খুরশীদ শাম্মী
আমাদের জীবন থেকে দিন দিন সহিষ্ণুতা শব্দটি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অসহিষ্ণুতা ভর করেছে এমনভাবে, মানবিকতার কোমর নুয়ে পড়েছে। বিবেক ভয়ে পালিয়েছে। এই সুযোগে অমানবিকতা বাতাসে উড়ে। যেমন, আজকাল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে প্রায়ই মারামারি, কাটাকাটি, ধর্ষণ, খুনের মতো অপরাধের ভিডিও ঘুরে বেড়ায়। ওগুলো আবার ইউটিউবেও আপলোড করে দেয়া হয় যেন মানুষ ইচ্ছে করলে দেখতে পারে। অথচ ওই ভিডিওগুলো সাধারণ সুস্থ মানুষদের দেখার কোনো প্রয়োজনই নেই। দুর্বল হৃদয়ের মানুষদের জন্য ওগুলো বিষের মতো। তবে, ভিডিওগুলো দরকার কেবল বিচারকের বিচার প্রক্রিয়া নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে।
মানবিকতা যখন মুখ থুবড়ে পড়ে। তখন মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় ঈর্ষা, হীনমন্যতা। হিংসা ও হীনমন্যতা আমাদের মধ্যে সংক্রামিত হয়ে আমাদের অসুস্থ করে তুলে। আমরা সুস্থভাবে আর ভাবতে পারি না, ভাব প্রকাশও করতে পারি না। তাই পরস্পর নিকৃষ্ট ভাষায় গালাগাল করি, মিথ্যা ও ভুল তথ্যে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করি। নিজেকে বড় জাহির করার চেষ্টা করি। আবার ধূর্ত শ্রেণির অনেকে নিজে অন্তরালে থেকে অন্যকে দিয়ে মন্দ কাজগুলো করিয়ে নেই। কিন্তু এগুলো একটাও কি আমাদের মধ্যে এক চিলতে আনন্দ দেয়? যদি মানুষ হই, তবে উত্তর হবে “অবশ্যই না।”
দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজকাল এগুলোতেও অনেকে আনন্দ পেয়ে থাকি। শুধু আনন্দ পাই না, আনন্দ ভাগাভাগি করে উপভোগ করার চেষ্টা করি। অট্টহাসিতে অন্যের কান্নাকে উপভোগ করি।
কেন? কেন আমরা এগুলোতে জড়িয়ে পড়ি?
ক্ষুদ্রতার ভরে নিজেকে ভালো করে জানি না বলেই এগুলোতে আমরা জড়িয়ে পরি।
আমরা কথায় কথায় বলি, আধুনিক বিশ্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রতিদিনই এগিয়ে যাচ্ছে। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এমন কি বলতে পারি হাতের মুঠোয় মুঠো ফোনেই পাওয়া যায় বিশ্ব। অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে গেছে তা অনেক হয়তো। “হয়তো” বললাম, কারণ বিশ্বের এক প্রান্তে যেমন দেখি অতিরিক্ত খাবার গুদামজাত হতে এবং পরবর্তীতে তা ফেলে দিতে ঠিক তার অন্য প্রান্তে দেখি খাদ্যের অভাবে ক্ষুধিত মানুষের কষ্টের ছবি।
এত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের মন মানসিকতার কি খুব বেশি পরিবর্তন কিংবা উন্নয়ন হয়েছে?
উত্তরঃ না। বিশ্বের অন্যান্য বিষয়ের সাথে তুলনামূলকভাবে মানুষের মন মানসিকতার তেমন উন্নয়ন হয়নি। এর কারণ, আমরা আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে চিরস্থায়ী ভেবে কাজ করি। অর্থাত্ শুরুতেই পরিকল্পনায় ভুল করি। পরিকল্পনায় ভুল অর্থ হচ্ছে পদে পদে ভুল। ভুলে যাই, জীবনে শিক্ষা ও শিক্ষার সদ্ব্যবহার যে কতটা প্রয়োজন! অর্থ ও সময় ব্যয় করে কোনো নামকরা শিক্ষালয় থেকে দু’-চারটা সনদপত্র সংগ্রহ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গৌরব অর্জন করি বটে। তবে, শিক্ষার সদ্ব্যবহার নিয়ে সংশয় আছে। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন ও পারস্পারিক প্রতিযোগিতার লড়াইয়ে কখন যে সময় ফুরিয়ে আসে, নিজের ভেতরের খবর আর রাখতে পারি না। ঠিক মতো মনুষ্যত্বের পরিচর্যা করতে ব্যর্থ হই। ক্ষুদ্রতা বাসা বাঁধে মনে।
প্রতিটি ক্রিয়ার যেমন প্রতিক্রিয়া আছে, ঠিক তেমনি, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অভাবে নেতিবাচক প্রভাবও আছে। এখন নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগবে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা তবে কী? গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তো অভাব নাই। হ্যাঁ, প্রতিটা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সময়ের আবর্তনে ভিন্ন হতে পারে। যার যখন যেটা থাকে না কিংবা জীবন ও জীবিকার জন্য যেটা প্রয়োজন, তখন তার জন্য সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আজ হয়তো আমার জন্য চাকরি, কিন্তু অন্য কারো জন্য স্বাস্থ্য, কিংবা সংসার, ইত্যাদি। কাল হয়তো অন্য কারো জন্য চাকরি এবং আমার জন্য স্বাস্থ্য। বিষয়গুলো চক্রাকারে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে সবার জন্য সর্বকালের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিজের ভেতরে বাস করা মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্বের গুরুত্ব এক মুহুর্তের জন্যও শেষ হয় না, কমেও না।
পৃথিবীতে যতো বড় ধরণের অপরাধ ঘটে, যেমন, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, কাটাকাটি, ইত্যাদি, সেগুলো সবই ঘটে ওই মুহুর্তে মনুষ্যত্বের অনুপস্থিতিতে। এমন কি আমরা মানুষ হত্যা- খুন, ধর্ষণের মতো অপরাধের পরিকল্পনা করি তখনই।
মনুষ্যত্বের পাশাপাশি আমাদের ভেতরে বেড়ে ওঠে বিবেক। যে যতো যত্ন নিয়ে নিজের মনকে, ভেতরের মানুষটাকে পরিচর্যা করে, তার মনুষ্যত্ব তত সমৃদ্ধ হয়। সাথে সাথে বিবেকও হয় দৃঢ়, সতেজ ও সজীব। ন্যায়- অন্যায় ভেদাভেদ করতে কোনো বেগ পেতে হয় না। ন্যায়ের পক্ষ্যে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে আর ভুল হয় না।
অংকের মতো সূত্রে ফেলা যায় জীবনের সবকিছু। তবুও সরল অংকের মতো বেশি বেশি ভুল হয়। আমরা আমাদের নিজেদের যত্ন নেই না। আমরা নিজেকে জানতে চেষ্টা করি না, কিন্তু অপরের সবকিছু নিয়ে গবেষণা করি। সুযোগ পেয়ে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে পরিবেশ। ওদিকে সহিষ্ণুতা জানালা দিয়ে পালায়। খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও