Home কলাম আমারে যে জাগতে হবে…

আমারে যে জাগতে হবে…

হিমাদ্রী রয় : কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে আমাদের প্রথম বিচার হচ্ছে বড় ভাল মানুষ ছিলো এবং সেটা খুব বিশ্বাস নিয়ে বলি। চিতায় পুড়িয়ে এসে, জানাযায় কিংবা স্যোশাল মিডিয়ায় ছবি সেঁটে এরকম কিছু না বললে বা লিখলে আমাদের ভালো মানুষির উপর জগতের সন্দেহ হবে যে। চিরনিদ্রায় শায়িত মানুষটি কাশ শুনতে পেতো যখন সবাই বলি বড় ভালো মানুষ ছিলো। তো ভালো মানুষের এই হিসাব জীবন থাকতে কেন দিতে পারি না সহজ মনে। কেন সাদা বসন পড়ে অন্তিম বিদায়ে তা মনে হয়।

আর কোন অস্বাভাবিক মৃত্যুতে সবাই বিচারক হয়ে যাই কেউ ওকিল হয়ে প্রশ্ন করি না নিজেকে আমরা কি বুঝে বা জেনে কমেন্ট করি কিংবা আদৌ কি জানা সম্ভব কতটা বিষন্ন কতটা শূন্য হলে পরে মৃত্যুকে কারো কাছে এত আপন মনে হয়।

বিষয়ের উপর আমাদের অনুমান নির্ভর জাজমেন্টের বিষক্রিয়ায় নীল হতে পারে একটা পুরো পরিবার। পরিস্থিতি বুঝার জন্য একটু স্থিতি একটু ধৈর্য না রেখে শুধু কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়া কাউকে আর সেই মানুষ ঢুকঢুক করে সেই বিষ পান করে হয়তো সেও শূন্যতার কোণে আশ্রয় নেয়।

মানুষের বাহিরের কান্না শোনা যায় অন্দরের কান্না পাশের বালিশও জানতে পায় না, মন যখন খালি হয় কোন রাস্তা খুঁজে পায় না, বুঝতেই পারে না কোন দিশায় নিয়ে যাচ্ছে জীবন।
মিন্টু আমার বাল্যবন্ধু, রাত জেগে পোষ্টার লেখার সাথি, সমাজ বদলের রাজনীতি করতো, পরে চাকরি ছেড়ে এসেছিল ব্যাবসায়। কানাডায় আসার কিছু দিন পর জানলাম সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এমন ঘটনায় সচরাচর যেমন প্রশ্ন উঠে আসে চায়ের কাপে বিস্কুট চুবাতে চুবাতে কিংবা তড়িঘড়ি করে ফেইসবুক এ কমেন্ট করতে করতে। আমারও মনে হয়েছিল দেশ ছাড়ার আগেও তো দেখা হলো সিলেটে ব্যাবসা করছিল, ভালই তো ছিল তা হঠাৎ এমন কি হলো যে এই কাপুরুষোচিত সিদ্ধান্ত।

তারপর জীবন যখন বিয়োগ আর বিয়োগের পরিসংখ্যান দিয়ে কষ্টের পান্ডুলিপি করে আয়োজন তখন খবর পাই মনে মিন্টু কি কাপুরুষ ছিলো না ছিলাম আমি কিংবা আমরা। যারা তাকে চিনতাম কিন্তু জানতে পারিনি, শুনতে পারিনি তার নাবলা উদাসী কথা। কাপুরুষের মত সহজ পথ আমি এবং আমরাই কি বেছে নেইনি? সবাই অদেখা করে এগিয়ে গেছি, কি জানি পিছিয়ে পড়ি জীবনে।

