মণিজিঞ্জির সান্যাল : ছোটবেলায় আমরা প্রায়ই বলতাম ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ভাবলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। আজও কি আছে সেই বেস্ট ফ্রেন্ড যাকে অকপটে সব কথা বলা যায়? যার সাথে দেখা হলে অনায়াসেই বলা যায় খুব ক্ষিধে পেয়েছে রে। মন খারাপ হলে জড়িয়ে ধরে কাঁদা যায়। হাতে হাত রেখে অনেকটা পথ হাঁটা যায়। অসময়ে দুহাত তার হাতের মুঠোয় রাখা যায়। সবচেয়ে ভাল বন্ধু সেই যে আপনার সব কথা মন দিয়ে শুনবে। আপনার মনের কথাগুলো কোনো অবস্থাতেই অন্য একজনের কাছে তুলে ধরবে না।
সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি আপনাকে কখনোই জীবনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না। জীবনে হাতে-গোনা দু চারজন মানুষ পাবেন, যারা সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে আপনাকে বিচার করবে না। সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি হবে তাদের একজন। এমন বন্ধু যদি আপনার থাকে তাহলে আপনার চেয়ে সুখী এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তাকে আপনিও ভালোবেসে আগলে রাখুন, তাকে যত্নে রাখুন, আদরে রাখুন।
দুজন ভালো বন্ধু কখনোই একে অপরকে ভুলে যেতে পারে না, বরং আরো বেশি করে একে অপরকে মনে করবে এবং সময় পেলেই একে অপরের সঙ্গে দেখা করে খুঁনসুটি করবে, এমনই হতে হবে বন্ধুত্ব। রাগ অভিমান করে পরস্পরকে ভুলে গেলে সেটা কখনোই প্রকৃত বন্ধুত্ব নয়।
কাকে বলে এই বন্ধুত্ব বা friendship?
না না আজকে কোনো বন্ধু দিবস নয়, আলাদা করে কোনো দিবস পালন করার কোনও যুক্তি আমি খুঁজি পাইনি কখনও। প্রতিটি দিনই সে তার মতো করে সেজে ওঠে। প্রতিটি দিনই সে তার মতো করেই গুরুত্বপূর্ণ।
‘আলোতে একা হাঁটার চেয়ে অন্ধকারে বন্ধুর হাত ধরে হাঁটা শ্রেয়’ কথাটি বলেছিলেন হেলেন কেলার। সত্যিই বন্ধু ছাড়া আমাদের একটা মুহূর্তও কাটে না। জীবনের প্রয়োজনেই মানুষ বন্ধু খুঁজে নেয়। তবে একথাও ঠিক, সব বন্ধুর গুরুত্ব সমান হয় না। জীবনের নানা বাঁকে সবচেয়ে ভালো বন্ধুটির প্রভাবই প্রবলভাবে থাকে। কারো মনে প্রশ্ন আসতে পারে সবচেয়ে ভালো বন্ধুর বৈশিষ্ট্য কি?
কিন্তু ভেবে দেখুন তো, গুণ দেখে কি আর বন্ধুত্ব হয়? গুণের তালিকা করে কি বন্ধু খোঁজা যায়? না যায় না। তারপরও মানুষ মনে মনে আশা করে, সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি নির্দিষ্ট কিছু গুণের অধিকারী হবে।
যেমন, যে কোনো বিষয় নিয়ে আপনি তার ওপর রাগ ঝাড়তে পারেন, বকাবকি করতে পারেন। এতে সম্পর্কে চরম টানাপোড়েনও দেখা দিতে পারে। কিন্তু যখন বুঝবেন ভুলটা আসলে আপনারই, তখন? এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো বন্ধুটির কাছে আপনার একটাই প্রত্যাশা থাকতে পারে, তা হল আপনাকে ক্ষমা করে দেওয়ার ব্যাপরে সে দ্বিতীয়বার ভাববে না। আরো একটি বিষয়ে ভাবতে হবে, প্রত্যেকটি মানুষই কিন্তু আলাদা। সবচেয়ে ভালো বন্ধু বলেই সব বিষয়ে দুজনের পছন্দের মিল থাকবে- এমনটা নাও হতে পারে। তবে আপনি পছন্দ করেন এমন যেকোনো কাজে সে আপনার পাশে থাকবে; উত্সাহও জোগাবে। যদিও কাজটি হয়তো তার ভালো লাগে না।
সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি জীবনের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে সাহস ও সমর্থন দেবে। জীবনে চলার পথে আপনি লক্ষ্যচ্যুত হলে বা মনোযোগ হারিয়ে ফেললে, সে-ই আপনার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেবে। তারপরও যদি ব্যর্থ হন, সেটিকে গুরুত্ব না দিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরুর প্রেরণা জোগাবে।
আপনার যে কোনো সমস্যায় সাহায্যের প্রয়োজন হলে- নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি কখনোই ‘না’ বলবে না। দিন-রাতের যে কোনো সময়ে আপনার একটি মাত্র ডাকেই ছুটে আসবে।
