ভজন সরকার : (৫)
খ্রিস্টপূর্ব প্রায় বিশ হাজার বছর আগে মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখেছে। এর আরও ছ’লক্ষ বছর আগে মানুষের তৈরী জিনিসের নির্দশন পাওয়া যায়। বলা যায় সভ্যতার প্রথম সোপান সে সময় থেকেই। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমাদের ভারতবর্ষের সমাজে এলো তার অনেক অনেক বছর পরে। যদি বেদকে ভারতবর্ষের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচরণের কাল বিবেচনা করি সেটাও মেরেকেটে চার হাজার বছরের বেশি হবে না। তাহ’লে এই লক্ষ লক্ষ বছর সমাজ ও সভ্যতা কি থেমে ছিল? যারা ধর্মের প্রয়োজনীয়তার সাথে সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতিকে মিলিয়ে ফেলেন তাঁরা ভেবে দেখবেন।
খ্রিস্টপূর্ব দু’ থেকে দেড় হাজার বছর আগে রচিত হয় প্রথম বেদ -ঋকবেদ। ঋক শব্দের অর্থ পদের সমাহার। আর এ পদের মাধ্যমেই দেবতার স্তব করা হতো। জানা যায়, তৃতীয় বেদ অর্থ্যাৎ যজুর্বেদের আমলেই সমাজকে কর্মভিত্তিক বর্ণবিভাজনে বিভক্ত করা হয়। তখন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে শ্রেণী বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হতে থাকে আমাদের এ ভারতবর্ষে।
সুকুমারী ভট্রাচার্যের গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, শাস্ত্রে আছে, “দক্ষিণা যজমানকে (যে যজ্ঞ করায়, তাকে) শুচি করে”। কিংবা অশ্বমেধ যজ্ঞে চারশো গাভী,চার হাজার সোনার মুদ্রা, চারটি বিবাহিতা নারী, একটি কুমারী, চারশো দাসী ও প্রচুর খাবার জিনিস দক্ষিণা হিসেবে ব্রাহ্মণকে দেয়ার নিয়ম ছিল তখন। এ দান- দক্ষিণা যতোটা দেবতার তুষ্টিতে- তার চেয়ে বেশী ব্রাহ্মণেরও নিজের প্রয়োজনে। তখন তো বটেই, এখনও ধর্ম ও ধর্মাচরণ নিজের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক প্রয়োজন মেটাবার ক‚টকৌশল ছাড়া বিশেষ কিছু নয়।
বাংলাদেশের এক অতি পরিচিত ব্যক্তি, যিনি চলচ্চিত্র পরিচালক তো বটেই, চাকুরীও করেছেন সরকারের অনেক উচ্চ পদে। নিজের পিঠ বাঁচাতেই তখন অবস্থান করছিলেন উত্তর আমেরিকায়। এক রাতে ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার অপরাধে পুলিশ তাঁকে থামিয়েছিল। পুলিশ অন্য সবাইকে যেমন করে, সেভাবে তাঁকেও জিজ্ঞেস করেছিল, ”তুমি কি এলকোহল পান করে গাড়ি চালাচ্ছো?” বাংলাদেশের এ ভদ্রলোক উত্তর দিয়েছিল, “না”। কিন্তু ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার অপরাধে পুলিশ তাঁকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করেছিল।
উত্তর আমেরিকাসহ উন্নত দেশে যেমনটি হয়, কোর্টে আপিল করলে কোর্ট কিছু জরিমানা মাপ করে দেয়। ভদ্রলোক কোর্টেই গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জরিমানা কমানোর সাথে সাথে আরেকটা আর্জি জানিয়েছিলেন পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশ নাকি তাঁর মতো একজন খাঁটি মুসলমানকে এলকোহল পানের কথা জিজ্ঞেস করে তাঁর ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছে। কোর্ট তাঁর এ আর্জি আমলে না নিলেও, উপস্থিত সে পুলিশ অফিসার কোর্ট শেষে বাংলাদেশের ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছিলেন, তিনি যে মুসলমান সেটা তিনি (পুলিশ অফিসার) বুঝতে পারেননি। তাই তাঁর ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগলে তিনি দুঃখিত।
