জেমস এ রিসচার, অনুবাদ: কোরবান আলী : (প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে এক অপার শক্তি। এই শক্তিতে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে গেলে একজনের প্রয়োজন একান্তে নিজের ভেতরে প্রবেশ করা, নিজেকে উপলব্ধি করা আর নিজের শক্তি বৃদ্ধির চর্চায় নিজেকে নিমগ্ন করা। মানুষের এই নিমগ্নতা মানুষকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা অন্যদের মুগ্ধ করে। ‘স্পিরিচুয়াল লিডারশীপ’ বিষয়ক গ্রন্থের লেখক এবং ‘অর্গানাইজেশন ট্রান্সফরমেশন নেটওয়ার্ক’ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জেমস এ রিসচার সুক্ষ্মভাবে আলোচনা করেছেন মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই পরম শক্তি নিয়ে এবং কিভাবে এই শক্তিকে ব্যবহার করে সত্যিকারের নেতৃত্ব অর্জন করা যায়। জেমস এ রিসচার এর আলোচনার আধ্যাত্মিকতা ও নেতৃত্ব বিষয়টি সাপ্তাহিক ‘বাংলা কাগজ’ এ ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।)
এক.
মৌলিকত্ব, আত্মশক্তি এবং দর্শনের অনুভূতিই হচ্ছে অতিপ্রাকৃত শক্তি। যাকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের হৃদয় বলা যেতে পারে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে অতিমাত্রায় উদ্দীপ্ত মনে হয়। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান কিভাবে কাজ করে। নেতৃত্বের একটা মৌলিক কাজ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের জীবনীশক্তিকে উদ্দীপ্ত করা এবং অত্যন্ত স্পষ্টভাবে সকলের সম্মুখে তুলে ধরা। এখানে একজন অসাধারণ নেতার ১০টি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা দেয়া হল যা যে কোন প্রতিষ্ঠানকে মৌলিকত্ব দিতে পারে। কার্যকর করে তুলতে পারে এবং একটা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে পারে।
অসাধারণ নেতৃত্ব বা অতিপ্রাকৃত নেতৃত্ব বলতে দুটি বিষয়কে নির্দেশ করা যেতে পারেঃ
ক. ব্যবসা বা অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠানে মৌলিক ক্ষমতা সম্পন্ন নেতৃত্ব।
খ. পরিবর্তনক্ষম নেতৃত্ব (Transformational Leadership)- যে নেতৃত্ব অসাধারণ শক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং খুব গভীরে প্রবেশ করার ক্ষমতা রাখে যা একটা মৌলিক এবং অগ্রগামী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সৃষ্টিতে অত্যন্ত কার্যকর তাই অসাধারণ নেতৃত্ব।
যখন আমি অতিপ্রাকৃত শব্দটি উচ্চারণ করি তখন ধর্মীয় অনুভূতিকে নির্দেশ করি এমনটি নয়। ধর্ম হচ্ছে একটা প্রতিষ্ঠান যা একদল মানুষকে অলৌকিক শক্তির অভিজ্ঞতা প্রদান করে যার ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। আধ্যাত্মিকতা যদিও অতিমাত্রায় ব্যক্তি কেন্দ্রিক; এটা কোন বাহ্যিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না। তাছাড়াও আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে জীবন ঘনিষ্ট অভিজ্ঞতা। যা আত্মার সাথে একনিষ্ঠভাবে বসবাস করে। আধ্যাত্মিকতা বাহ্যিক বা অগভীর কোন বিষয় নয়। কোন কোন ব্যক্তি মনে করেন আধ্যাত্মিকতা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসবোধের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারও কারও মতে আধ্যাত্মিকতার রূপ বিভিন্ন হতে পারে। যত যাই বলিনা কেন সেটা আমাদের সংকীর্ণতা ও অহংবোধ প্রসূত ধারণা, আসলে আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে সাধারণ জীবনবোধের অনেক উর্ধ্বের বিষয়।
আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে একটা অলৌকিক শক্তির অভিজ্ঞতার সাথে সংশিষ্ট এবং আত্মশক্তি ব্যবসার ক্ষেত্রে একটা অপরিহার্য বিষয়। ব্যবসা ক্ষেত্রে বিভিন্নরূপে এর আবির্ভাব ঘটে। সমস্ত ক্রীড়াবিদ এবং শিল্পী আসলে এ ধরণের শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তথা নৈপুণ্য প্রদর্শন করে। একজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী অথবা একজন অলিম্পিক শরীরকলাবিদের মৌলিক উদ্যম বহিঃপ্রকাশের কথা ভাবুন। পৃথিবীতে শক্তি ও ফলাফলের মধ্যে উচ্চ মাত্রায় সংশ্রব বিদ্যমান। একটা খেলাধুলার ইভেন্টের ফলাফল শারীরিক দক্ষতার চেয়ে মানসিক শক্তির উপর বেশি নির্ভরশীল। যে কোন ঘটনার পিছনে এমনই একটা আত্মশক্তি ক্রিয়াশীল যা কতগুলো মানুষকে একত্রে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অথবা অন্য যে কোন প্রতিষ্ঠান কতগুলো মানুষকে একত্রিত করে যারা অবশ্যই একে অপরের সাথে কার্যকরভাবে যোগাযোগ স্থাপন করে ফলাফল বের করে আনে। যে সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মানসিক শক্তিতে বলীয়ান তারা দ্রæত অপেক্ষাকৃত ভাল এবং কার্যকর ফলাফল বের করে আনতে পারে। একারণে অসাধারণ নেতৃত্ব তথা আত্মশক্তিসম্পন্ন নেতৃত্ব একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয়।
অসাধারণ নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ
একটা প্রতিষ্ঠানের কার্যকর শক্তি হচ্ছে এর মৌলিক প্রকৃতি তথা প্রতিষ্ঠানের হৃদয়। মৌলিকতা, শক্তি, দর্শন এবং উদ্দেশ্যের অনুভূতিই হচ্ছে আত্মশক্তি, ভেতরের শক্তি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই মৌলিক শক্তি বিদ্যমান। কোন কোন ক্ষেত্রে এই মৌলিক শক্তি ভোতা বা নিষ্প্রভ অবস্থায় বিদ্যমান। একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভেতরের শক্তির ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের জন্য সুনির্দিষ্ট দক্ষতা প্রয়োজন যেমন আর্থিক ব্যবস্থাপনার কথা বলা যেতে পারে।
আমার মতে খুব কম ব্যবস্থাপকই এই ধরনের নেতৃত্বের প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া বোঝেন এবং আরাও কম ব্যবস্থাপক এ প্রক্রিয়া দক্ষতার সাথে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে আনতে পারেন। যদি নেতৃবৃন্দ এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে সক্ষম না হন, অথবা যদি প্রাতিষ্ঠানকে উদ্দীপ্ত করতে না পারেন, তবে সামান্য আঘাতেই প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। শুধু মাত্র সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই টিকে থাকার ইচ্ছা ও শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম যে প্রতিষ্ঠান অত্মশক্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত।
অসাধারণ নেতৃত্বের দশটি বৈশিষ্ট
যখন কোন ব্যবস্থাপক অতিপ্রাকৃত নেতৃত্ব আয়ত্ব করার অনুশীলন করছেন তখন তার মাথায় খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে “কি ভাবে আমি এ নেতৃত্ব কার্যকর করবো? অথবা কোন সুনির্দিষ্ট কাজটি আমাকে সফলতা এনে দেবে?” প্রশ্ন দুটি ততোটা গভীর নয়। “কিভাবে অসাধারণ নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যায়?” এই প্রশ্নটিও আসল প্রশ্ন নয়। আসল প্রশ্ন হচ্ছে “কিভাবে অসাধারণ নেতা হওয়া যায়?” নেতৃত্বের চারিত্রিক বৈশিষ্ট বা গুণাবলী একজন নেতার ভেতরের অতিপ্রাকৃতিক গুণাবলী। তাঁরা ব্যক্তিস্বত্তাকে বেশি সম্পৃক্ত করেন। কর্মকান্ড বা আচরণ তাদের কাছে ততোটা গুরত্বপূর্ণ নয়। আপনার যদি নিজস্ব সত্তার উপর কাজ করা থাকে তবে আচরণ বা ঘটনাবলী বা কার্যকলাপ আপনা আপনি সৃষ্টি হবে। এর উল্টাটা সত্যি নয়।
আত্মাশক্তি ব্যবস্থাপনার জন্য এক সেট অসাধারণ দক্ষতা অপরিহার্য্য। আমাদের ব্যবসা সংক্রান্ত বিদ্যালয়গুলোতে অত্যন্ত ভাসা ভাসা ভাবে এ পাঠগুলো শেখানো হয়ে থাকেঃ
১. উদ্দীপ্ত দর্শন
২. চিন্তা-চেতনার স্বচ্ছতা
৩. দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি এবং সংকল্প
৪. কম অহংবোধ
৫. অবিচ্ছিন্নতা
৬. বিশ্বাসবোধ ও খোলামেলা মনোভাব
৭. মানুষ্য প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি
৮. জনসংগঠন নির্মাণের দক্ষতা
৯. চারিত্রিক শুদ্ধতা ও সততা
১০. ব্যক্তিগত প্রবৃদ্ধি ও পূর্ণতা
১. উদ্দীপ্ত দর্শন
নেতৃত্বের খুব গভীরে একটা দর্শন থাকা প্রয়োজন, যা মূলতঃ আধ্যাত্মিক, বিষ্ময়কর । দর্শন (Vision) অসীম, তবে এর একটা ভিন্ন মূল্যবোধ বজায় থাকে। প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সংশক্তি এবং সাংগঠনিক শক্তি থাকা প্রয়োজন। যে প্রতিষ্ঠানে সংশক্তি অনুপস্থিত সেখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে উদ্দীপ্ত দর্শনভিত্তিক নেতৃত্ব সাধারণ দর্শনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে সংশক্তি সৃষ্টি করে। সংশক্তি যতটুকু যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমৃদ্ধ তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি আত্মশক্তিতে বলীয়ান। সংশক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর হৃদয় ও মননের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল যা সকলকে একত্রে সংঘবদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। একটা সাধারণ দর্শনের প্রতি সকলেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে এবং একযোগে কাজ করবে। সঠিক অর্থে এটাই নেতৃত্ব। নেতৃত্ব একটা দর্শন সৃষ্টি করে যা কর্মীদের অগ্রগামী করে। একটা সাধারণ বাস্তব ফলাফল পেতে সাহায্য করে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দর্শন একটা সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে শক্তি যোগায় যা সম্মিলিত প্রচেষ্টার রূপ নেয়, যা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
মানব প্রকৃতির একটা গভীর বোধশক্তি থাকা প্রয়োজন যার দ্বারা দর্শনের গভীর অর্থ এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব উপলব্ধি করা যায়। যদি প্রতিষ্ঠানের কর্মীবৃন্দ শুধুমাত্র যান্ত্রিক হয় তবে দর্শন কখনই কাজ করবে না। একজন ব্যক্তির অন্তরনিহিত নিগুড়শক্তি ও এর ব্যাপ্তির যথাযথ উপলবিদ্ধ ও স্বীকৃতি প্রদান করা প্রয়োজন। আমাদের সকলের মধ্যেই মহত্বের ক্ষমতা বিদ্যমান। আমাদের প্রত্যেকেই ভালোবাসতে চায়, ভালোবাসা পেতে চায়। আমাদের সকলের মধ্যেই আধ্যাত্মিক চেতনাবোধ আছে যাকে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ শক্তি ও ক্ষমতার সাথে যোগাযোগ বলে অভিহীত করা যায়। অন্যকে সমর্থন এবং সেবা প্রদানের জন্য আমাদের প্রত্যেকের গন্ডি পেরোবার ক্ষমতা আছে।
অতিপ্রাকৃত নেতৃত্ব মানুষের সর্বোচ্চ শক্তির আধারে আঘাত করেন। কাজটা বিশাল। এর ফলেই মানুষ তার গন্ডি পার হয়ে আসে, বিশাল হয়ে উঠে, আমাদের সকলের জীবনের চেয়ে মহামূল্যবান কিছু অর্জন করে। মহৎ নেতাদের এই সেই শক্তি যা আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। ‘আমরা’ অনুভূতি তাদের বার্তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তির আধারে (সর্বোচ্চ স্তরে) আঘাত করতে সক্ষম, মার্টিন লুথার কিং এবং জন এফ কেনেডির ভাষণে এ গভীর শক্তির আবেদন ছিল। এ নেতৃত্ব মূলতঃ কর্মীর সর্বোচ্চ স্তরে আঘাত করে সক্রিয় করে তোলে এবং চমৎকার ফলাফল বের করে আনে। এ নেতৃত্ব একটা উদ্দীপ্ত দর্শন সৃষ্টি করে এবং স্বপ্ন দেখায়। উদ্দীপ্ত কথাটি এখানে খুবই গুরত্বপূর্ণ। যদি একজন প্রধান নির্বাহী বলেন, “আগামী বছর আমরা শতকরা ১৫ ভাগ মুনাফা বৃদ্ধি করতে চাই” এটা একটা দর্শন। ঠিক আছে, তবে উদ্দীপ্ত দর্শন নয়। মানুষের মনে আমি যে সাড়া জাগানোর কথা বলছি তেমন কোন আকর্ষণ সৃষ্টি করতে এ দর্শনের সামর্থ্য নাই। উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হলে মানুষের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করতে হবে। অবশ্যই ব্যক্তির নিজস্ব মহত্ব, দৃঢ়তা এবং অনুভূতিতে আঘাত করতে হবে। যখন আমরা নিজেদের খুব কাছাকাছি যাই তখন শরীরের খুব গভীরে শক্তির অস্তিত্ব টের পাই। একটা উদ্দীপ্ত দর্শনের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যে দর্শনটি আমেরিকার নাগরিকদের হৃদয় ও মানসিক অবস্থানকে স্পর্শ করতে পেরেছিল। সেটা জন কেনেডি কর্তৃক প্রদত্ত দর্শন – “আমরা একজন মানুষকে ১০ বৎসরের মধ্যে চাঁদে পাঠাবো এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনবো।” কোন কোন সময় উদ্দীপ্ত দর্শন একদল মানুষ কর্তৃক সৃষ্টি হতে পারে। আবার কখনও একজন ব্যক্তিই সৃষ্টি করতে পারেন। দলীয়ভাবে দর্শন সৃষ্টি করা বেশ কঠিন কাজ। কারণ একটা দলের পুরোচেতন অবস্থা থেকে দর্শন বেরিয়ে আসে। দলে একজন ব্যক্তি যদি ঐ চেতন অবস্থায় পৌঁছাতে না পারে তবে গোটা দলকে টেনে নিচে নামিয়ে দেবে। দলে উদ্দীপ্ত দর্শন সৃষ্টি করা যেমন জটিল তেমনি মূল্যবান এবং শক্তিশালী অনুশীলনও বটে। একটা প্রতিষ্ঠানের জন্য একজন ব্যক্তির চেয়ে একটা দল যদি দর্শন তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকে তবে প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশি মঙ্গলজনক। যখন একটা দল দর্শন তৈরি করে তখন দর্শন প্রচারের কাজ আংশিকভাবে সুসম্পন্ন হয়ে যায়। আপনার প্রতিষ্ঠানের জন্য একটা উদ্দীপ্ত দর্শন নির্মাণ সম্পন্ন হলেই কাজ শেষ, এমন নয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখনও বাকি, তা হলো দর্শনের সঠিক প্রচার। দর্শনবার্তার প্রকৃত সঞ্চালনের জন্য আপনাকে পুনরায় আপনার সেই অত্মশক্তিকে জাগ্রত করতে হবে যেখান থেকে দর্শনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ঘটেছে। আপনি কি বলছেন সেটা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি কোন আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে কথাগুলো বলছেন, সে শক্তির গুণগতমান কেমন। তাই বলে আপনি দর্শনের মূল বিষয়গুলো থেকে বিচ্যুত হবেন এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। কৃতিত্বপূর্ণ এবং শিল্পমান সমৃদ্ধ সঙ্গীত, অভিনয়, ক্রীড়ানৈপূণ্য ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করলে আপনি প্রেরণা এবং শক্তি সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন। যখন আপনি দর্শন প্রচারে নিয়োজিত তখন আপনি এ ধরনের একজন শিল্পী। সব নেতা হয়তোবা এ ভূমিকা পালন করতে পারবেন না। কারণ এ দক্ষতা অর্জন করতে হয়। আবার কমবেশি সকল নির্বাহীদের মধ্যে যে দক্ষতা দেখা যায় আমি সে ধরনের উপস্থাপনের কথাও বলছি না। অসংখ্য মানুষের সামনে আপনি আবেগে আচ্ছন্ন থেকেও প্রকৃত ও যুক্তিসঙ্গত কথা বলে যাবেন এ ধরনের কৃতিত্বের কথা বলছি।
২. চিন্তা-চেতনার স্বচ্ছতা