অর্থকষ্টে পড়লে অনেক সময়ই নিজের পরিবারকেও জানানো সম্ভব হয় না। এসব ক্ষেত্রে বন্ধুটিই হবে আপনার সবচেয়ে বড় সহায়। যখনই টাকা-পয়সার ঝামলোয় পড়বেন, তার কাছে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারবেন আপনার সমস্যার কথা। সে আপনাকে কখনো ফিরিয়ে দেবে না। তার হাতে টাকা না থাকলেও সে ঠিক কোনো না কোনো একটা উপায় বের করে দেবে আপনাকে। বন্ধুরা হল হাতের আঙুলের মতো। আর সবচেয়ে ভাল বন্ধু হল আপনার হাতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত আঙুল। যার ওপর আপনি আস্থা রাখতে পারেন, নির্ভর করতে পারেন। বিনিময়ে বিভিন্ন কাজে আপনার মেধার সর্বোচ্চটুকু বের করে আনতে ভূমিকা রাখবে সে।
সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি আপনাকে কখনোই জীবনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে না। জীবনে হাতে-গোনা ৪-৫ জন মানুষ পাবেন, যারা সাফল্য-ব্যর্থতা দিয়ে আপনাকে বিচার করবে না। সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি হবে তাদেরই একজন।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ-গুরুত্বহীন, সার্থক-নিরর্থক যত ধরনের কথা আছে, তার পুরাটাই সবচেয়ে ভালো বন্ধুটি শুনবে। কখনো বিরক্তি প্রকাশ করবে না। আপনিও মন খুলে বলতে পারবেন আপনার সব কথা।
শর্তসাপেক্ষে যে বন্ধুত্ব হয় না, সদগুরুর বলা একটা ঘটনা মনে পড়ছে।
একজন “বিয়ার” প্রেমী ডাক্তার ছিলেন যার বয়স প্রায় সত্তর। সেই বিশাল মানুষটির বহু বছরের একজন বন্ধু ছিল, নিয়মিত যারা পরস্পর দেখা সাক্ষাত করতেন। কিছুদিন আগে পর্যন্ত তিনি তার এই বন্ধুর কাছে নিয়মিত যেতেন, দু’জনে একসঙ্গে “বিয়ার” পানে মজে থাকতেন। সময় পেলেই তারা একসঙ্গে “বিয়ার” নিয়ে আড্ডায় বসতেন। কখনও তিনি যেতেন, কখনও সেই বন্ধুটি আসত তার কাছে।
হঠাতই একদিন তার সেই বন্ধুটি কোনও একজন গুরুকে পেয়ে আধ্যাত্মিক সাধনা শুরু করেন এবং “বিয়ার”-এর নেশাও ত্যাগ করেন। সেই বন্ধুটি “বিয়ার”-এর নেশা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের দীর্ঘ বন্ধুত্বেরও চির বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বহু বন্ধুত্বই এভাবে টিঁকে থাকে যতক্ষণ তাদের মধ্যে বিশেষ কোনও একটা মাধ্যম কাজ করে। সেটা চলে গেলেই বন্ধুত্বও শেষ হয়ে যায়।
যাইহোক এই গল্পের মধ্যে দিয়ে দুজন মানুষের বন্ধুত্ব টিকে থাকার যে ঘটনাটা দেখলাম, তাতে বুঝতে অসুবিধে হলনা যে দুজন মানুষের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো একটা কিছু বহন করছিল। সেটা সরে যেতেই বন্ধুত্বের ফাঁটল ধরল। সত্যিই কি জীবনে একজন প্রকৃত বন্ধু পাওয়া যায়? যে পেয়েছে সে ভাগ্যবান। সবাই যে পায় তা কিন্তু নয়।
শেষ বিচারে, বন্ধু কে? যাকে আপনি বন্ধু বলে ভাবছেন, সেও তো আপনারই মতো গোলকধাঁধায় পড়ে থাকা এক মানুষ, বন্ধু মানেই তাকে নিখুঁত মানুষ হতে হবে, তা তো নয়। যখন দু’জন মানুষ একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে যায়, তখনই তারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে ওঠে। কোনও সন্দেহ নেই যে, আপনার বন্ধুটিও আপনারই মতো একজন এলোমেলো মানুষ। যখন দু’জন মানুষ একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত আবহ তৈরি করে, তখনই অপর জন আপনার বন্ধু হয়ে ওঠে। একজন কেন, আপনি নিশ্চয়ই অসংখ্য সত্যিকারের বন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। কিন্তু আপনার জীবনে একজনও এমন কেউ যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে আপনার উচিত এখনই নিজেকে নতুন ছাঁচে গড়ে তোলা।
মণিজিঞ্জির সান্যাল : কথাসাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