মণিজিঞ্জির সান্যাল : একটি বইয়ের এমনই প্রভাব যে, একটি ভাল বই একজন মূর্খ অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্বরকেও মানবিক গুণসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষে রূপান্তরিত করতে পারে। কিন্তু আজকাল মানুষ আর বই পড়ছে না। অথচ চারপাশে এখন লেখক -কবির সংখ্যা আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে। লেখকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানে তো সাহিত্যের সম্ভার আরো বৃদ্ধি পাওয়া। সেদিক দিয়ে ভাবলে তো আমাদের আনন্দ পাওয়া উচিত, গর্ব হওয়া উচিত। যার লেখা ভাল লাগবে পাঠক নিজেই খুঁজে বের করে তার লেখা পড়বেই পড়বে।আর যা ভাল লাগবে না, সে এমনিতেই তাকে সরিয়ে রাখবে। এটাই তো নিয়ম, অথচ দিনে দিনে পাঠক কমছে। এটা অস্বীকার করার তো কোনো উপায় নেই।
পাঠক কমছে কিন্তু লেখক বাড়ছে। আগে যারা পড়ত এখন তারা লিখছে। যতোটা সবাই লিখছে, ততোটা কিন্তু সে পড়ছে না। পড়ার দিকে আগ্রহ কমে যাচ্ছে একেবারেই।
সত্যি কী মানুষ বই পড়ছে না? পড়ছে নাই তো। আগের মতো বই উপহার দেওয়া, পরস্পরের বই আদান প্রদান করা, কোনো একটা বই পড়ে তাকে সেই বইটা পড়তে বলা কিম্বা ভাল লাগা কোনো বই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ বা যুক্তি তর্ক ইত্যাদি। এসব আর কোথায় এখন?
পেছন ফিরে তাকালে ভেসে আসে কতো স্মৃতি। কবে পরীক্ষা শেষ হবে, কারণ পরীক্ষা শেষের দিন থেকেই তো শুরু হতো বই পড়ার প্রস্তুতি। কিম্বা জ্বর হলে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বই পড়ার পালা। শীতের দুপুরে রোদে বসে কতো কি গল্পের বই। ছোটবেলার সেই টিনটিন, হাঁদা ভোঁদা অর্থাৎ আনন্দমেলা, শুকতারা নিয়ে টানাটানি। তারপর ডায়না, অরণ্যদব, নন্টে ফন্টে, চাঁদ মামা, ঠাকুমার ঝুলি, গোপাল ভাঁড় থেকে শুরু করে, আর একটু বড় হতেই শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ,সমরেশ, শীর্ষেন্দু, শঙ্কর আরো আরো বই যেন নেশার মতো টেনে নিয়ে যেত আমাদের। বই চুরি তো একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল। যে কোনো বই যেন ছিল নেশার মতো। কোনো বাছবিচার ছিল না। যে যা পেত গোগ্রাসে তাকে গিলত। রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুম, বালিশের তলায় বই নিয়ে জড়িয়ে ঘুমোত সবাই। স্কুলে ডেস্কের মধ্যে লুকিয়ে বই পড়ত সবাই। টিফিনের সবাই তাড়াতাড়ি টিফিন খেয়ে বইএর পাতায় মুখ। অনেক সময় পালটে পালটে বই কেনা হতো। যেমন, একজন একটা বই কিনলে, আর একজন অন্য আর একটা । তারপর পারস্পারিক সময় সূচি অর্থাৎ দু থেকে তিনদিনের মধ্যে এই বইটা শেষ করতেই হবে, তবেই পরের বইটা পাওয়া যাবে। কতো আনন্দ সেই বইকে ঘিরে। তাছাড়া নতুন বইএর গন্ধ! আহা ভাবা যায় না।
অনেক সময় বড়রা-ছোটরা পাশাপাশি বসে বই পড়ত, সে এক দারুণ মজার সব দিন।
কতো ম্যাগাজিন, পত্রিকা এখন আর চোখে পড়ে না। সব কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। পত্রিকার স্টলগুলোও আগের তুলনায় কি একটু ফাঁকা?
কেন এমন হল? কেন হারিয়ে গেল বই পড়ার সেই দৃশ্য? চারদিকে একই আলোচনা ‘এখন আর কেউ আগের মতো বই পড়ে না।’ বই পড়ার আগ্রহ কমছে প্রতিনিয়ত কিন্তু কেন? কেন হল এমন পরিবেশ? আর তখনই বা কেমন ছিল পরিবেশ?
আসলে এর মূল কারণ হলো বিনোদন।
তখন বিনোদনের ক্ষেত্র ছিল কম কিন্তু পারিবারিক বন্ধন ছিল ভীষণরকম আটোসাটো। পাশাপাশি বাড়িগুলোর মধ্যে ছিল পারিবারিক সম্পর্ক। একের আনন্দে আর একজন সামিল হতেন, বিপদে মানুষ পাশে এসে দাঁড়াতেন। আর এখন ছোট্ট বাচ্চার হাতেও স্মার্ট ফোন। এই বাচ্চারা বড় হয়ে বই পড়তে চাইবে কেন? হাতের মুঠোতেই তো সম্পূর্ণ পৃথিবী। চমকে যাবার, মুগ্ধ হবার নানা উপকরণ ছোট্ট একটা মোবাইল ফোনে।
এছাড়া বাচ্চাদের জীবন এখন পালটে গেছে । ফ্ল্যাট কেন্দ্রীক জীবন যাত্রায় বাচ্চাদের জীবন হয়ে পড়ছে সঙ্কীর্ণ। বাচ্চাদের জন্য উন্মুক্ত আকাশ নেই, খেলার মাঠ নেই। আর এখন দুধের বাচ্চার পিঠে ভারি স্কুল ব্যাগ। কত কত পড়া, সাজেশন, কোচিং, প্রতি সাবজেক্টে প্রাইভেট টিউটর। এখন তো বাচ্চারা খেলেও না, সময় পায় না। মা-বাবারাও বলেন ‘সময় কোথায়? কতো পড়া, পড়েই কুল পায় না তো আবার গল্পের বই? স্কুলের বই পড়েই সময় পায় না, অন্য বই পড়বে কখন?’
ঠিকই তো বলেন, অন্য বই পড়লে রেজাল্ট ভালো হবে না, ভালো কলেজে চান্স পাবে না, ভালো চাকরি হবে না। প্রচুর টাকা হবে না। দোষটা ঠিক কাদের?
(১) অভিভাবকদের?
(২) সন্তানদের?
(৩) রাষ্টের?
(৪) শিক্ষা ব্যবস্থার?
(৫) নাকি সিস্টেমের?
তাহলে বইপড়া নিয়ে মনের মধ্যে কি কি প্রশ্ন উঠতে পারে?
এক- বই পড়া জরুরি কিনা?
দুই- সবাই বই কেন পড়বে?
কিছু মানুষ তো বই কিনছে, পড়ছেও। আর কী? তাহলে আরো কিছু প্রশ্ন এসেই যায়।
এক—- কতো শতাংশ মানুষ বই পড়ছে?
দুই—- সিলেবাসের বাইরে ছাত্র ছাত্রীরা বই পড়ছে কি? যদি তা ‘না’ হয়, তাহলে কারা বই কেনে? কারা বই পড়ে?
এক্ষেত্রে তাহলে কি করা উচিত?
এক– বাবা-মাকেই প্রধান ভূমিকা রাখতে হবে বই পড়ার ব্যাপারে।
দুই– স্কুলের এ ব্যাপারে কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। সিলেবাসের বাইরে গিয়েও বই পড়ার পরিবেশ রাখতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বইপড়ার আগ্রহ জাগিয়ে দিতে হবে। স্কুলে বইপড়া অভ্যাস জোরদার করতে হবে।
শুরু থেকে অভ্যাস করলে ১০০ জনের মধ্যে ৫০জনেরও বইপড়ার অভ্যাসটা নিয়মিত হতে পারে। কারণ সবার বই পড়ার আগ্রহ নাও থাকতে পারে।
তিন– লাইব্রেরির সংখ্যা বাড়াতে হবে । যে কোনো বাজারে বিভিন্ন দোকানের পাশাপাশি একটি করে হলেও বইয়ের দোকান থাকার ব্যাপারে সবার সহযোগিতা থাকতে হবে।
চার– বইয়ের দাম কমাতে হবে।
পাঁচ– বিভিন্ন উৎসবে, অনুষ্ঠানে বই উপহার দেবার রীতিটা আবার শুরু করতে হবে।
ছয়– বইপড়ার প্রতি গুরুত্ব ও মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
সাত— বইপড়াকে সম্মান ও একটা যোগ্যতা হিসেবে দেখতে হবে।
ব্যায়াম যেমন শরীর ভালো রাখার জন্য দরকার, তেমনি বই পড়াটা হলো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অতি দরকারি। বই পড়ার অনেক অনেক সুফল দিক আছে। এর মধ্যে কয়েকটা তো খুবই দরকারি। যেমন-
(১) বই পড়ার সময় আমাদের চোখ আর মন যে কেবল কাজ করে, তা নয়; বরং কল্পনাশক্তিরও একটি চর্চা হয়। মস্তিষ্ক থাকে সচল। ফলে বই পড়া মানসিক উদ্দীপনার একটি নিয়ামক।
(২) মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা বড় উপায় হচ্ছে বইয়ের মধ্যে ডুবে যাওয়া।
ঔপন্যাসিক আদ্রে জিদ যেমন বলতেন, বই দিয়ে নিজের একটা জগৎ গড়ে তুললে দরকার মতো সেখানে ডুব দেওয়া যায়। জ্ঞান কিংবা শব্দভান্ডারের বৃদ্ধি, নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে জানা, এসব সুফলের কথা তো আমরা সবাই জানি। তবে বই পড়লে সবচেয়ে বেশি বাড়ে বিশ্লেষণী শক্তি। বেড়ে যায় সমস্যা সমাধানের দক্ষতা। বেড়ে যায় স্বপ্ন দেখার শক্তিও।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে অন্যতম আলোচিত উদ্যোক্তা টেসলা ও স্পেসএক্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এলন মাস্কের কথাই ধরা যাক। এলনের বয়স যখন নয়, তখন তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা (বিশ্বকোষ) সম্পূর্ণ পড়ে ফেলেছিলেন। সে সময় তিনি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি পড়তেন দিনে গড়ে ১০ ঘণ্টা!!! কাজে যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো এত্ত এত্ত স্বপ্ন আর সেটি পূরণের শক্তি কোথা থেকে আসে? তিনি নিজে বলেন, আমি পড়ি। যখনই সুযোগ পায় তখনই পড়ি।
যত পড়া হয় তত লেখার দক্ষতা বাড়ে, নিজেকে মেলে ধরার ক্ষমতা বিকশিত হয়। বই পড়তে হয় মনোযোগ দিয়ে, কখনো কখনো কল্পনাকে ছেড়ে দিলে ফোকাস হওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা তৈরি হয় নিজের মধ্যে।
এই যে পড়ার এক জাদুকরি সুফল, সেটি কেমন করে পাওয়া যাবে?
