Home কলাম আমাদের সবারই নিজ নিজ গল্প আছে

আমাদের সবারই নিজ নিজ গল্প আছে

কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

মনিস রফিক

সাত.
কথায় কথায় মা বাবাকে মি. স্পোক বলে ডাকতেন। তাঁদের মধ্যে যখন কথা কাটাকাটি হতো, তখন বাবার একেবারে ঠান্ডা যৌক্তিক আচরণ মা কখনও ভালোভাবে নিতেন না। বাবার এমন আচরণে মা ধীরে ধীরে আরো বেশি আবেগপ্রবণ ও উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। বাবা তারপরও খুবই যুক্তির সাথে মাথা ঠান্ডা রেখে কথা চালিয়ে যেতেন এবং চেষ্টা করতেন মা’কে বাস্তবতা অনুধাবন করাতে এবং ঠাণ্ডা হতে। বাবা অবশ্যই বুঝতেন যে মায়ের স্বভাবটা রগচটা আর সে কারণে সাধ্যমত তাঁকে ভালো রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন।

মা জানতেন, বাবা একজন কাজ পাগল মানুষ যার ধ্যান ও জ্ঞান ছিল দেশের জন্য সব দিয়ে কাজ করা আর সেই সাথে তাঁর সন্তানদের যে কোনো অমঙ্গলের হাত থেকে আগলে রাখা। বাবার প্রতি মায়ের যত অভিযোগ ছিল তার প্রায় সবই ছিল সেই পশ্চিমে তাঁর পাঁচ বোনের আনন্দ হাসির যে পরিবেশে তিনি সময় কাটিয়েছেন এবং জীবনের যে উচ্ছ্বাস ও আনন্দ তিনি তাঁর পিতার পরিবারে পেয়েছেন তা তিনি হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁর ছোটবেলায় পশ্চিম ভ্যাঙ্কুভারের সিনক্লেয়ার পরিবারটা ছিল এক অন্যরকম হৈ চৈ আর আনন্দের মিলনক্ষেত্র। তখন সেই বাড়ীতে প্রতিনিয়ত পরিচিত মানুষজন, আত্মীয়স্বজন আসা যাওয়া করতো আর শুরু হতো গল্প-গুজব, খানাপিনা ও আনন্দ উৎসব। মা এমন সব মানুষদের মধ্যে বড় হয়েছেন যাদের জীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল আনন্দ ফুর্তির মধ্যে সময় কাটানো।

কিন্তু কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ২৪ সাসেক্স এ এমনভাবে জীবন কাটানো সম্ভব ছিল না। মা সবসময় এই বড় আর ছিমছাম বাড়িটাকে বলতেন, ‘এটা এক রাজকীয় খোলামেলা কারাগার।’ মাঝে মধ্যে আবার তিনি এটাকে এক কনভেন্ট এর সাথে তুলনা করতেন যেখানে মা ছিলেন সর্বময়কর্ত্রী যার অধীনে ছিল সাতজন নিঃসঙ্গ নারী কর্মী। এই সাত নিঃসঙ্গ নারীর কাজ ছিল ঘরদোর পরিষ্কার করা, রান্না-বান্না করা আর আমাকে এবং আমার ভাইদের দেখাশুনা করা। এদের মধ্যে ডায়ান লাভারগনে, লেসলী কিম্বারলে, মনিকা মালোন ও লেসলীর বোন মিকি সব সময় হাসিখুশি থাকতো এবং আমাদের গভীর স্নেহ মমতায় ভালোবাসতো যাদের কথা আমি কখনো ভুলবো না।

অটোয়ার এমন এক পরিবেশে আমি বেড়ে উঠেছি যেখানে আমি দেখেছি রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সব সময় এক দল মানুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। এই এক দল মানুষগুলোর প্রধান কাজ ছিল তাঁদের দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করে নেতাদের জীবনকে একটু সহজ করে দেয়া। হয়তো এটা একটা কারণ, যার জন্য রাজনীতিবিদরা মাঝে মধ্যে তাঁদের সাথে লোকজন রাখেন। এটা থেকে আমিও মুক্ত নই। একবার বেখেয়ালে আমি এক সামাজিক অনুষ্ঠান গিয়ে আমার কোটটা আমার এক বন্ধুকে ধরতে দিয়েছিলাম। কয়েক সেকন্ড পরেই আবিস্কার করলাম, আমার মাথার চারপাশ ঘিরে কোটটা আমায় আচ্ছাদিত করে ফেলেছে। আসলে আমার সেই তথাকথিত রাজনীতিবিদদের মত আচরণ আমার বন্ধুটির ভালো লাগেনি, ফলে তাকে কোটটি ধরতে দিলে সে আমার বড়লোকী ভাবটাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কোটটি আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আমি সত্যিই উপলব্ধি করি, সে ছিল আমার একজন সত্যিকারের বন্ধু। সে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি জেনে করি বা না জেনে করি, আমার মধ্যে গতানুগতিক রাজনীতিবিদদের যে আচরণ ভর করছে, তা থেকে আমার দূরে থাকা উচিৎ। আমি সব সময় বন্ধুটির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার বাবা-মা সবসময় আমার ভাইদের এবং আমাকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যে আমরা যেন কখনও আমাদের পারিবারিক পরিচয়ে কারো কাছ থেকে কোনো রকম সুবিধা না নিই। আমাদের আশেপাশে যারাই থাকতেন আমাদের দেখভাল করার জন্য, আমরা যেন সবসময় তাদেরকে সত্যিকারের মানুষের মর্যাদা দিই।

যদিও ২৪ সাসেক্স এর কঠিন ঘেরাটোপের নিয়ম নীতির প্রতি মায়ের এক ধরনের বিরক্তিবোধ ছিল, তারপরও আমার মা একজন স্ত্রী ও মা হিসেবে অনেক প্রথাগত ও চিরাচরিত বিষয়কে গুরুত্ব দিতেন। মা খুব ভালো রাঁধতে পারতেন। তিনি নিজেই রুটি বানাতেন, মাঝেমধ্যে খুব আনন্দের সাথে সংসারের খুঁটিনাটি কাজ করতেন, লন্ড্রী করতেন এবং ঘরদোর পরিষ্কার করতেন। আমি অসংখ্যবার দেখেছি, যখন তাঁর মেজাজ মর্জি ভালো থাকতো, তখন তিনি ২৪ সাসেক্স এর ঘরের কাজের দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের ছু্টি দিয়ে তাদের কাজ তিনি নিজেই করতেন। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি কিন্তু একজন সংসারী মেয়ে, আমি নিজের মত করে ঘর বানাতে ভালোবাসি।’ কিন্তু কষ্টের বিষয়টা ছিল, প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনকে নিজের স্বপ্নের মত করে নিজের ঘর বানানো খুব একটা সহজ ব্যাপার ছিল না।

১৯৭৪ সালে টরন্টো’তে ট্রুডো পরিবার। (বামে থেকে) মার্গারেট ট্রুডো, জাস্টিন ট্রুডো ও কানাডার সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো।

আমার বাবার জীবনটা ছিল একেবারে ছকে বাঁধা এবং কিছুটা সন্ন্যাসীদের মত। ঘড়ি ধরে প্রতিদিন তাঁর কাজ শুরু হতো সকাল সাড়ে আটটায় এবং শেষ হতো সন্ধ্যা ছয়টায়। তারপর তিনি বাড়ী ফিরে ডিনার সেরে আমাদের নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। এর মধ্যে তিনি তাঁর অফিসের কাজকর্ম নিয়ে বসতেন। মা’য়ের পছন্দের অনুষ্ঠান অর্থাৎ থিয়েটার বা ব্যালেতে যাওয়া অথবা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যদি পরিবারের সাথে বাবাকে যেতে হতো, তাহলে সেখানে বাবা থাকতেন একেবারে নিস্ক্রিয়, আসলে সেগুলো বাবার জগত ছিল না। যদি কখনও এমন কোনো অনুষ্ঠানে বাবা যেতেন, তবে সেখানে যে ধরনের কড়াকড়ি প্রটোকল ব্যবস্থা থাকতো সেটা কল্পনা করলেই অনুষ্ঠানের সব আনন্দ মাটি হয়ে যেতো।
এই প্রটোকলের কড়াকড়ি আমার মা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। আমার জন্মের কিছুদিন পরে একদিন তিনি এত বেশী ক্ষেপে গিয়েছিলেন যে, আমাকে স্ট্রোলারে বসিয়ে দরজা খুলে নিরাপত্তার কোনো তোয়াক্কা না করে বাড়ী থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হওয়ায় যে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন, সেখান থেকে একটু মুক্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিজের মত দম ফেলতে চেয়েছিলেন। বিষয়টা যখন বাবার কানে গিয়েছিল তখন তিনি একই সাথে উত্তেজিত ও ভীত হয়ে পড়েছিলেন। বাবার সাথে মায়ের যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল সেদিন তিনি কিন্তু মায়ের স্বতঃস্ফূর্ততা, মুক্ত চিন্তা আর উচ্ছ্বাস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং এই বিষয়গুলো তাঁকে মায়ের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু ২৪ সাসেক্স এর যে পরিবেশে তাঁরা থাকতেন সেখানে এ সবের কোনো মূল্য ছিল না। সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিহীন স্ত্রী আর সন্তান ছিল অপহরণকারী আর সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্যবস্তু। আমার জন্ম হয়েছিল সেই হৈ চৈ ফেলা ‘অক্টোবর-ক্রাইসিস’ এর দুই এক মাস পরেই, যখন এফএলকিউ (কুইবেক লিবারেশন ফ্রন্ট) ব্রিটিশ ট্রেড কমিশনার জেমস ক্রসকে অপহরণ করেছিল এবং কুইবেকের শ্রমমন্ত্রী পিয়েরে লাপোর্তকে খুন করেছিল। আমার মা এবং আমি সেই সন্ত্রাসীদের তালিকায় থাকবো সেটায় ছিল স্বাভাবিক।
বাবা-মা’র বিচ্ছেদের পর তাঁদের জীবন প্রবাহ দু’রকম হতে থাকে। মনে হলো মা কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হয়ে ছিটকে গেলেন। মায়ের জীবনটা হয়ে পড়লো বহির্মূখী। তিনি ছুটলেন বিভিন্ন দেশ আর বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে। আর বাবা হয়ে পড়লেন অন্তর্মূখী। খ্রীষ্টান ধর্মের সাধুদের মত হয়ে গেলেন তিনি। মনে হলো সাধারণ পরিবারের হাসি আনন্দ তাঁর জন্য নয়। এরপর তিনি জীবনটাকে এমনভাবে নিলেন যে মনে হলো তাঁর জগত হচ্ছে তাঁর কাজ আর তিন ছেলে।

