অনলাইন ডেস্ক : রূপকথার রাজা, রাজকুমার রাজকন্যার গল্প শুনে শুনে কেটে গেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্র। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দীর্ঘ ৭০ বছরের রাজত্বের অবসানের পর আজ শনিবার যুক্তরাজ্যের নতুন রাজমুকুট পরতে যাচ্ছেন রাজা তৃতীয় চার্লস। লন্ডনে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে ব্রিটেনের ৪০তম রাজা হিসেবে তাঁর আনুষ্ঠানিক অভিষেক হবে। এ জন্য রাজকীয় আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েছে বাকিংহাম প্রাসাদ। ইতিহাসের সাক্ষী হতে প্রাসাদের সামনে ভিড় করছে রাজপরিবারের ভক্তরা। সাজানো হয়েছে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা।
চার্লসের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে ঐতিহাসিক প্যারেডে অংশ নেবে নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। কমনওয়েলথভুক্ত নিউজিল্যান্ড, ব্রুনেই, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকেও এসেছে সেনারা। অভিষেক উপলক্ষে সোমবার অতিরিক্ত ব্যাংক হলিডে ঘোষণা করেছে সরকার। কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে ও অলিগলিতে হবে স্ট্রিট পার্টি। উইন্ডসর ক্যাসলে হবে করোনেশন কনসার্ট। ৭০০ বছর আগে তৈরি করা ঐতিহাসিক সেন্ট এডওয়ার্ড চেয়ার থাকছে। ১৩০৮ সালে রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের অভিষেকে ব্যবহূত হয়েছিল এটি। এবার তৃতীয় চার্লসের মুকুট পরার মুহূর্তের সাক্ষী হতে যাচ্ছে আসনটি। এ ছাড়া আয়োজনের নানা পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে কুইন কনসর্ট ক্যামিলা ও কিং চার্লসের বসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে চেয়ারস অব স্টেট, থ্রোন চেয়ারস।
রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায় মুকুটটি পরিয়ে দেবেন আর্চবিশপ। স্বর্ণের এই মুকুট তৈরি করা হয় ১৬৬১ সালে। ১৬৯০ সালের দিকে তৈরি বিশেষ সোনালি বাহন শেষ ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৮১ সালে প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার বিয়ের সময়। এবার তা প্রদর্শন করা হচ্ছে।
ইতিহাসের সাক্ষী হতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ভক্তরা। তাঁবু, ফোল্ডেবল বেড, ব্যাগ, খাবারদাবার নিয়ে তারা বসে পড়েছে প্রাসাদের কাছাকাছি। ভক্তরা বলছে, ‘অভিষেক অনুষ্ঠান পর্যন্ত ধৈর্য রাখতে পারছি না।’
গত বছর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং নতুন রাজা চার্লসের অভিষেক নিয়ে আগ্রহের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের আকর্ষণ করার ক্ষমতাটি স্পষ্ট দেখা গেছে। রানিকে বিদায় জানাতে আসা জনতার দীর্ঘ লাইন ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও রাজতন্ত্রের প্রবল জনপ্রিয়তার সাক্ষী হয়ে রয়েছে। যেমন—গত মার্চের মাঝামাঝিতে ব্রিটেনে ‘ইউগভ’ নামের জরিপ সংস্থার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের মধ্যে ৮১ শতাংশের কাছে রাজতন্ত্র ইতিবাচক।
অভিষেক অনুষ্ঠানে যা যা হবে : ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজা ও কুইন কনসর্টকে মুকুট পরানো হবে। আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবরি ওই অভিষেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজার মাথায় ও হাতে ‘পবিত্র তেল’ লেপন করা হবে এবং রাজকীয় প্রতীক হিসেবে তিনি রাজদণ্ড ও রাজগোলক গ্রহণ করবেন। অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত পর্বে রাজার মাথায় মুকুট পরিয়ে দেবেন আর্চবিশপ। স্বর্ণের এই মুকুট ১৬৬১ সালে তৈরি করা। টাওয়ার অব লন্ডনে যেসব সামগ্রী বা ক্রাউন জুয়েলস সংরক্ষিত আছে তার মধ্যে অন্যতম এই মুকুট। শুধু অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজা বা রানি এই মুকুট পরে থাকেন।
আসবেন না আমেরিকার প্রেসিডেন্ট : ইতিহাসবিদরা বলছেন, চার্লসের রাজ্যাভিষেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের যোগ না দেওয়াটা যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি ঐতিহাসিক। কেননা ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো ব্রিটিশ রাজ্যাভিষেকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অংশ নেওয়ার নজির নেই।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ও আধুনিক ব্রিটেনবিষয়ক বিশ্লেষক লরা বিয়ার্স বলেন, ‘চার্লসের রাজ্যাভিষেকে তিনি (বাইডেন) যাচ্ছেন না। কারণ এর আগে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট যাননি।’
রানি ভিক্টোরিয়ার রাজত্ব শুরুর আগে ১৮১২ সালে ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের উত্তেজনাও ছিল। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। ১৮৩৭ সালে ভিক্টোরিয়া যখন সিংহাসনে বসেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভ্যান বুরেন ভিক্টোরিয়ার অভিষেক অনুষ্ঠানে যাননি।
এ বিষয়ে লরা বিয়ার্স বলেন, ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্রিটিশ রানির অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন, সেটা বাস্তবসম্মত ছিল না। পরে সেটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
রাজতন্ত্রের উত্থান পতন : ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ও বহু উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। ৪১০ সালের দিকে ইংল্যান্ডে রোমান সাম্রাজ্যের অবসান হয়ে নতুন এই রাজতন্ত্র শুরু হয়। পার্লামেন্ট ছিল ইংরেজ রাজা এবং তার সরকারের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করত।
১৬৪২ সালে, রাজা এবং ইংরেজ পার্লামেন্টের মধ্যে দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে এবং ইংরেজ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৬৪৯ সালে রাজার মৃত্যুদণ্ড, ইংরেজ রাজতন্ত্রের উৎখাত এবং ইংল্যান্ডের কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠায় গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। সতের শ শতকে এমনও এক সময় ছিল যখন ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। সেটি ছিল রাজা প্রথম ও দ্বিতীয় চার্লসের শাসনের মাঝখানের এক দশক এবং ১৬৪৯ থেকে ১৬৬০ সালের মধ্যে এমন কোনো সরকার ক্ষমতায় ছিল না যার পক্ষে ব্যাপকভিত্তিক জনসমর্থন ছিল। তখন প্রথম চার্লসকে রাষ্ট্রদোহীতার অভিযোগে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
কাকতালীয়ভাবে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস এখন রাজা হয়ে তৃতীয় চার্লস নাম গ্রহণ করেছেন।
মূলত, ১২১৫ সালে ম্যাগনা কার্টা চুক্তির মাধ্যমে প্রাচীন রাজতন্ত্রের বিলুপ্ত ঘটার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাজতন্ত্রের সূচনা হয় এবং এটিই ইতিহাসের প্রথম দলিল যা এই নীতিটি লিখিত করেছিল যে রাজা এবং তার সরকার আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যার রাজকীয় কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা স্থাপন হয়েছিল। ঐতিহ্যের ধারক ইংরেজ জাতি তাঁদের ঐতিহ্য হিসাবে রাজতন্ত্রকে ভালোবেসে এখনো টিকিয়ে রেখেছে।