ভজন সরকার : ধর্মীয় উৎসবের দুটো অংশ আছে এক ধর্ম, আরেক উৎসব। ধর্মীয় অংশে সবার অংশ গ্রহণের সুযোগ ও অধিকার নেই। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনোই কোনো ‘ধর্মীয় উৎসব’-কে সর্বজনীন বলি না। শুধু উৎসব অংশটুকুই সর্বজনীন। এখানেই বর্ণ বা স¤প্রদায় নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহন থাকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ধর্মীয় উৎসবের কল্যাণকর অংশটুকু এখানেই।
শারদীয় দুর্গাপূজার এই উৎসবটির সাথে ছোটবেলার এক যোগসূত্র আছে, যা আমাকে আজো স্মৃতিকাতর করে দেয়। ধর্মীয় প্রভাবযুক্ত এক সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেই আমাদের প্রায় সকলেরই বেড়ে ওঠা। কিন্তু সে সব ধর্মীয় বিভেদ পেছনে ফেলেও নির্মল এবং ভেদাভেদহীন এক ছোট্ট ‘আমাকে’ ফিরে পাই আমি এ শারদীয় উৎসবের দিনগুলোতে।
প্রচন্ড বর্ষার শেষে ভাদ্র মাসের তালপাকা গরম। গত শতাব্দীর ৭০-৮০ দশকে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনপদই ছিল বিদ্যুৎহীন। তাই ভাদ্রের গরমে জীবন যখন ত্রাহি ত্রাহি, ঠিক সে সময়েই আকাশে মেঘের ভেলা ভাসিয়া আসতো শরৎকাল। আস্তে আস্তে প্রকৃতি সেজে উঠতো কাশফুলে। নদীর পার ভরে যেতে সবুজে আর সাদায়। হিন্দুপাড়ায় সাজ সাজ রব পড়ে যেতো শারদীয়া উৎসবের প্রস্ততিতে। কারিগর খড়ের নাড়া পরাতেন দুর্গাপূজার মূর্তিতে। রোজ স্কুল থেকে ফিরে সবাই উন্মুখ হয়ে দেখতাম আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে শারদীয়া উৎসবের প্রতিমা।
সারা বছরের অন্তহীন প্রতীক্ষা থাকতো এই শারদীয়া উৎসবের সময়ে। এক মাস আগে থেকেই জামা-প্যান্ট বানানোর চলতো জোর প্রস্তুতি। তখন তো আর গার্মেন্টস শিল্পের এমন জমজমাট অবস্থা ছিল না বাংলাদেশে। রেডি মেইড জামাপ্যান্ট ছিল না বললেই চলে। তাই গজ মেপে কাপড় কিনে দর্জি দিয়ে বানানো হতো জামা-প্যান্ট। বাজারের ভালো দর্জির ব্যস্ততা আকাশচুম্বী। তাই ঠিক সময়ে কাপড় কিনে না দিলে পূজার শুরুতে নতুন জামাকাপড় পাওয়া যেতো না। তবুও দেখেছি হয়ত সপ্তমী কিংবা অষ্টমীর আগের দিন ডেলিভারি পাওয়া যেতো। ট্রায়াল দেওয়ার আর সুযোগ নেই। মাঝে মাঝে মনখারাপ হতো কলারের বকরম হাল-ফ্যাশানের হয়নি কিংবা প্যান্টের নিচের অংশ নায়ক ফারুক বা রাজ্জাকের মতো হয়নি। সেই নিয়ে কতো মনখারাপ।
তারপর একটু একটু করে বেড়ে উঠলাম। উৎসবের আনন্দ দূরে যেতে লাগলো। স্কুল ছেড়ে কলেজে উঠলাম। বাড়ি থেকে দূরে ঢাকা শহরের কলেজ হোস্টেলে। তখন শারদীয় উৎসব মানেই বাড়ি ফেরা। সাথে শারদীয় সংখ্যার ‘দেশ’ পত্রিকা। অন্তহীন বই পড়া; সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যা গড়িয়ে মধ্যরাত। বাড়ির খাবার। আহা, পূজার এ সময়টা এখনও সেই স্মৃতির গলি পথে হাঁটা। কখনও কখনও মনখারাপও।
জানি, মা অজান্তেই এখনো অপেক্ষা করে থাকেন, হয়ত হঠাৎ গিয়ে মাকে চমকে দেবো। কিন্তু ফেরার তেমন আর সুযোগ নেই। দূরত্ব, সময় এবং কর্মব্যস্ততা আমাদের সব কিছু থেকেই আলাদা করে দিয়েছে। আর সবার মতো আমিও তাই দূর থেকে স্মৃতি রোমন্থনই করি। এখন যেনো স্মৃতি রোমন্থনেই আনন্দ।
দুর্গাপূজার ক’দিন পরেই আরেকটি পূজা। ঘরে ঘরে হিন্দু বাড়িতে হবেই এই পূজা। নাম লক্ষ্ণীপূজা। দুর্গাপূজা নয় বরং কোজাগরী পূর্ণিমা রাতের যে লক্ষ্ণীপূজা সেটাই সাধারণ বাঙালি হিন্দুর সর্বজনীন পূজা।
বিজয়া দশমীর ক’দিন পরেই বাঙালি হিন্দু বাড়িতে শুরু হয় লক্ষ্ণীপূজার আয়োজন। লক্ষ্ণীর আবাহনের প্রস্তুতিতে শুরু হয় সারা বাড়িতে আলপনা আঁকা। নানান রঙের লক্ষ্ণীর পট, মাটির তৈরী কারুকাজ শোভিত পটকে বলা হয় ‘লক্ষ্ণী সরা’। সেই সাথে উপাদেয় সব খাবার, বিশেষকরে অসংখ্য রকমের নাড়ু নারকেলের, তিলের, চিড়ের; আরো আছে মোয়া,খই, পায়েস, লুচি, লাবড়া আরো কতো কিছু!
