ফরিদ আহমেদ : অভ্র ভেদ করে অরুণ উঁকি দিতেই বাইরে পা রাখেন তিনি।
দুপুর প্রায় হয়ে গিয়েছে। তুমুল বৃষ্টির ছাপ এখনো লেগে রয়েছে চারপাশে। গাছের ডাল আর পাতা থেকে জমানো পানি ঝরছে। চারপাশের মাটি ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছে। অতি সাবধানে কাদা বাঁচিয়ে তিনি চলে আসেন তাঁর প্রিয় বাগানে। আলতো করে পা রাখেন দূর্বা ঘাসের নরম বুকে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টি পেয়ে সেগুলো সবুজ আর সতেজ হয়ে উঠেছে। চমত্কার লাগছে ছোট্ট এই ক্ষেত্রটাকে।
অন্যদের কাছ থেকে আলাদা রাখতে গিয়ে তাঁকে বিচ্ছিন্ন একটা ভবনে রাখা হয়েছে। জেলখানায় একা রাখাটা অত্যাচারের একটা অংশ। তাঁকে অবশ্য শুধু সে কারণেই একা রাখা হয়নি। জেল ভরে গিয়েছে তাঁর দলের লোক দিয়ে। তাঁদের সাথে তিনি যাতে যোগাযোগ করতে না পারেন, সেটাই মূল কারণ তাঁকে আলাদা করে রাখার।
বিচ্ছিন্ন ভবনটার সামনে কিছুটা জায়গা অযত্নে পড়ে ছিলো। সেখানেই তিনি সযত্নে বাগান গড়ে তুলেছেন। ফুল ফোটানোর আনন্দের সাথে অন্য কোনো আনন্দের তুলনা হয় না। যারাই এখান দিয়ে যায়, এর সৌন্দর্য দেখে না তাকিয়ে থাকতে পারে না। এমনই মায়াময় আর কোমল বাগান সেটা।
মাঠের মধ্যে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকেন তিনি। তাঁর আগেই মোরগ-মুরগি দম্পতি হাজির হয়েছে সেখানে। সাথে তাদের বাচ্চাগুলোও আছে। কবুতরের বাচ্চাটাকেও তিনি দেখতে পান মোরগটার পাশে ঘুরছে। বাবুর্চি পয়সা বাঁচিয়ে মোরগ-মুরগি দু’টোকে কিনেছিলো। সারাদিন ও দু’টো এই বাগানে ঘোরাফেরা করে। বাবুর্চির পোষা একটা কবুতরের বাচ্চাও আছে। উড়তে শেখেনি এখনো। সেটাকে মোরগ নিজের সন্তানের মতো করে পাহারা দেয়। কবুতরের বাচ্চাও নিশ্চিন্তে মোরগের পায়ে পায়ে ঘোরে। মুরগি আর মুরগির বাচ্চাগুলো কবুতরের বাচ্চাকে ঠোকরাতে এলে মোরগ রুখে দাঁড়ায়। কাক হামলা করতে এলে মোরগ তেড়েফুড়ে যায় কাকের দিকে।
তিনি যখন বাগানে আসেন, এগুলোকে দেখে বেশ আনন্দ হয় তাঁর। মোরগের সাথে নিজের কিছুটা মিল অনুভব করেন তিনি। আজ অবশ্য মনটা বিক্ষিপ্ত দেখে এদের দিকে মনোযোগ দিতে পারেন না তিনি। মাঠের এদিক থেকে ওদিকে হাঁটতে থাকেন তিনি আনমনে। মুখে রাখা পাইপে টান দিতেও ভুলে গিয়েছেন তিনি।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি তাঁর। এটা অবশ্য এই সেলে নতুন কিছু না। সেলের পাশেই পাগলা গারদ। পাগল ধরনের সব কয়েদিদের ওখানে রাখা হয়। এদের পাগলামি রাতের বেলাতে বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন রাতে কেউ না কেউ হাঙ্গামা করে। গতরাতেও একজন করেছিলো। সারারাত অশ্লীল সব শব্দ ব্যবহার করে গালিগালাজ করেছে গলা ছেড়ে দিয়ে। এই সব হাঙ্গামার মধ্যেও তিনি ঘুমোতে পারেন। প্রতিকুল পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার আশ্চর্যজনক এক ক্ষমতা তাঁর আছে। কাল সেটা পারেননি। পাগলের গালিগালাজ মাথার ভিতরে হাতুড়ি পেটা করেছে। সকালে নাস্তা করে কম্বল গায়ে জড়িয়ে বই নিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু, তাতেও মনঃসংযোগ করতে পারেন নাই। তাকিয়ে ছিলেন বইয়ের পাতার দিকে। কিন্তু মন পড়ে ছিলো অন্য কোনো খানে।