সহজ উত্তর: পড়ো, পড়ো, পড়ো।
অনেকেই বলেন, পড়ার সময় পাই না। কাজের মধ্যে ডুবে থাকি, তাই পড়তে পারি না।
আসলে এটি একটি অজুহাত। ১৬-১৮ ঘণ্টা কাজের জগতে ডুবে থাকেন এমন মানুষেরা কিন্তু পড়তে থাকেন ফাঁক পেলে। কারণ পড়াটা হয়ে পড়েছে তাঁদের প্রাত্যহিকতার অংশ।
যদি জীবনকে একটি খেলা ভাবা যায়, সেই খেলার একেকটি লেভেল অতিক্রম করার জন্য একেকটি বই পড়া জরুরি। যে যত বই পড়বে সে তত লেভেল উপরে চলে যাবে।
জ্ঞানী হওয়াই বই পড়ার কিন্তু লক্ষ্য না, বই পড়ে তা ভেবে কাজ করাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ!
বই উপহার দেওয়াটাও একটা ভাল গুণ। আমাদের প্রত্যেকের যেমন খাবারের রুচি আলাদা, ঠিক তেমনই আমাদের বই পড়াও একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। কেউ ভালোবাসেন থ্রিলার পড়তে, কেউ পছন্দ করেন রোম্যান্টিক নভেল আবার কেউ কবিতার বই সংগ্রহ করেন। বই পড়ুন, বই উপহার দিন।
একটি বইয়ের প্রভাব এতই ব্যাপক যে, একটি ভাল বই একজন মূর্খ অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্বরকেও মানবিক গুণসম্পন্ন একজন আদর্শ মানুষে রূপান্তরিত করতে পারে।
বই পড়ার অসংখ্য ভালো দিক রয়েছে। মানুষ যখন কোন বই পড়ে তখন তার গল্প বা কাহিনীর প্রেক্ষাপটে এমনভাবে ঢুকে পরে যে, তার কাছে মনে হয় বইয়ে বলা ঘটনাগুলো যেন তার সামনেই ঘটছে। বই পড়তে পড়তে কাহিনীর প্রেক্ষিতে মানুষের মস্তিষ্ক উত্তেজিত ও শিথিল হয়। এভাবে মস্তিষ্ক চারপাশের প্রতিদিনের মানসিক চাপ থেকে অনেকটাই মুক্তি লাভ করে। বিজ্ঞানীরা হার্টবিট এবং মাসল টেনশনের মনিটরিং করে দেখেছেন, ছয় মিনিট বই পড়লে স্টেস লেভেল ৬৮ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস Dementia Ges Alzheimer’s নামক দুটি মানসিক রোগ প্রতিরোধে অনেকাংশেই সক্ষম।
পৃথিবীতে যত সফল ব্যক্তি রয়েছেন। আমরা যাদেরকে নিজেদের জীবনের আইডল মনে করি, তাদের সকলের মধ্যে একটি ব্যপার খুব কমন ছিল। সেটি হচ্ছে বই পড়া। শুনলে বা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয় যে, ওয়ারেন বাফেট তার পেশা জীবনের শুরুতে প্রতিদিন ৬০০-১০০০ পৃষ্ঠা বই পড়তেন। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেইটস প্রতিবছর ৫০টি বই শেষ করতেন। তারা সফল হওয়ার পরও তাদের এই বই পড়ার অভ্যাস অব্যাহত রেখেছেন।
পরিশেষে এই বলি বই আমাদের অসময়ের বন্ধু, আমাদের ভালোলাগা এবং আমাদের ভালোবাসার সাথী হোক সবসময়।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