মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

ছিষট্টি.
তারপরও সেই সময় এমন সব পরিস্থিতি ছিল যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা সম্ভব ছিল না। ২০১২ সালের সেই কানাডার রাজনীতিতে প্রবল প্রতাপে তখন অবস্থান করছিল স্টিফেন হার্পারের কনজারভেটিভ পার্টি।

সেই সময় অনেকেই ভেবেছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের পর হয়ত স্টিফেন হার্পারের কনজারভেটিভ পার্টি অনেকটা উদার চিন্তা ভাবনা আর ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সংখ্যালঘিষ্ঠ সরকারে সব সময় যেটা হয়, যে পার্টি শাসন ক্ষমতায় থাকে সেটা সব সময় একটা চাপ বা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকে, আর সব সময় নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এক ধরনের চিন্তা আর ব্যস্ততায় তারা সময় কাটায়। কারণ যে কোন সময় শরিক দল যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে, তাহলে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে আবার নির্বাচনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ নেয়াটা বেশীর ভাগ সময়ই সম্ভব হয় না। কিন্তু সংখাগরিষ্ঠ সরকার গঠনের ফলে স্টিফেন হার্পারের কনজারভেটিভ পার্টির হঠাৎ করে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়া এবং অন্তবর্তীকালীন নির্বাচনের কোন বিষয় হঠাৎ করে সামনে উপস্থিত হওয়ার সম্ভবনা একেবারেই ছিল না। ফলে সেই সময় কনজারভেটিভ পার্টির আরও দীর্ঘ পরিকল্পনা করা সম্ভব ছিল, এবং একই সাথে আমাদের এই দেশ নিয়ে তারা আরও ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ নিতে পারত।

এই তত্ত¡ কথাটা সত্যিই সুন্দর মনে হতে পারে, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। আর এমন হলে তো একটা সরকার যে রূপে জনগণের সামনে হাজির হয়, সেটা কিন্তু মারাত্মক কিছু ফল বয়ে আনে। খুব বেশী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর লোকেদের মধ্য যে ভাবনাটা চলে আসে, তাতে তারা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার খুব বেশী একটা তোয়াক্কা করে না। পার্লামেন্ট এ তাদের ক্ষমতার লাগাম কেউ ধরতে না পারার ফলে তাদের সবচেয়ে কদাকার রূপটা বের হয়ে আসে। মধ্যবিত্ত সমাজের আয় ঠিক ঠাক রাখা, জলবায়ু পরিবর্তন বা গণতন্ত্রের ধংসের প্রক্রিয়া রোধ করার মত দেশের সবচেয়ে জরুরী কাজগুলোর দিকে লক্ষ্য না রেখে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে খুবই সামান্য ও গুরুত্বহীন কিছু বিষয় নিয়ে। সেই সাথে তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় বিরোধী দলগুলোকে যে কোন ভাবে ঘায়েল করা। ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে যায়, যখন তারা প্রধান প্রধান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার পরও, সেগুলোকে সঠিকভাবে সমাধান করার জন্য কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ না করে। এখানে বিশ্ববাজারে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সুষ্ঠুভাবে না রফতানী হওয়ার কথাটা আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাদের ‘মাই ওয়ে অর দ্য হাইওয়ে’ পদক্ষেপটা এই সব সমস্যাগুলো সমাধান করার পরিবর্তে সমস্যাগুলোকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।

অল্প কথায় বলতে গেলে আমি বলতে পারি, হার্পার সরকারের প্রতি আমার যে ক্ষোভটা ধীরে ধীরে পঞ্জীভ‚ত হচ্ছিল, তার প্রধানতম কারণ ছিল যে, সেই সময় আমার মনে হচ্ছিল, এই সরকার আমাদের কানাডাকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। এই কানজারভেটিভরা দেশের সমস্যা দূর করার জন্য কোন বাস্তব সম্মত ক্ষেত্র তৈরী করতে পারে নি। তাদের পদক্ষেপের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ত্রæটি ছিল, তারা একে অপরের সাথে সমন্বয়য়ের ক্ষেত্র তৈরী না করে, বরং একে অপরের মধ্য বিভাজনের পরিবেশ সৃষ্টি করে। সম্ভবত, এগুলো ছিল তাদের কিছু রাজনৈতিক কৌশল এবং এই প্রক্রিয়ায় তারা দেশকে শাসন করতে চেয়েছিল। তুমি যদি কখনও নিজের সুবিধার জন্য জনগণকে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে শুধুমাত্র নিজের সুবিধার কথা ভাবো, আর পূব এবং পশ্চিম, গ্রাম ও শহর এবং কুইবেকের বিপক্ষের গোটা কানাডাকে দাঁড় করিয়ে দাও, তাহলে তুমি একটা নির্বাচনে জয়ী হতেই পারো। তবে শুধু এটা স্মরণ রাখতে হবে, এই নেতিবাচক কৌশলে একে অপরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফায়দা লুটার পর, একে অপরের স¤প্রীতি ও সহমর্মিতায় যে ক্ষতিটা হয়ে যায় তাকে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনাটা কখনও সহজ হয় না।