কোজাগরী এ সংস্কৃত শব্দটির বাংলা অর্থ ‘কে জেগে আছে’। কথিত আছে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্ণী এ কোজাগরী পূর্ণিমাতে খোঁজ নেয়, কে জেগে আছে। কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে যে জেগে থাকে লক্ষ্ণী তাকেই ধন-সম্পদ দান করে। আর লক্ষ্ণী যেহেতু রাতে বিচরণ করে, তাই তার বাহন পেঁচা। লক্ষ্ণীর সরায় তাই অনেক জায়গায় লক্ষ্ণীর সাথে পেঁচার ছবিও থাকে।
তবে যে জিনিসটা আমাকে আকর্ষণ করে সেটা হলো, লক্ষ্ণী পূজায় অনেকেই পূজার জন্য ব্রাহ্মণ ডাকে না। বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধে এ উত্তরণ কবে এবং কিভাবে ঘটেছে সে ইতিহাস জানি না। কিন্তু মনে হয় অন্যের দ্বারা ধন-সম্পদের আরাধনায় সাধারণ বাঙালি -মানসে কোথায় যেন আঘাত লাগে। হোতে পারে সম্পদের একক মালিকানার সংশয়ও একটা বিবেচ্য বিষয়। তা না-হলে, ব্রাহ্মণের এমন আধিপত্য খর্ব অকল্পনীয়ই বটে।
যা হোক, ছোটবেলার সেই কোজাগরী পূর্ণিমা রাতকে এখনও প্রচন্ড রকমে অনুভব করি। ছোটবেলার অনেকটা বছর কেটেছে প্রত্যন্ত বিল এলাকার গ্রামে। আষাঢ? থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত থইথই জল চারিদিকে। আর কোজাগরি পূর্ণিমার ধবধবে জ্যোৎস্নায় নৌকা ভাসিয়ে চাঁদের আলোতে গল্প করা ছিল আমাদের এক অনন্য আনন্দ। বাড়ির উঠোন থেকে প্রতিটি ঘরে লক্ষ্ণীর আলপনা। কতো রকমের যে আলপনা আঁকা। সারা রাত মানুষের আনাগোনা। হরেক রকমের উপাদেয় খাবার।
এরকম অসংখ্য স্মৃতি থেকেই লেখা আমার একটি কবিতা। কবিতাটার সাথে যেনো মিশে আছে পেছনে ফেলে আসা উৎসবের আনন্দ আর বিষাদ।
“ভিটেয় জমানো থাকা মাটি ঘাস জানালার ফ্রেম
উঁইপোকা ঢিবি আর নোনাধরা গনেশের পট
ঘরের পেছনে পরা রংচটা লক্ষ্ণীর ঘট।
কতোটা পেছনে গেলে দেখা যাবে তোমাকে আবার
অঝর বৃষ্টির রাতে অবিরাম উঁকি মারা চোখ
বাতাসেতে ফিরে আসে উড়ে যাওয়া পাখির পালক”।
জানি, কিছুই ফিরে আসবে না। আসেও না কখনো। তবুও কল্পনার জোয়ার স্রোতে ভেসে বেড়াতে বাধা কোথায়? বাধা কোথায় উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতে। আনন্দহীন মানুষের বেঁচে থাকা বড় দুর্বিসহ। তাই চাই বিশ্বের সকল মানুষ ভেদাভেদহীন এক সর্বজনীন উৎসবের আনন্দে বেঁচে থাকুক।
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)