পুরুষ। তার চেহারা অনেকটা হারেন কাকার মতো। কিন্তু সে এখানে এভাবে থাকবে কেন? সে তো সুখী গৃহস্থ। ছাত্রজীবনে চুটিয়ে সাহিত্যচর্চা করত। বাবার বাল্যবন্ধু। বাবা শহরের উন্নয়নের জন্য এত কিছু করেছে যে মানুষজন বাবাকে সম্মান করে ডাকে ‘বড় তালুকদার’। যে মানুষ তার কাজের জন্য বড় তালুকদার উপাধি পায়, তার বন্ধুর এই অবস্থা হতেই পারে না। ভুল হচ্ছে ভেবে পরশ মন রগড়ায়, দৃষ্টি সরায়। কিন্তু বিবাগী মন ছুটতে থাকে শৈশব, কৈশোর, হারেন কাকার বাড়ি, পূজার দিনগুলো। মাসীদের উলুধ্বনি, সম্মিলিত গান, কবিতা, প্রসাদ বণ্টন ক্রমান্বয়ে উন্মুক্ত করে স্মৃতির পাঁচিল।
কিসলু ভয়ে শুকনো কিশমিশের মতো গুটিয়ে যায়। তার পাথর দৃষ্টি আগলে ধরে ময়লা পরিহিত মানুষটির চোখ থেকে লাভার মতো উগচে পড়া ক্ষোভ।
নীরবতা ভেঙে আচমকা লোকটির ক্রোধহাসিতে কেঁপে ওঠে রেলস্টেশন। দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয় স্টেশন কর্মীর স্বপ্ন। সে চোখ খুলেই বাঁশিতে ফুঁ দেয়, কিন্তু বাজে না, বরহ..বরহ…শব্দ হয়।
দাঁড়িয়ে যায় চট পরিহিত মানুষটি। আবারও হাসতে শুরু করে। সর্বোচ্চ কণ্ঠে হাসে। তার হাসিতে আকাশ বাতাস চিরে যেন কেয়ামত নেমে আসে ধরণীতে। পলকেই শান্ত হয় সে। বিশ্রামকক্ষের প্রবেশদ্বারে মুখ গলিয়ে বলে, ‘সিটি বাজানের-ই ক্ষ্যামতা নাই যার, তার নাম বোলে হেকমত?’
যাত্রীদ্বয় বিস্মিত। হেকমত গলা হাঁকে, ‘তোর সাহস তো দেখছি আইজ মারাত্মক বাড়ছে! খাড়া, তোরে স্টেশন ছাড়া করতাছি।’
গোঁ গোঁ করে লোকটি, ‘স্টেশন? নিকুচি করি আমি।’ –
ভয়ে ঠকঠক কাঁপতে থাকে কিসলু।। স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করে, লো–লো-লোকটা চোর-ডাকাইত না তো?
‘চুরি-ডাকাতি করার জন্য যোগ্যতা লাগে। পাগলের সেই যোগ্যতা আছেনি? ও হইলো সর্বহারা পাগল, যার কিচ্ছু নাই।’ গুমট বার্তা প্রকাশ করেই হেকমত বাঁশি বাজায়।
উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে চলতে শুরু করে লোকটি। হারিয়ে যায় সে ঘন আঁধারে। বায়ুতরঙ্গে প্রতিধ্বনিত হয় তার কণ্ঠ।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে শত কুড়ি গল্প আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে সতী নারীর চিতা আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে আপন হারাবার কষ্ট আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে মায়ের বুকের জ্বালা আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে অন্তর ব্যথার নদী আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে নিঃস্ব হওয়ার যন্ত্রণা আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে বাল্যসখার প্রতারণা আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে রক্ত রাঙা মৃত্যু আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে নষ্ট হওয়ার অভিশাপ আছে।
আমার একটা পাহাড় আছে,
যে পাহাড়ে মাটির একটা দেহ আছে।
ওই দেহটি স্বপ্ন ছাড়া-ই বেঁচে আছে
নিঃশর্তে বিমূর্ত পাহাড় আগলে আছে।