অনলাইন ডেস্ক : আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর সোমবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং হামাসের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সন্দেহে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেছেন। যুগান্তকারী অনুরোধটি ইসরায়েলে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ আবেদনটিকে ‘একটি ঐতিহাসিক কলঙ্ক, যা চিরকাল মনে রাখা হবে’ বলে নিন্দা করেছেন।
প্রসিকিউটর করিম খান বলেছেন, তিনি নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে ‘অনাহার’, ‘ইচ্ছাকৃত হত্যা’, ‘নির্মূল এবং/অথবা হত্যা’সহ নানা অপরাধের জন্য ওয়ারেন্ট চাইছেন।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা দাখিল করছি, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগগুলো রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরণ করে ফিলিস্তিনি বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ হিসেবে সংঘটিত হয়েছে। এই অপরাধগুলো আমাদের মূল্যায়নে, আজও অব্যাহত রয়েছে।’
গাজার আন্দোলন হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়াহসহ হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ‘হত্যা’, ‘ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সহিংসতা’ এবং ‘যুদ্ধাপরাগ হিসেবে জিম্মি করা’।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা প্রস্তাব করছি, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগগুলো সাংগঠনিক নীতি অনুসরণ করে হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ইসরায়েলের বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যাপক ও পদ্ধতিগত আক্রমণের অংশ।
করিম খান অভিযোগ করেছেন, দুই হামাস নেতা এবং হামাসের সশস্ত্র শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফ গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলার সময় ‘শত শত ইসরায়েলি বেসামরিককে হত্যার জন্য অপরাধমূলকভাবে দায়ী’।
এদিকে হামাস বলেছে, তারা তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য আইসিসির প্রসিকিউটরের আবেদনের ‘কঠোর নিন্দা’ করে। তবে তারা নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসির পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে। গোষ্ঠীটি এক বিবৃতিতে বলেছে, হামাস আন্দোলন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর কর্তৃক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদনের দৃঢ়ভাবে নিন্দা জানায়।
এ পদক্ষেপকে নির্যাতিত ও ‘ঘাতক’দের একই দৃষ্টিতে দেখার প্রচেষ্টা বলেও মন্তব্য করেছে।
২০২১ সালে আইসিসি প্রসিকিউটর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের জন্য ইসরায়েলের পাশাপাশি হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছেন, এই তদন্ত এখন ‘৭ অক্টোবর সংঘটিত হামলার পর থেকে শত্রুতা ও সহিংসতার বৃদ্ধির দিকে প্রসারিত হয়েছে’।
আইসিসির বিচারকরা এখন সিদ্ধান্ত নেবেন, আবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়ারেন্ট জারি করার শর্ত পূরণ করে কি না। এ প্রক্রিয়ায় কয়েক সপ্তাহ বা এমনকি মাসও লাগতে পারে।
প্রসিকিউটর বলেছেন, ‘আজ আমরা আবারও জোড় দিয়েছি, আন্তর্জাতিক আইন ও সশস্ত্র সংঘাতের আইন সবার জন্য প্রযোজ্য। কোনো পদাতিক সেনা, কোনো কমান্ডার, কোনো বেসামরিক নেতা—কেউই দায়মুক্তভাবে কাজ করতে পারেন না।’
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হামাস ও ইসরায়েল সংঘর্ষের জন্য যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের মুখোমুখি হতে পারে। প্রবীণ যুদ্ধাপরাধের প্রসিকিউটর রিড ব্রডি বলেছেন, আবেদনটি ‘আন্তর্জাতিক বিচারের ইতিহাসে একটি বিভাজন রেখা’।
‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণ’ প্রমাণ
যদি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মঞ্জুর করা হয় তবে এর অর্থ হবে, কৌশলগতভাবে ১২৪টি আইসিসি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে যেকোনোটিতে নেতানিয়াহু ভ্রমণ করলে সে দেশ তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে। ফলে ওয়ারেন্ট নেতানিয়াহুর জন্য কিছু ভ্রমণকে জটিল করতে পারে। এ আদালতের ওয়ারেন্ট কার্যকর করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি অনুসরণ করা সদস্যদের ওপর নির্ভর করে।
এদিকে আদালত পদক্ষেপ নিতে চলেছেন বলে গুজব কয়েক সপ্তাহ ধরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে নেতানিয়াহু আগেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। তিনি এক্সে একটি বার্তায় বলেছেন, ইসরায়েল আইসিসির ‘আপত্তিকর’ রায় ‘কখনো মেনে নেবে না। আমরা তাদের কাছে মাথা নত করব না’।
নভেম্বরের মাঝামাঝি পাঁচটি দেশ ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের জন্য আইসিসি তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল। প্রসিকিউটর করিম খান বলেছিলেন, তার দল ‘প্রাসঙ্গিক ঘটনা’ সম্পর্কে একটি ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণ’ প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। কিন্তু আইসিসির দলগুলো গাজায় প্রবেশ করতে পারেনি বা ইসরায়েলে তদন্ত করতে পারেনি। দেশটি আইসিসির সদস্য নয়। তা সত্ত্বেও ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের ‘অনুরোধে’ নভেম্বরে করিম খান ইসরায়েল সফর করেছিলেন। এরপর তিনি ফিলিস্তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় যান।
আইসিসি হলো গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ গুরুতর অপরাধের তদন্তের জন্য ২০০২ সালে গঠিত বিশ্বের একমাত্র স্বাধীন আদালত। এটি ‘শেষ অবলম্বনের আদালত’ এবং কেবলমাত্র কোনো দেশ নিজেরাই মামলা তদন্ত করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম হলেই পদক্ষেপ নেয়৷
এর আগে আইসিসি ২০২৩ সালের মার্চ মাসে শিরোনাম হয়েছিল। তখন ইউক্রেনীয় শিশুদের বেআইনিভাবে নির্বাসনের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য এই আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। একই ধরনের অভিযোগে রাশিয়ার শিশুদের অধিকার বিষয়ক প্রেসিডেন্টের কমিশনার মারিয়া লভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধেও আদালত পরোয়ানা জারি করেছেন।
সূত্র : এএফপি