এমন এক পরিস্থিতি আর সময়ের মধ্য যখন আমি আমার সময় পার করছিলাম, তখনই অর্থাৎ ২০১২ সালের বসন্তে আমি সত্যি সত্যিই নেতৃত্বের জন্য প্রতিদ্ব›িদ্বতা করার চিন্তা শুরু করি। আমি যখন সেই পথে প্রায় পা বাড়িয়েই ফেলেছিলাম, তখনও আমার অনেক কাজ বাকী ছিল। সেই সময় আমার প্রথম কাজ ছিল অটোয়ার পার্লামেন্ট অধিবেশনে আমার ওপর অর্পিত যে সব কাজ ছিল, সেগুলো ভালোভাবে দ্রæত শেষ করা। সেই কাজগুলো দ্রুত শেষ করার বিশেষ কারণ ছিল, গ্রীষ্মে আমি যেন সোফি আর আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে একান্তে সময় কাটাতে পারি। আমি আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, রাজনীতিবিদদের পরিবারের ওপর কি ধরনের বোঝা চেপে বসে। আমি এই বিষয়টা আমার বাবা-মা’র জীবনে দেখেছি, এবং আমি উপলব্ধি করেছি, মাঝে মধ্যে এই বোঝাটা বহন করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়ে।

আমি গ্যারী বাটস এবং কেটি টেলফোর্ডের সাথে আলাপ করে এমন একটা দল গঠন করতে চেয়েছিলাম, যেটা এই যুদ্ধে আমাদেরকে সফল করার সব শক্তি যোগাবে, সেই সাথে আমরা এটাও ঠিক করে ফেলেছিলাম, একটা সফল নির্বাচনী প্রচারণার ভবিষ্যৎ পথ। তবে আমি সব সময় বিশ্বাস করি, এ ধরনের যে কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে শুধু আমাকেই।

কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো’র বাবা কানাডার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ইলিয়ট ট্রুডো। কানাডার ১৫তম প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৯ এবং ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন

খুব বেশী হলে আমি এই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য সোফির মত নিতে পারি, বা তার সাথে শেষ আলাপটা করে নিতে পারি। সেই গ্রীষ্মে সোফির সাথে আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েই অনেক দীর্ঘ ও কার্যকরী আলাপ করেছিলাম। আমাদের দুজনের বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে ভালো দিকটি হচ্ছে আমরা কখনও নিজেদের মধ্য কথা বন্ধ করিনি এবং যে কোন বিষয়েই আমরা দুজন দুজনের কাছে একেবারে খোলামেলা থাকি, আর আমরা দুজন দুজনের কাছে কখনও কিছুই লুকাই না। আমাদের এই কথা বার্তা বা আলোচনার বিষয়বস্তু যতই কঠিন বা যতই বিরূপ প্রকৃতির হোক না কেন, আমরা সব সময়ই এই নীতি অনুসরণ করে চলি। এই রাজনৈতিক জীবন কত বেশী কঠিন হতে পারে সেটা যেন সোফি ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারে, সেজন্যও আমি চাইতাম সে আমার জীবনের সাথে জড়িত সব বিষয়গুলোই ভালভাবে জানুক। আমি সোফিকে আমার বাবার একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। বাবা একসময় আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন কখনও মনে না করি রাজনীতির এই পথে আমাকে আসতেই হবে এবং দেশ ও দশের জন্য আমাকে দায়িত্ব নিতেই হবে। এই বিষয়টা বলতে গিয়ে তিনি আমাকে যে বিশেষ কথাটা বলেছিলেন সেটা সব সময়ই আমার কানে বাজে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের পরিবার কিন্তু যথেষ্ট করেছে।’ (চলবে)