অনলাইন ডেস্ক : কোনোভাবেই পদ্মা সেতুর কাজ ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। প্রকৃতি ও মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যায় দফায় দফায় পিছিয়ে যাচ্ছে নির্মাণকাজ। সর্বশেষ ধাক্কা দিল বৈশ্বিক মহামারী করোনা। এর জেরে সরকার নির্ধারিত সময়ে সেতুর কাজ শেষ করা যাবে না তা মোটামুটি নিশ্চিত। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী বছরের জুন মাসে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এ সময়ে কাজ তো হবেই না পরন্তু সামনে চলে আসছে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি।
কবে সেতু চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে এবং কত বাড়তি খরচ হবে, তা বলতে পারছেন না কেউ-ই। বলা হচ্ছে, করোনা দূর হলে বলা যাবে এই সেতুর কাজ শেষ করতে পারার খবর। কারণ প্রকল্পের চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সেতুর বড় বড় স্টিল অবকাঠামো চীন থেকে বানিয়ে এ দেশে নিয়ে আসে। অন্য মালামালও চীন থেকে আনা হয়। চীনে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ায় প্রায় দুই মাস কোনো মালপত্র আসেনি। এ নিয়ে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, করোনা শেষ হলে পুরো প্রকল্পটি পর্যালোচনা করা হবে।
জানুয়ারি মাসের শুরুতে চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। তখন থেকেই পদ্মা সেতুর কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তার সূত্রপাত। কারণ সেই সময় চীনা নববর্ষের ছুটিতে চলে যান পদ্মাসংশ্লিষ্ট প্রায় আড়াইশ চীনা নাগরিক। তারা সেখানেই আটকা পড়ে যান। ওই দেশে মহামারী কমতে শুরু করলে প্রায় দুই মাস পর দেশে ফিরেন। দেশে ফিরলেই কাজে যোগ দেওয়া যায় না। আছে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন। তাই ফেব্রুয়ারির শেষ ও মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে চীন থেকে আসা নাগরিকরা কাজে পুরোপুরি যোগ দিতে মার্চ মাস গড়িয়ে যায়। এ নিয়ে প্রথম দিকে সেতু বিভাগ মনে করেছে, তেমন সমস্যা নেই। পরে দেখা গেল, আমাদের দেশেও এই মহামারীর প্রাদুর্ভাব। স্বভাবতই দেশি শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এ নিয়ে প্রথম দিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন- আপাতত সমস্যা না হলেও অন্তত দুই মাস প্রাদুর্ভাব চলতে থাকলে পদ্মা সেতুর কাজে সমস্যা দেখা দিতে পারে। হলো-ও তাই। সমস্যা ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। তাই শতচেষ্টা করেও সেতুর নির্মাণকাজের গতি ধরে রাখা যায়নি। অবশ্য এটি ঠিক, করোনাকালে সরকারের অন্য প্রকল্পের কাজ শুরু থেকেই থেমে যায়। কেবল ব্যতিক্রম এ প্রকল্পের বেলায়; চলতে থাকে সেতুর কাজ। করোনার কারণে তিন মাসে দেড় শতাংশ অগ্রগতি এবং ৫০০ কোটি টাকার মতো খরচ করা সম্ভব হয়েছে। তবে মূল সেতুর কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। প্রতিবছর যত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়, এর পুরোটা কখনই খরচ করতে পারেনি পদ্মা কর্তৃপক্ষ। শেষ পর্যন্ত সংশোধিত বরাদ্দও খরচ করতে না পেরে প্রায় প্রতিবারই টাকা ফেরত দিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, করোনার সময়ে প্রকল্পের কাজের গতি আগের চেয়ে বেশ কমেছে। আগের মতো পুরোদমে কাজ করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া নদীর পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক গতি নিয়ন্ত্রণের কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এবং খরস্রোতা পদ্মার পানিপ্রবাহ প্রকল্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পদ্মা সেতুর কাজের মেয়াদ আবার বাড়ছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে। পদ্মা সেতুর তিনটি দুর্বল দিক তুলে ধরেছে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এগুলো হলো নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে না। প্রথমত পাইলের নকশা পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সময় ও খরচ বেড়েছে। মানে পদ্মার নিচের স্তরে নরম মাটি হওয়ায় পাইলের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা ও নিরীক্ষা চালাতে হয় বিশেষজ্ঞদের। প্রয়াত বিশেষজ্ঞ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ প্যানেল এক্সপার্টের মতামতের ভিত্তিতে বাড়ানো হয় পাইলের সংখ্যা। ততদিনে পিছিয়ে যায় মূল সেতুর কাজও। এছাড়া ইস্পাত বা স্টিল অবকাঠামোর কারণে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলক বেশি হবে। আইএমইডির এই মতামতের বাইরে আরেকটি বিষয় তুলে ধরেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। সেটি হলোÑ রেলপথ সংযুক্ত করে সেতুর নকশা পরিবর্তন করা হলে এক লাফে খরচ দ্বিগুণ হয়। এতেও ত্রুটি রয়ে গেছে। রেলপথে সিঙ্গল লাইনের সংযোজন করায় স্থায়ী জটিলতা রয়েছে। তাই পদ্মা সেতুতে কখনো ডাবল লাইনের ট্রেন চলতে পারবে না। এর খেসারত দিতে হবে সব সময়। খরচ কমানোর চিন্তা করে এই অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এর আগে দুই দফা পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার মেয়াদ বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যয় বেড়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। নদীশাসনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম কাক্সিক্ষত হারে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সময়সীমা আবার বাড়িয়ে করা হয় ২০২১ সালের জুন মাস। যদিও চীনের ঠিকাদাররা আগেই বলে দিয়েছিলেন যে ২০২২ সালের আগে কাজ শেষ করা যাবে না। এ প্রকল্পে সর্বশেষ হিসাবে খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত তিনবার খরচ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রতিবছর মূল এডিপিতে যত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর পুরোটা কখনই খরচ করতে পারেনি সেতু কর্তৃপক্ষ। অর্থবছরের শেষের দিকে বাধ্য হয়ে বরাদ্দ কমাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংশোধিত বরাদ্দও খরচ করতে না পেরে প্রায় প্রতিবারই টাকা ফেরত দিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। এ পর্যন্ত সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দের টাকা খরচ করতে না পেরে সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ফেরত দিতে হয়েছে।
২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেকে) পাস করা হয়।