আমি যখন আমার জীবনের সেই কষ্টের মুহূর্তগুলো চোখের সামনে দেখি, তখন সব আগে ভেসে উঠে আমি ২৪ সাসেক্স এর লাইব্রেরীতে ঢুকতেই দেখছি আমার মা অশ্রæসজল চোখে দাঁড়িয়ে আছেন, তারপর কানে ভেসে আসলো তিনি বাবাকে শেষ বারের মত বলছেন তিনি চলে যাচ্ছেন। বাবা তাঁর দিকে মুখ তুলে কঠোর আর পাংশুটে মুখে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর মা উপলব্ধি করলেন, তিনি ২৪ সাসেক্স এর আর কেউ নন। তারপরের দিন থেকেই সব সংবাদপত্রগুলোতে বাবা-মা’র বিচ্ছেদের খবর ফলাও করে বের হতে শুরু করলো, বাস্তবতা মেনে নিয়ে আমি সেই কঠিন সময়গুলো পার করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম।

ভাংগা পরিবারের অনেকের মনেই তাঁদের বাবা-মা’র বিচ্ছেদ নিয়ে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করতে পারে যে তাদের বাবা-মা’কে এক ছাদের নীচে রাখতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আমার ভিতর এমন অপরাধবোধ কখনোই আসে না। কারণ আমি তখন থেকেই বুঝে গিয়েছি যে তাঁদের দুজনের মধ্যে যে স্ব স্ব ভালো লাগা বা জীবনবোধ এমন কঠিনভাবে জেঁকে বসেছিল যে সেখান থেকে দু’জনের কেউই একচুল সরবেন না। আর এটাই ছিল তাঁদের আলাদা হয়ে যাবার প্রধানতম কারণ। এখানে আমার বা আমার ভাইদের করার কিছুই ছিল না।

তবে আমার মধ্যে এক হীনমন্নতা কাজ করতো, নিজেকে খুব ছোট মনে হতো। মাঝে মধ্যে আমার এক সত্ত্বা আমাকে জানাতো যে, আমার মায়ের আমাদের সাথে থাকার জন্যতো আমিই যথেষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু তাতো হয়নি। যখন শুনতাম বাবা-মা একে অপরের দিকে তাঁদের চিৎকার ছুঁড়ে দিচ্ছেন, তখন আমি কোনো ‘আরকী’ কমিক বইয়ের মধ্যে নিজেকে ডুবানোর চেষ্টা করতাম। পড়তে পড়তেই আমি প্রায়ই কল্পনার জগতে চলে যেতাম আর ভাবতাম আমি যদি সেই পৌরাণিক রিভারডেল এ বেড়ে উঠতে পারতাম যেখানে কারো বাবা-মা’র কখনো বিচ্ছেদ হয় না!

ঐ সময়েই আমি বইয়ের মধ্যে ঢুকতে শুরু করি অর্থাৎ গোগ্রাসে বই পড়তে থাকি। বই পড়ার প্রতি আমার এই অভ্যাসটা কিন্তু এখনো রয়ে গেছে। বিয়ে নিয়ে বাবা-মা’র যে কালো অধ্যায় ছিল সেখান থেকে পালিয়ে আমি বইয়ের কালো হরফের মধ্যে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। খুব দ্রুতই ‘আরকী’ কমিকের প্রতি আগ্রহ আমার চলে যায়। আমি দশে পা দেওয়ার আগেই পড়তে শুরু করি কিভাবে ‘নারিনা’ রাজ্যে যাওয়া যায়, ‘লা পেতিত নিকোলাস’ আমাকে সব সময়ই হাসাতো। সেই গল্পগলো পড়তাম আর আমি কল্পনায় ‘লা গুয়িন’ এর যাদুকরী দ্বীপগুলো চষে বেড়াতাম বা সব কাজের কাজী ড্যানীর সাথে সেই চমৎকার লেজওয়ালা পাখিগুলো ধরে বেড়াতাম। আমি খুবই দ্রুত, বলা যায় মগ্ন আর গোগ্রাসে একটার পর একটা বই শেষ করে ফেলতাম।

১৯৮৩ সালে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পিতা কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সাথে বালক জাস্টিন ট্রুডো।

আমি যখন তেরো’তে পা দিলাম, তখন একদিন মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, আমি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা এমন কিছু পড়তে চাই। তিনি বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন আর আমাকে মার্গারেট মিটচেলের লেখা ‘গন উইথ দ্য উয়িন্ড’ বইটা পড়তে দিয়েছিলেন। আমি গোগ্রাসে বইটা শেষ করে ফেলেছিলাম। আমি লক্ষ্য করেছিলাম, বাবা বিষয়টা খুব একটা ভালোভাবে নেন নি। এর মধ্যে আমরা তিন ভাই মিলে যখন গ্যাস্পে পেনিনসুলা ভ্রমণে বের হয়েছিলাম তখন বাবা রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন। ওর পর থেকে আমার যৌবনকাল পর্যন্ত আমার পড়ার রুচির একটা ব্যাপক পরিবর্তন হতে থাকলো। বলা যেতে পারে আমি পড়ার বিষয় নির্বাচনে খুবই বেশী সিলেক্টিভ হয়ে পড়লাম। নিজের পছন্দের যা আমি পড়তাম তা একেবারে আদ্যোপান্ত পড়তাম। মনপ্রাণ নিবিষ্ট করে মূল বিষয়টা এক প্রকার চুষে নিতাম। টলকিয়েন থেকে টম ক্যালন্সি, লা কমটেসে দ্য সেগুর থেকে জিলি কুপার, মরিস লেবল্যাং এর ‘আরসেন লুপিন’ থেকে এরিক ভ্যন লাস্টবাদের এর চিজপাল্প নিনজা উপন্যাস – সবকিছুই আমি অতি উৎসাহী পাঠকের মত পড়তে শুরু করে দিলাম। আমার নানী যখন আমাকে জ্য আউয়েল’র ‘দ্য ক্লান অব দ্য কেভ বিয়ার’ ও ‘দ্য ভ্যালী অব হর্সেস’ পড়তে দিলেন আমি তখন প্রাগৈতিহাসিক যুগের সেই দুঃসাহসিক অভিযান আর আবিস্কারের জগতে নিজেকে ডুবিয়ে ফেললাম। ঐ সময়েই আমার বন্ধুরা আমাকে বিজ্ঞান কল্প কাহিনী আর তরবারী ও যাদুবিদ্যার সব উপন্যাসগুলো পড়ার আনন্দের কথা জানালো। তাদের কথা শুনে আমি সেগুলোও পড়তে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে আমি পড়তে লাগলাম অসিমভ, ব্রাডবুরী, হেনলিয়েন, আর অবশ্যই ‘দ্য হিচহাইকার’স গাইড টু গ্যালাক্সি’। এঁদের বইয়ের শুরুর অধ্যায়গুলো আমি প্রায় মুখস্থ করে ফেলতাম। এমনকি ঐ বইগুলোর কয়েকটি এখনো আমার লাইব্রেরীর শেলফে আছে। আমি চাই আমার ছেলেমেয়েরা একটু বড় হয়ে ‘দ্য থ্রি লজ’স অব রোবোটিক্স’ আর ভগোন এর কবিতার মধ্যে অদ্ভুত যে সৌন্দর্য তার আস্বাদন গ্রহণ করুক।

অসংখ্য সংবেদনশীল পাঠকের মত আমি এই লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে আমার আশপাশের জগতকে দেখতে শুরু করি। তোমরা যদি ভালোভাবে উপন্যাসের কাহিনীগুলো পড়ো তাহলে দেখবে তোমার আশপাশের সবাই নিজ নিজ কাহিনীর এক একজন নায়ক। এটা এমন এক জ্ঞান যা একজন যুবকের তার চারিদিকের জগত সম্পর্কে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করে দেয় যা এমনি এমনি হঠাৎ করে কারো মধ্যে নাও আসতে পারে। এ বিষয়টা একজনের মানবিক চোখ উম্মোচন করে দেয়। এগুলো আমার এগিয়ে চলা আর মানবিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

১৯৮৩ সালে নিউ দিল্লীতে কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের সম্মেলনে বাবা এবং আমি বাংলাদেশে যাত্রা বিরতি করেছিলাম। কানাডার আর্থিক সহায়তায় তখন বাংলাদেশে একটি বাঁধের প্রকল্পের কাজ হচ্ছিল। বাবা সেটা পরিদর্শন করতে চেয়েছিলেন। আমরা যখন আমাদের দলবল নিয়ে বিমানবন্দরে নেমে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন এক অবিশ্বাস্য ট্রাফিক জ্যামে আমাদের গাড়ী আটকিয়ে গিয়েছিল। এশিয়ার অন্যতম এক ব্যস্ত শহরের সেই মটর বহরের এক সরকারী গাড়ীর পেছনের সিটে বসে আমি ঠান্ডায় জমাট হয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের চারপাশের সবাই এবং সবকিছুই একবারে নিথরভাবে থেমে ছিল। সবাই অপেক্ষা করছিল কখন ট্রাফিক ছাড়বে আর আবার সবাই চলা শুরু করবে। আমি গাড়ীর ভেতরে বসে জানালা দিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। হঠাৎ একজন বৃদ্ধকে দেখে আমার চোখ আটকিয়ে গেলো। বৃদ্ধটি তার সাইকেল নিয়ে রাস্তার পাশে অপেক্ষা করছিল, মনে হচ্ছিল আমাদের গাড়ীর বহরটি গেলেই সে তার সাইকেল নিয়ে রাস্তা পার হবে। আমি ভালোভাবে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলাম। দেখলাম, বয়সের ভারে তার মুখের চামড়া কুঁচকিয়ে গেছে। তার মুখে ছিল এক ধরনের বিরক্তির ছাপ। তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলাম তার স্বাভাবিক চলার পথের এই যে বাধা তা তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছতে দেরী করিয়ে দিচ্ছে। ঐ মুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে আমার বারবার মনে হচ্ছিল আমাদের দু’জনের পথ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন এক বেদনাবোধ কাজ করছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমার কখনোই তার জীবনের গল্পটা জানা হবে না। সে থাকে কোথায় বা সে যাচ্ছেইবা কোথায়। তার জীবনটাই বা কেমন, জীবন নিয়ে তার ভাবনাটা কি, অথবা তার জীবনের স্বপ্ন, সুখ-দুঃখটায় বা কেমন – এগুলোর কিছুই আমি কখনো জানবো না। কিন্তু আমি এটা উপলব্ধি করছিলাম, এই যে আমার জীবনের স্বপ্ন, দুঃখ-কষ্ট, সুখ যেমন আমার নিজের কাছে মূল্যবান, ঠিক তেমনি তার জীবনের স্বপ্ন, দুঃখ-কষ্ট, সুখ তার কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু হঠাৎ করেই এই বিষয়টা আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল, আমার কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিল আমাদের এই গ্রহের অসংখ্য কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আমাদের পরিচয়, আমরা শুধু দু’জন দুই ব্যক্তি। আমাদের প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা মানুষ, আমাদের সবার জীবনই একেবারে আমাদের নিজের নিজের, কারো সাথে কারো কোনো মিল নেই আর আমাদের সবারই নিজ নিজ গল্প আছে।

আমি উপলব্ধি করি, এই পৃথিবীর পাঠশালায় এটাই স্বাভাবিক। (চলবে)

Exit mobile version