মনে পড়ে সে একবার কল করেছিল বাংলাদেশ থেকে। ব্যবসা জমছে না কানাডা আসার কোন সুযোগ আছে কি-না জানতে চেয়েছিলো। ভালোই আছিস বলে আলাপ বাড়তে দেইনি।
যখন সিলিং ফ্যানের সাথে ওর ঝুলানো লাশের কল্পনা করছিলাম আর ভাবছিলাম এমন কি হয়েছিল যে, দিন বদলের স্বপ্ন দেখা ছেলেটির কাছে হঠাৎ জীবন পরায়া আর মৃত্যু আপনার এবং সহজ হয়ে উঠেছিল। এর সঠিক নির্নয় নেয়া কি আমাদের পক্ষে সম্ভব।

হ্যাঁ তবে ভাবতে পারি, হয়তো সে নিজের কথা আপনজনের কাছে বলতে পারেনি কিংবা কাঁদতে পারে এমন কাঁধ ছিলো না তার পাশে, হয়তো সমাজের জাজমেন্ট নিয়ে ওর মনে ভয় ছিলো যা নিয়ে সে ঘুমাতে পারতো না অথবা সাফল্যের কাছে হেরে যাওয়াকে নিজের পরিবারের কাছে ব্যাখ্যা দিতে পারেনি তাই জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়াই তার কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে শায়েদ।

ভিড়ের মধ্যে থেকেও নিজেকে একা পেয়েছি কতবার এমনতো হয় যে কতবার ভাবি কেন আমারই ভুল হয় বারবার, এমন উদাসী চেহারা আমার আপনার মধ্যেই আছে শুধু একটু হিম্মত নিয়ে জানতে চাওয়া দরকার, সম্ভাসনে একটু দরদ থাকা দরকার বন্ধু জানি অন্ধকার-
“Dark clouds always pass.
I promise you,hun
We’re all waiting with you.
Just wait for the sun”

অসম্ভবের বিরুদ্ধে যেয়ে মিন্টুকে হয়তো বুঝতে পারিনি, সিলিং এ ঝুলানো পাখা বাতাস দেয়ার জন্য, পাখায় ঝুলে কেউ হাওয়া হয়ে যাবে জীবন থেকে কল্পনাও করতে পারিনি। যারা এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে গেছে তাদের তো আর ফেরানো যাবে না। তবে যদি আপনি এমন কাউকে চেনেন আর কখনো অন্তরের তুফান তার চোখে ভাসে দেখতে পান তবে একটু কথা বলুন হয়তো তার জীবনের দিশা বদলে যেতে পারে।

সমাজ-সংসার যাপনের বঞ্চনা থেকে অপ্রাপ্তি থেকে বিয়োগ ব্যাথা থেকে অনেকেই ধুঁকেধঁকে বাঁচে হয়তো তারা কখনোই যন্ত্রণার হুইসেল বাজাবে না শুনতে হবে আমাকে আপনাকেই, তাকে আস্বস্ত করতে হবে আমরা পরিবার পরিজন স্বজন সবাই আছি আর আছেন রবীন্দ্রনাথ।
“আমার এ ঘর বহু যতন করে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে
আমারে যে জাগতে হবে
কি জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে”।

বিষন্নতা কি? কেন? দায়ী কে? স্বামী সন্তান পিতামাতা না স্ত্রী। মনে এই বিচার আসার আগে কিছু সাহস দেই, হাত বাড়িয়ে বন্ধু হওয়া যায়, বিশ্বাসেই তো বস্তু মিলায়।
যদি ব্যাথার কুয়াশায় ঢাকে চারিধার,
কোথাও বন্ধু নেই
মনে করে ভাবো করি চিৎকার,
কিন্তু কন্ঠ রোধ হয়ে আসে,
যদি একা ভেবে হয় ভয়,
সব আছে তবু কিছু নেই মনে হয়,
তবে মুখ খোল
নিজের সাথে নিজেই কথা বলো
একা নও তুমি
খুঁজে দেখো কেউতো আছে
এই হৃদয়হীন সংসার মাঝে
শুধু হাতটি নিও টেনে
নয়তো সম্পর্কের অভিমানে
দূরে দূরে থাকা খেলায়
বিচ্ছেদ জিতে যায়।

Exit mobile version