ভজন সরকার : (১০)
পরিণত বয়সে মানুষ একটু বেশি ধর্ম-কর্ম করে থাকেন। এ কথা সব প্রচলিত ধর্মেই উল্লেখ আছে যে, ধর্ম যতটা হইজাগতিক তার চেয়েও বেশি পারলৌকিক। অর্থাত এ পৃথিবীতে সবাই কমবেশী দুঃখ-কষ্টে জীবন অতিবাহিত করে থাকে; অর্থ কষ্ট, প্রভাব-প্রতিপত্তি-যশ-খ্যাতি না-পাওয়ার কষ্ট এবং সর্বোপরি প্রিয়জন বিয়োগের কষ্ট। তাই যখন কোনো ধর্মগ্রন্থে এক অনাবিল সুখ-শান্তি-ভোগ-বিলাসের অফুরন্ত প্রলোভন থাকে, মানুষ স্বভাবতই সে দিকে আকৃষ্ট হয়। আর সে না-দেখা জগতের জন্য ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত সব কিছু পালন শুরু করে। অথচ একবারও মানুষ ভাবে না যে, এ সকল প্রলোভন কতটুকু ফ্যান্টাসি আর কতটুকু বাস্তব!
আমি মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশের আধ্যাত্বিক গুরুদের কথা শুনি। অনেকদিন পরে ভারতীয় এক যোগী ও আধ্যাত্বিক গুরুকে পেলাম, যিনি অনেকের চেয়েই বাস্তববাদী ও যুক্তিবাদী। যা হোক, ওই আধ্যাত্বিক গুরুর নাম –যশ প্রচার করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আর করবও না। শুধু পরলোক সম্বন্ধে তার কিছু কথা এখানে উল্লেখ করব যা আমারও ভালো লেগেছে।
এ গল্পটা আমেরিকার। ধর্ম ক্লাশে শিক্ষক ছাত্রদের জিজ্ঞেস করছে, “বলতো স্বর্গে যেতে হলে কী করতে হবে?”
এক ছাত্র বলল, “যদি চার্চের বেঞ্চ ও ফ্লোরের ধুলোময়লা পরিষ্কার করি, তবে স্বর্গে যেতে পারব।”
আরেক ছাত্র বলল, ” যদি গরিব মানুষের সাথে নিজের খাবার ভাগ করে খাই,তবে স্বর্গে যেতে পারব। ”
আরেকজন বলল, “যদি ভালো মানুষ হই, তবে অবশ্যই স্বর্গে যেতে পারব।”
দশ বছর বয়সের টম দাঁড়িয়ে বলল, “স্বর্গে যেতে হলে প্রথমে মৃত্যু বরণ করতে হবে।”
অথচ আমরা কেউই মরতে চাই না।
(১১)
আসলে পরলোকে বা স্বর্গে যাবার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো মরা। মানুষকে দৈহিকভাবে প্রথমে মরতে হবে। অর্থাত কেউই পৃথিবীর এ অবয়ব বা দেহ নিয়ে স্বর্গে যেতে পারবে না। আর সেটা সম্ভবও নয়। কারণ, প্রতিটি প্রচলিত ধর্ম মতেই মানুষের দেহকে হয় মাটিতে পুঁতে রাখা হয় কিংবা আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা হয়। আর সেই পচা-গলা কিংবা ভস্মীভূত দেহ তো আর ফিরিয়ে এনে পূনর্গঠন করা সম্ভব নয়।
তাই এ পৃথিবীর কোনো মানুষ যদি স্বর্গেও যায় , তবে এ দেহ পৃথিবীতে রেখেই যেতে হবে। আর কোনো প্রচলিত ধর্মেই মৃত্যুর পরে মানুষ কিভাবে কোন আকৃতি ধারন করবে তার বিশদ বর্ণনা নেই।
আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই, মানুষ এ পৃথিবীতে যে আকৃতি বা দেহাবয়ব নিয়ে জন্মেছিল, স্বর্গেও সেটাই নিয়ে যাবে। তবেই মহামুষ্কিল। কারণ, যে ভদ্রলোক আশি বছর বয়সে ডায়াবেটিস নিয়ে মারা গেল, সে স্বর্গে গিয়ে কিভাবে সুস্বাদু খাবার খাবে। কিংবা যে ভদ্রলোকের প্রোস্টেট ফেলে দেয়া হয়েছে, এতো সুন্দরী হুরপরী তার কি কোনো কাজে আসবে?
তাই দেখা যায়, সব প্রচলিত ধর্মেই স্বর্গের সব কিছুই অফুরন্ত-সতেজ-কুমারী কিংবা ভার্জিন। কারণ, দেহই যদি না থাকে তবে হুরপরীদের ভার্জিনত্ব নষ্ট হবে কিভাবে?
(১২)
মোদ্দা কথা হলো, অবৈজ্ঞানিক বা অযৌক্তিক সব কিছুর ভিতরই ফাঁক-ফোকর থাকে। তথাকথিত স্বর্গ বা নরকের কথিত বর্ণনাতেও এ রকম গাঁজাখোরি সমস্ত কাহিনি লেখা আছে। অথচ এই সব গোলমেলে বা অবাস্তব কথা না বলে যদি প্রতিটি ধর্ম গ্রন্থে এ পৃথিবীতে মানুষের শান্তিতে বসবাস করার এক সর্বজনীন ও মানবিক কথা বলা হতো, তবে এ পৃথিবীতে এত হানাহানি থাকত না।
ধর্মগ্রন্থে না থাকলেও আমাদের বাংলাদেশেরই এক কবি একশ’ বছর আগে বলে গেছেন এই স্বর্গ-নরক বা বেহেস্ত-দোজগ নিয়ে এক বাস্তবসম্মত গুরুত্বপূর্ণ কথা। তাঁর নাম শেখ ফজলুল করিম ( জন্ম ১৮৮২ খ্রিঃ- মৃত্যু ১৯৩৬ খ্রিঃ)।
স্বর্গ ও নরক
শেখ ফজলল করিম
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে।
তিনি একশ’ বছর আগে যে চিন্তা করে গেছেন, আমরা সেখান থেকেও পিছিয়ে এসেছি; এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য ও দুর্ভাবনা।
(ভজন সরকারঃ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)