কিন্তু সব চেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এক পার্টিতে বাংলাদেশী ওই চিত্র পরিচালক ভদ্রলোক যখন মহাআমোদে এ গল্পটি বলছিলেন তখন তাঁর হাতে ছিল এলকোহলের গ্লাস।
যাঁরা এ ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন উদাহরণ হিসেবে মনে করছেন, তাঁরা ভুল করছেন। কারণ, প্রতিটি প্রচলিত ধর্মকেই মানুষ শত শত বছর যাবৎ এ ধরণের হীন ক‚টকৌশলের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে; সেটা কখনো ব্যক্তিগত আবার কখনো কখনো দলগত বা গোষ্ঠীগত ভাবে। সে ব্যবহারের পেছনে ধর্মবিস্তার, আধিপত্যবিস্তার, অর্থনৈতিক কিংবা জৈবিক চাহিদা ছাড়া অন্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছিল-সেটা বলা যাবে না। আর এর ফলে যুগ যুগ ধরেই এ পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে নির্মম ও মর্মন্তুদ সব নৃশংসতা।
আমাদের ভারতবর্ষ ১৯৪৭ সালে দেশবিভাজনের সময় ধর্মের নামে যে নিমর্মতা দেখেছে কিংবা যা দেখেছে ১৯৭১ সালে- সেটা অন্য সব কিছুকেই হার মানায়। আফগানিস্তান-পাকিস্তান-সিরিয়া-ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষের এখনও যে প্রাণহানি, তার পেছনেও আছে ধর্মীয়-বিশ্বাস-প্রতিষ্ঠার নামে এক মধ্যযুগীয় পাশবিকতা।
(৬)
আমাদের সমাজে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, প্রচলিত ধর্ম নীতি-আদর্শ শেখায়। অথচ বিষয়টি সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রতিটি প্রচলিত ধর্মই মানুষকে শেখায় কিছু বিভাজনের নির্দেশ; যা ভেঙ্গে বিশ্বাসী মানুষের বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া সমাজ বা দেশ চালানোর জন্য ধর্মীয় নীতি-আদর্শের কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই।
শ’শ’ বছর ধরে রাস্ট্রবিজ্ঞানী বা সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজ বা রাস্ট্র পরিচালনার জন্যে হাজারো নীতি-আদর্শ-আইন –কানুনের কথা লিখে গেছেন। এ কথাও বলে গেছেন একটি আদর্শ সমাজ বা আধুনিক রাস্ট্রের কোন ধর্মবিশ্বাস থাকতে নেই , থাকবেও না। এটা শুধু বইয়ের কথা নয়, একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এ পৃথিবীতে প্রায় সব ধর্মীয় রাস্ট্র মাত্রই দুর্ণীতিবাজ ও ব্যর্থ রাস্ট্র।
অনেকে বলেন সমাজবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের ধর্মের প্রয়োজন। কথাটি সম্পূর্ণ ভুল। ধর্ম বিশ্বাস বা ঈশ্বর ব’লে যদি কিছু থাকে, তবে তা বেশী প্রয়োজন ব্যক্তি বা একাকী মানুষের। কারণ, একাকী মানুষ মাত্রই সাধারণত কিছুটা অসহায় মানুষ। আর সমাজবদ্ধ বা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের পাশে সাহায্য করবার থাকে সমাজ বা গোষ্ঠী। কিন্তু প্রচলিত ধর্ম যখন মানুষের সমাজ বা গোষ্ঠী বন্ধনের উপায় হিসেবে দেখা দেয়, সমস্যা দেখা দেয় তখনি। প্রচলিত ধর্ম তখন “স্পিরিচুয়ালিটি”-র মতো গালভরা বুলিকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হানাহানি বা লাভ-ক্ষতির হিসেব নিকেষ কষতে ব্যবহ্নত হয়। আসলে হচ্ছেও সেটাই।
অনেকেই প্রচলিত ধর্মের পক্ষে বলতে গিয়ে তথাকথিত দর্শন-তত্তে¡র আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে অযথা সময় ব্যয় করেন। প্রচলিত ধর্মের ভিতর যে দর্শণ আছে সেটুকু কিতাবের গরু, গোয়ালের নয়।
