Home কলাম আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না

আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না

ভজন সরকার : শাবানা আজমি-জাভেদ আখতার দম্পতিকে আমি পছন্দ করি। শাবানা আজমির অসাধারণ অভিনয় তো আছেই অনেক ভালোলাগা গানের গীতিকার জাভেদ আখতার। হিন্দি বুঝি না। হিন্দি সিনেমা ইংরেজি সাবটাইটেল দিয়েই আগে দেখতাম। এখন তো দেখিই না। হিন্দি গানের ক্ষেত্রেও সেটাই প্রযোজ্য। হিন্দি গানের সুর খুব মেলোডিয়াস। সুরে মাদকতা আছে। কথার না-বোঝটুকু সুরে ঢেকে যায়।

চাকুরী জীবনের প্রথম বছর বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বরগুনাতে ছিলাম। শহরে ঢোকার মুখেই খাল। একটি ব্রিজ খালের ওপর। খাল-সংলগ্ন সরকারি ডাকবাংলো। এখানেই থাকতাম এক রুম নিয়ে। পাশাপাশি রুমে থাকতেন পুলিশের এক সহকারী কমিশনার। নাম ভুলে গেছি। পুলিশের ওই ভদ্রলোক ছিলেন ডাক্তার। ইঞ্জিনিয়ার আর ডাক্তারের মধ্যে মনের ও মতের মিলে হয়ে গেল। বিকেল-সন্ধে ওই সিনিয়র ভাইয়ের সাথে গল্প করতাম। ভদ্রলোক হিন্দি গানের ভক্ত। আমি বলতাম, হিন্দি গান বুঝি না। ভদ্রলোক বুঝিয়ে দিতেন। তখন জাভেদ আখতারের নাম প্রথম শুনি। আসলেই জাভেদ আখতারের লেখা গানগুলোতে সুন্দর কথা এবং গভীর মর্মার্থ আছে। বেশ ভালো লাগতো অর্থ বুঝে হিন্দি গান শুনতে।

একদিন ঢাকা নিউ মার্কেটের ক্যাসেটের দোকান থেকে উচ্চস্বরে বাজা একটা হিন্দি গানে কান আটকে গেল। পরে জানলাম ওই গানগুলো সদ্যমুক্তি পাওয়া একটি হিন্দি সিনেমার গান। সিনেমার নাম “1942 A Love Story”। জীবনে প্রথম হিন্দি গানের সিডি কেনা। অনেক বছর গানগুলো শুনে মুগ্ধ হয়েছি। গাড়িতে যতদিন সিডি পোর্ট ছিল ওই “1942 A Love Story”-র গানগুলো অনিবার্যভাবেই বেজেছে। গানগুলোর গীতিকার জাভেদ আখতার এবং এই সিনেমার গানগুলোই মনে হয় বিখ্যাত সুরকার রাহুল দেব বর্মন (আর ডি বর্মন)-এর সুর করা শেষ গান।

পরে জাভেদ আখতার হয়ত আরো বিখ্যাত সিনেমার জনপ্রিয় গানের কথা লিখেছেন কিন্তু হিন্দি গানের প্রতি আকর্ষণ আর কখনোই নতুন করে জাগেনি। তাই জাভেদ আখতারের লেখা গান আমাকে আর আপ্লæত করতে পারেনি। শাবানা আজমির কিছু সিনেমা দেখেছি এর পরেও। কিন্তু জাভেদ আখতার আমার কাছে ম্রিয়মানই ছিলেন অনেক বছর।

মাত্র কিছুদিন আগে জাভেদ আখতারকে নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সে খবরে আমিও একটু বিস্মিতই হয়েছি। জাভেদ আখতার তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে টুইট করে বলেছেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা যদি আমেরিকায় বহিরাগত না হোন তবে মোগল সম্রাটেরা ভারতবর্ষে বহিরাগত হোন কিভাবে? জাভেদ আখতার মোগল সম্রাটদের মধ্যে “সম্রাট শাহজাহান”-এর কথাই উল্লেখ করে বলেছেন, ভারতবর্ষেই তো শাহজাহানের জন্ম তাই শাহজাহানকে বহিরাগত বললে বারাক ওবামাকেও আমেরিকায় বহিরাগত বলতে হবে।
বোঝাই যাচ্ছে জাভেদ আখতার ক‚তর্ক করেছেন এবং লজিক্যাল ফ্যালাচি বা ভুল যুক্তি দিয়ে তর্ক করেছেন। কথায় আছে, সাথে “তলা” শব্দটি কমন থাকলেও “জুতার তলা আর চৌকির তলা এক নয়”। জাভেদ আখতার সেই রকম অসম যুক্তি দিয়ে মোগল সম্রাটদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেছেন; একজন কমিউনিষ্ট, একজন প্রগতিপন্থী এবং একজন ধর্মনিরপেক্ষ-অসা¤প্রদায়িক জাভেদ আখতারের কাছে এ রকম খেঁড়ো যুক্তি খুব দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত।

বৃহত্তর ভারতবর্ষের একজন নাগরিক তিনি যদি একটু ইতিহাস সচেতন হোন, তবে তার কাছে ভারতে মোগল সম্রাটদের আধিপত্যের ইতিহাস অজানা থাকার কথা নয়। মাধ্যমিক স্তরের যে কোন ছাত্রই জানেন, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে কিভাবে সম্রাট বাবর বা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। সম্রাট বাবর ছিলেন বর্বর এবং রক্তপিপাসু চেংগিস খান এবং তৈমুর খানের বংশধর।

মোগল সম্রাট বাবরের অত্যাচার ইতিহাসের পাতা ঘাটলেই দেখা মেলে। সম্রাট বাবর থেকে শুরু করে প্রায় সব মোগল সম্রাটের সময়েই ভারতবর্ষের বহুত্ববাদী দর্শণকে বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে ব্যাপক ধর্মান্তরিত করা হয়। অন্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোকে জোরপূর্বক ভেংগে ফেলা হয় কিংবা রূপান্তরিত করে মসজিদে পরিণত করা হয়। কিছুটা ব্যতিক্রম সম্রাট আকবর। সম্রাট আকবর সব ধর্ম সম্বন্বয়ের কথা বলে “দ্বীন-ই-এলাহি” নামে নতুন ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। সম্রাট আকবরের আমলে শিল্প-সাহিত্য-সংগীত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল, যা ছিল নিতান্তই ব্যতিক্রম।
তাই কেন যে জাভেদ আখতার সাহেব বারাক ওবামার সাথে সম্রাট শাহজাহানের তুলনা করলেন সেটি জেনে আমি যারপরনাই বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পূর্বপুরুষ কি আমেরিকা দখল করতে আমেরিকায় এসেছিলেন? নাকি, বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছিলেন? নাকি, অন্য ধর্মের উপসনালয়গুলোকে ভেঙ্গে গীর্জায় পরিণত করেছিলেন? অথচ এ সব কিছুই করেছিলেন মোগল সম্রাটেরা। সম্রাট শাহজাহান তো করেছিলেনই। তাছাড়া বর্তমান বিশ্বে অভিবাসনের ধারণাটি কি ষোড়শ শতকের সাম্রাজ্য বিস্তারের অনুরূপ ছিল?
জাভেদ আখতার যতই বলুন না কেনো, মোগল সম্রাটেরা ভারতবর্ষে দখলদার বহিরাগত হিসেবেই পরিচিত হয়ে এসেছেন শ’শ’ বছর ধরে এবং সে পরিচয় জাভেদ আখতার মুছে ফেলে ইতিহাস বদলে দিতে পারবেন না।

ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে এক সময়ের কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের মধ্যে কিছু কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ মানুষগুলো যেনো বিজেপিকে রুখতে অন্যান্য মৌলবাদী দলগুলোকে কাছে টানছেন । কিন্তু এটা তো সত্য যে, এক উগ্রপন্থাকে অন্য উগ্রপন্থা দিয়ে প্রতিহত করা যাবে না। এক ধর্মীয় মৌলবাদকে অন্য ধর্মীয় মৌলবাদ দিয়ে প্রতিহত করা যাবে না। যে কোনো ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রতিহত করতে হবে অসা¤প্রদায?িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে।

জাভেদ আখতার সাহেব কি বিজেপি বিরোধী হতে গিয়ে কট্টর মুসলমান হয়ে যাচ্ছেন? নাকি শেষ বয়সের ভীমরতিতে মৃত্যুর পরের অদেখা অলৌকিক জীবনের প্রতি বেশী আসক্ত হয়ে শেষ বয়সে ধর্মকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন? এ দু’টোর যেটাই হোক না কেন,এক সময়ের কট্টর কমিউনিষ্ট এবং চরম নাস্তিক জাভেদ আখতারের জন্য তা মানানসই নয়। বরং সেটি হবে তার পরাজয় এবং সারাজীবনের অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে ফেলা। আর যাই হোক শাবানা আজমি- জাভেদ আখতার জুটির জাভেদ সাহেবের কাছে এটি কখনোই কাম্য হতে পারে না।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)

Exit mobile version