গতকাল দুপুরে রেণু এসেছিলো ছেলেমেয়েদের নিয়ে। বলে গেছে, ‘মা খুব অসুস্থ। হয়তো আর বাঁচবে না। পারলে প্যারোল নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে।’ মায়ের কথা মনে হতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যায় তাঁর। ঘন ঘন জেলে আসা যাওয়া করতে করতে মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ আর সেভাবে হয় না। তিনি এভাবে বার বার জেলে যান বলে তাঁর সহজ সরল মা একদিন বলেছিলো, ‘বাবা, যে লোক তোকে খামোখা জেলে নেয়, একবার আমাকে তার কাছে নিয়ে যাসতো। আমি বলে দেবো তাকে।’
মনে মনে হেসে ফেলেন তিনি। যারা তাঁকে জেলে নেয়, তারা কতোখানি ভয়ংকর লোক মা যদি জানতো। সহজ সরল এক গ্রাম্য মায়ের কথাতে তাদের কিছু যায় আসে না।
তিনি ছয়দফা দেবার পরেই এরা তাঁর পিছনে সমস্ত শক্তি দিয়ে লেগেছে। কারণ, তারা খুব ভালো করেই জানে ছয়দফার আড়ালে আসলে একটা চরম দফা লুকিয়ে আছে। সেই এক দফাকে যেভাবেই হোক বানচাল করতে হবে তাদের। যে কারণে তাঁকে জেলে পুরেছে। বাইরে যারা আন্দোলন করছিলো তাদের সবাইকে ধরে আনা শুরু করেছে। বালক থেকে শুরু করে বুড়ো, কাউকেই বাদ রাখছে না তারা। আশি নব্বই জন তরুণ ছেলেকে ছোট্ট কয়েকটা সেলের মধ্যে গাদাগাদি করে রেখে দিয়েছে। জেলে যাদের আনছে তাদের ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হচ্ছে না। তিনি সবকিছু জানতে পারছেন, কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না। এর থেকে বড় দুঃখ আর কী আছে তাঁর জন্য?
তাঁর ছোট ছেলেটা জানে এটাই তাঁর বাড়ি। সে বলে, আব্বার বাড়ি। আব্বার বাড়িতে আব্বা যে কতোটা অসহায়, শক্তিহীন, সেটা ওই অবুঝ শিশুটা জানে না। ছোট মেয়েটা কাল যাবার আগে গাল ফুলিয়ে আবদার করেছিলো তার সাথে থাকবে বলে। তিনি বুঝিয়ে শুনিয়ে ফেরত পাঠিয়েছেন। কিন্তু, বুকটা ফেটে গিয়েছে মেয়েটার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না দেখে। দেশের সকল মানুষের দুঃখ জয়ের লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি, নিজের বাচ্চাদের দুঃখ মোছানোর সময় কোথায় তাঁর?
পায়চারি করতে করতে ঘাসের দিকে তাকান তিনি। ঝির ঝির করে হিম বাতাস বইছে। দূর্বা ঘাসগুলো বাতাসের তালে তালে নাচছে। আনন্দের জোয়ারে ভাসছে তারা। আহা! মানুষের জীবন যদি এমন আনন্দময় হতো, তিনি ভাবেন। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তাঁর প্রশস্ত বুক থেকে।
হঠাত করেই থমকে দাঁড়ান তিনি। ভ্রু কুঁচকে গিয়েছে তাঁর। ঘাসের মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে কয়েকটা আগাছা। শ্রাবণ ধারায় তারাও সজীব হয়ে উঠেছে ঘাসের মতোই।
আগাছাকে তিনি ভয় পান খুব। অপছন্দ করেন প্রচণ্ড রকমের। এগুলোকে না তুলে ফেললে বাগান ধ্বংস করে দেয়। সবুজ দূর্বাগুলো যে অমন আনন্দে আন্দোলিত হচ্ছে বাতাসের ছোঁয়া পেয়ে, সেটা তাঁর যত্নের কারণেই। তিনি প্রতিদিন আগাছা পরিষ্কার করেন। আগাছা হচ্ছে পরগাছা। পরগাছা রাজনীতিবিদরা যেমন দেশপ্রেমিকদের ধ্বংস করে ফেলে, তেমনি আগাছাও সাজানো বাগানকে নষ্ট করে দেয়।
দীর্ঘ শরীরটাকে ভাঁজ করে হাঁটু মুড়ে ঘাসের উপরে বসেন তিনি। পাজামায় কাদা লেগে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই তাঁর। সামান্য ঝুঁকে লম্বা হাতটাকে বাড়িয়ে দেন একটা আগাছার দিকে। সেটার গোঁড়া ধরে হেঁচকা একটা টান দেন তিনি। বৃষ্টিভেজা নরম মাটি থেকে শিকড়সহ উপড়ে আসে সেটা সহজেই। তৃপ্তির চোখে তিনি তাকান ওটার দিকে। তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে ঘৃণাভরে সেটাকে ছুড়ে দেন বাগানের বাইরে। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা অক্ষিযুগল চঞ্চল হয়ে ওঠে অন্য পরগাছার সন্ধানে।
প্রবল আক্রোশে একটার পর একটা আগাছাকে উপড়াতে থাকেন তিনি।