দাউদ হায়দায় : ‘বিন্দু, বিন্দু’ শিরোনামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকার একটি পাক্ষিকে কলাম লিখতেন, বছর ত্রিশ আগে। ছোট লেখা। এক পৃষ্ঠা (ছাপায়)।
এক লেখায় পড়েছিলুম, আমেরিকার কোনও অঙ্গরাজ্যে (মনে পড়ছে না অঙ্গরাজ্যের নাম, সুনীল নিশ্চয় লিখেছিলেন) সত্তর দশকের গোড়ায়, একজন শ্বেতাঙ্গ এক তাগড়া জোয়ান কৃষ্ণকে গুলি করে মেরে নদীতে ফেলে দেয়। হত্যাকারীকে পুলিশ জিজ্ঞেস করলে উত্তর ‘মাছের খাদ্য দরকার।’ কী সাজা হয়েছিল খুনির, সুনীল লেখেননি। প্রয়োজনও নেই। শাদা চামড়ার মানুষ তথা আমেরিকান কালো রঙের মানুষকে যখন খুশি, ইচ্ছে মতন মারবে, হত্যা করবে, এটাই যেন গরজ, অধিকার।
পুলিশ খুন করলে, বিনা অপরাধেও, পুলিশি সাফাই রাষ্ট্রপক্ষ, আদালত মেনে নেয়, অনেকাংশেই। ভূরি ভূরি প্রমাণ। আগেও এখনও। এবং পুলিশের হত্যা জায়েজ করার জন্য খুব বেশি সাক্ষীসাবুদ দরকার নেই। আমেরিকায় এমনই বিধান, ‘সমাজরাষ্ট্রের প্রয়োজনে পুলিশের কর্তব্য।’ খুন করেও মাফ। পুলিশের উচ্চপদস্থ কেউ যদি খুনি, বিশেষত ক্রিমিনালকে, তাঁর কোনও বড়োরকম সাজা হয়েছে, এই নথি পাওয়া প্রায়-দুষ্কর। আমেরিকার আইনেই বহুবিধ জটিলতা।

মিনিয়াপোলিসে জর্জ ফ্লয়েডকে যে পুলিশ অফিসার হত্যা করেছে তাঁকে, জেলে পোরা হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর কী দণ্ড, সমস্যা ইতিমধ্যেই শুরু। তর্কও চলছে। কেননা, ‘সমাজরাষ্ট্রের প্রয়োজনে পুলিশি করণীয়।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এই গীতের বাজনদার, শুরুতে। বুঝতেও পারেননি, রাগ-তাল-লয়-সুর কাহারবা না দাদরা, বোলে হোঁচট খান, চুপ অতঃপর। কিন্তু ততক্ষণে প্রকাশিত, পুলিশ ও শাদার পক্ষে তাঁর ঝাঁপতাল। তীব্র সমালোচনার মুখে অন্যগীত। যা, তাঁর স্বভাব। সাজিয়েগুছিয়ে মিথ্যে বলায় জুড়ি নেই। অদ্বিতীয়। অতীতের সমস্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টের অতীত ভঙ্গ করেছেন, ইতিহাসে নাম থাকবে, মুছবে না।

জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার সময়কালে পুলিশ অফিসারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ভিডিও করেছেন কেউ, আট মিনিটের ভিডিও। এই ভিডিওকরণে পুলিশকর্তা ফেঁসে গেছেন। ভিডিও যদি না করতেন, ঘটনা যদি প্রত্যক্ষ, স্পষ্ট, জ্বলজ্বলে প্রমাণ না থাকতো, পুলিশকর্তাকে ফাঁসানো কি সহজ ছিল? পুলিশের বক্তব্যই কি রাষ্ট্র শিরোধার্য করতো না?