উদ্দীপ্ত দর্শনের ঘনিষ্ট সঙ্গী হচ্ছে স্বচ্ছ চিন্তা-চেতনা। আমরা যারা ব্যবস্থাপক এবং নির্বাহীর কাজ করি আমাদের সকলের একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের অভিজ্ঞতা আছে, যখন কাজ সম্পাদন করার পরিস্কার দর্শন এবং অনুভূতি মনের মুকুরে স্পষ্টতা লাভ করে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা প্রবাহ এ দর্শনকে অনেক সময় অস্পষ্ট করে ফেলে। এতদসত্তে¡ও আমাদের কর্ম দিবসগুলোর জন্য প্রয়োজন বিশেষ ধরনের দক্ষতা এবং নিয়মানুবর্তীতা যা সব ধরনের সন্দেহ ও সাময়িক উত্তেজনাকে কাটিয়ে স্বচ্ছ চিন্তা-চেতনাকে বলবৎ রাখতে সক্ষম।
চিন্তা-চেতনার স্বচ্ছতা সৃষ্টির জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে সৃজনশীলতা পর্যবেক্ষণ করা। যখন কোন সৃজনশীল মানুষ চিন্তা-চেতনার স্বচ্ছতার কথা খুব সচেতনভাবে বর্ণনা করেন তখন বারংবার বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথাই উচ্চারিত হয়, যা আধ্যাত্মিকতারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়। তারা বলেন, সম্ভবত সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। তাদের ব্যক্তি সচেতনতা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং সংগত কারণে তাদের অহংবোধের মাত্রা অনেক কম। তাদের একটা ভদ্রতা জ্ঞান আছে। তাঁরা স্বচ্ছ চিন্তা-চেতনা সমৃদ্ধ মানবিক গুণাবলীর অধিকারী। সৃজনশীল মতামত কেবল নির্গত হচ্ছে এবং কর্ম চঞ্চলতা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে আমাদের অভ্যন্তরীণ শান্ত এবং স্বচ্ছ স্পর্শকাতর জায়গায় মৃদু আঘাত করতে সক্ষম হতে হবে। এটা সেই স্বচ্ছতা যা উদ্দীপ্ত দর্শনকে অনুমোদন করে, এটা সেই স্বচ্ছতা যা দর্শনকে ধারন ও টেকসই করার জন্য উৎসাহিত করে।
এমতাবস্থায় কোন কোন পাঠক ভাবতে পারেনঃ
ক. এ ধরনের মনোজাগতিক অবস্থা কি মধ্যম মানের বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন?
খ. ধরুন এ অবস্থা সৃষ্টি করলাম, নেতৃত্বের সাথে এর সম্পর্ক কি?
আমি এভাবে উত্তর দিতে চাইঃ
ক. চিন্তা-চেতনার স্বচ্ছতা একজন মধ্যম মানের বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ আয়ত্ত¡ করতে সক্ষম।
খ. চিন্তা-চেতনার স্বচ্ছতা নেতৃত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অপেক্ষাকৃত বড় অংশ। এটা বিশাল নেতৃত্বের ভিত যা বাইরে থেকে দেখা যায় না। যার উপর দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব গতিশীল হয়, কার্য সম্পাদন করে এবং বিকশিত হয়। এ স্বচ্ছতাকে সমুদ্রে ভাসমান বরফের পানির নিচের বৃহত্তর অংশের সাথে তুলনা করা হয়।
যে নেতৃত্ব রূপান্তর বা পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম তার পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্বিকারত্ব এবং স্বচ্ছতা। যে সমস্ত নেতৃত্বের চিন্তা-চেতনার স্বচ্ছতা থাকে, সে নেতৃত্ব জীবনের উত্থান-পতন তথা পরিবর্তনের মধ্যে একটা ভারসাম্য সমুন্নত রাখতে সক্ষম। সুফি কবি রুমি তার কবিতায় এভাবে বলেছেনঃ
এক মুহূর্তের জন্য আমার
আশাভঙ্গ অথবা আমি আশ্বস্ত
তখন আমি বিধ্বস্ত অথবা সুস্থ;
যখন আমি শান্ত এবং খেলার মাঠের মতো বলিষ্ঠ
তখন আমি কথা বলি
জ্যোতির্ময় কথা বলি মানুষের জন্য।
প্রথম তিনটি লাইনে জীবনের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়েছে। বিষয়টি এ রকম “তোমরা প্রত্যাশিত ফলাফলের জন্য কঠোর পরিশ্রম কর। কিন্তু অকৃতকার্য হলে হতাশাগ্রস্থ হয়ে সময় নষ্ট করোনা।” শেষের তিনটি লাইন নেতৃত্বের মৌলিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। যারা বলিষ্ঠ এবং নির্ভেজাল চরিত্রের অধিকারী, যাদের চিন্তা-চেতনায় স্বচ্ছতা আছে তাদের ঘাড়ে নেতৃত্বের গুরু দায়িত্ব চলে আসে। (চলবে)