এ কথা নিঃসংকোচেই বলা যায়, পৃথিবীর কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই দর্শণ তত্তে¡র ভিতর দিয়ে বিস্তার লাভ ক’রে ক’রে এতোদূর আসেনি- সম্ভবও নয়। সভ্যতার অগ্রগতিতে কোনো প্রাতষ্ঠানিক ধর্মই সহায়ক ভূমিকা নেয় নি বরং বাধা হয়েই দাঁড়িয়েছে। সমাজ ও রাস্ট্রের যেরকম প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধর্মের প্রয়োজন নেই, ঠিক তেমনি ধর্মের প্রয়োজন নেই কোনো সংস্কৃতিবান, শিক্ষিত ও যুক্তিবাদী মানুষেরও।
(৭)
আমি ধর্মবিশ্বাসী কোনো মানুষ নই ; ছিলামও না কোনোদিন। আর ধর্মবিশ্বাসী হবো কিনা সে নিয়েও সন্দেহ ও সংশয় আছে। আর প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী হ’বার কোনো যুক্তিসংগত কারণও বোধ হয় নেই। তবু ধর্ম বিশেষত প্রচলিত ধর্ম নিয়ে আগ্রহ আছে। তাই সাগ্রহে প্রায় সব প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের দূর থেকে বুঝতে চেষ্টা করি। সে চেষ্টা যে সব সময় সুখকর হয় তা নয় বরং আশাহত শুধু নয়, বেদনাহত হতেই হয় বেশীর ভাগ সময়।
তবুও ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। সে লেখালেখি গবেষণালব্ধ কিছু নয়। বরং আশেপাশের ধর্মবিশ্বাসীদের বিশ্বাস ও ভড়ং দেখে এবং নিজের সাধারণ ও সহজ বুদ্ধি দিয়ে যা বুঝি সেটাই বোঝাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করি। জানি অধিকাংশই ক্ষেত্রেই তা উলুবনে মুক্তো ছড়ানো হয় । আবার কখনো কখনো সে উলুবন থেকে উত্থিত উল্লুকের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষতও হই। তবুও লিখি-লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি এমন কোনো কেউকেটা নই যে ক্ষমতার দাপটে কিংবা জনপ্রিয়তার মোহাবিষ্টে মোহিত করে সমাজে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন করে ফেলবো। তাই আমার অবস্থা সেই দুর্বল ভদ্রলোকের চিটাগাং থিওরি বা মোরগের একমাত্র বাঁচার তত্তে¡র মতো।
এক ভদ্রলোকের সাইকেল চুরি গেছে। প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচিতে তিনি পাড়া মাতিয়ে তুলে বলছেন, “আমি মাত্র এক ঘন্টা দেখবো। সাইকেল না পেল চিটাগাং যা করেছিলাম তাই করবো। আমাকে তো চোরে এখনও চেনেনি।”
পরে দেখা গেল ভদ্রলোকের দাপট দেখে চোর ভয়ে সাইকেল ফেলে পালিয়ে গেছে। আশেপাশের মানুষজন জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, একটু শুনতে পারি ,চিটাগাং কী করেছিলেন?”
ভদ্রলোক বললেন, “দেখেন ভাই, আমি নিরীহ মানুষ। সে বার চিটাগাং আমার সাইকেল হারিয়ে গেল। অনেক অপেক্ষার পরেও যখন সাইকেল পেলাম না, তখন চলে এলাম সাইকেল ছাড়াই।”
বনে শিয়ালের আক্রমন হলো। পশু-পাখিরা যে যার মতো ছুটে পালালো। যারা জীবিত ছিল পরে এসে যার যার পলায়ণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলো।
মোরগের কাছে জিজ্ঞেস করতেই মোরগ বললো, “আমি তোমাদের মতো এতো উপায় জানি না, জানি শুধু গাছে ওঠা। তাই আমি যা জানি, সেটাই করেছি”।
আমার অবস্থাও সেই দুর্বল ভদ্রলোক ও মোরগের মতো। যেটুকু লেখালেখি জানি, তা দিয়েই নিজের বুঝটুকু বোঝাতে চাই। কে বুঝলো আর কে বুঝলো-না, সে দিকে তাকাবার ইচ্ছে কিংবা সময় কোনোটাই নেই।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)