বলা হচ্ছে এখন, আমেরিকা দুই ভাগে বিভক্ত। এখন? আমেরিকা কবে ‘এক ভাগ’ ছিল? আমেরিকার জন্ম থেকেই বহুভাগ। ইতিহাস বলছে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানই পরতে-পরতে, নানা কৌশলে ভাগ করছে আমেরিকা।

প্রত্যেকে জানে, শাদা আমেরিকান মানেই ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ, দেশত্যাগী হয়ে, আমেরিকায় ঠাঁই গেড়ে, ‘স্বদেশী’ (আমেরিকান)।

ট্রাম্পের বাপ, বংশকুল উত্তর জার্মানির। ট্রাম্পের জ্ঞাতিদের অনেকেই এখনও জার্মান নাগরিক। এক জেঠতুতো বোনও।

প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট (আমেরিকার) সিনিয়র বুশ, জুনিয়র বুশেরও পূর্ব পুরুষ জার্মান। জুনিয়র বুশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রামসফেল্ডও (উত্তর জার্মানির)। নিক্সনের বহুখ্যাত প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার উত্তর জার্মানির। গ্রামের নাম কিসিঙ্গার। জার্মান ‘কিসিঙ্গার’ আমেরিকায় হয়ে যায় কিসিঞ্জার। এই কুটিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে এখনও জার্মানভাষা সচল। তিনিও চমৎকার জার্মান বলেন। বলিউডের নামি অভিনেত্রী সান্দ্রা বুলক পূর্ব জার্মানির, পরিবারে জার্মান ভাষা ‘ঘরোয়া।’ বলেছেন সাক্ষাৎকারে (জার্মান টিভি এআরডি-তে)। হাজার-হাজার উদাহরণ। অতদূরে যাই কেন, আমাদের বহুমান্য সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের আসল নাম অ্যালিস ভার্জিনিয়া ওর্নডোর্ফ। তাঁর পূর্ব পুরুষ দক্ষিণ জার্মানির ওর্নডোর্ফ গ্রামের। গ্রামটি এখন আরো বর্ধিষ্ণু। চমৎকার গ্রাম।

লীলা রায়ের লেখায় পড়েছি, পিতৃপুরুষের পূর্বকুল জার্মানি ছেড়ে টেক্সাসের এল পাসো’য় ঠাঁই গাড়েন। অধিকাংশই মেক্সিকানের বাস।

বছর ৩৩ আগে এল পাসো’য় গিয়ে দেখলুম, মেক্সিকানের সংখ্যা কম। শাদার দখলে।

শাদারা কালো দেখলে ভয় পায়। আমেরিকায় যেসব অঞ্চলের শাদার বাস, ওখানে যদি কালোরা জায়গাজমিন কেনে, ৫/৬ মধ্যে শাদা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পাশাপাশি থাকতে নারাজ। কালোকে ঘেন্না করে।

নিউ ইয়র্কের মতো কসমোপলিটান সিটিতে কয় ঘর শাদা-কালোর বাস? প্রায়-নেই। অন্য শহরের কথা বাদ দিলুম।

পশ্চিম কুইন্স (নিউ ইয়র্ক) উচ্চবিত্তের বাস। যে বন্ধুর আস্তানায় আতিথ্য তিনিও উচ্চবিত্ত, বললুম, তোমার কোনও পতাকা নেই, কিন্তু তোমার বাড়ির সামনে এক বাড়িতে মার্কিন পতাকা, কারণ কী? বন্ধু বললেন, ‘ওরা মার্কিনি, আমরা নই, এটাই জানান দেন মার্কিন পতাকা দেখিয়ে। ‘আমরা কালো, ওরা শাদা।’

হাড়েমজ্জায় টের পাই, প্রতিবছরই আমেরিকার নানা রাজ্যে যেতে হয় সাহিত্য সম্মেলনে, কবিতা পাঠে, বক্তৃতায়। ‘উই ক্রিয়েটেড ডিসক্রিমেশন,’ বললেন এক শ্বেতাঙ্গ মার্কিন কবি।

বললুম, ‘এখানেও নিশ্বাস নিতেও ভয়। তোমাদের সাম্যবাদ, গণতন্ত্রকে ভয়।’ মরার আগে জর্জ ফ্লয়েড বলেছেন ‘আই কা’ন্ট ব্রিদ।’ জার্মানিসহ ইউরোপেও নিশ্বাস নিতে ভয়, কষ্ট, ভিনদেশির। গণতন্ত্র, মানবিকতা মৌখিক। ভুক্তভোগী আমরা।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক