ফরিদ আহমেদ : ছেলেটার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে ম্যানচেস্টারের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে। তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এই পরিচয়। আকাশচুম্বী এক অবস্থান থেকে পতনের অতল গহ্বরে তলিয়ে যান তিনি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। শুধু পতন না, আত্মহনন করে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া লাগে তাঁর। অকালে শেষ হয়ে যায় বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কটা।

ছেলেটার নাম আর্নল্ড মুরে। মাত্র উনিশ বছর বয়স। রুগ্ন স্বাস্থ্য আর পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাস্তায় ঘুরছিলো সে। লন্ডনে এক ছিঁচকে চুরির অভিযোগে ম্যানচেস্টারে প্রবেশনে ছিলো সে।
ছেলেটার এই করুণ অবস্থা দেখে মায়া জন্মায় তাঁর। মায়ার পিছনেও ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিলো অবশ্য। যে জিনিসের জন্য প্যারিস কিংবা গ্রীসে যাওয়া লাগে তাঁর সংগোপনে, সেই জিনিস ম্যানচেস্টারেই সহজে পেয়ে গেলে আনন্দ হবারই কথা। তিনিও আনন্দিত হয়েছিলেন মুরেকে পেয়ে। একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে মুরেকে লাঞ্চ খাওয়ান তিনি। নিজের বাসার ঠিকানা দিয়ে উইক এন্ডে আসতে বলেন।

মুরের সাথে গোপন যৌন জীবনে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এটা হয়তো গোপনই থাকতো। কেউ যাতে তাঁদের সম্পর্ক বুঝতে না পারে, সেজন্য যতোটা গোপনীয়তার আশ্রয় নেওয়া যায়, তার সবটুকুই তিনি নিতেন। সমস্যা বাধে মুরের সেই ছিঁচকে চুরির অভ্যাস থেকে। একটা সময়ে গিয়ে তিনি টের পান মুরে তাঁর মানিব্যাগ থেকে টাকা সরাচ্ছে। জিজ্ঞেস করার পরে সে বিষয়ে অস্বীকার করে মুরে। তিনিও প্রেমের টানে মুরের কথায় বিশ্বাস করেন। মুরের আর্থিক দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে তাকে কিছু টাকাও ধার দেন তিনি। এখানেই সব মিটে গেলেই ভালো ছিলো। সেটা হয় না দুর্ভাগ্যক্রমে।

একদিন তিনি রাতের বেলা বাড়িতে ফিরে এসে দেখেন তার বাড়িতে চুরি হয়েছে। যদিও খুব বেশি মূল্যবান কিছু চোর নেয়নি, তারপরেও ঘটনাটা তাঁকে মর্মাহত করে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এই চুরির সাথে যে মুরে জড়িত রয়েছে, সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয় না তাঁর। পৃথিবীর সেরা গণিতবিদ তিনি, এইটুকু লজিক্যাল ক্যালকুলেশন না করতে পারলে আর অতো বড় গণিতবিদ হলেন কী করে?

মুরেকে সে কথা বলার পরে সে এটা অস্বীকার করে যথারীতি। তবে, এটা বলে যে তার পরিচিত এক বদমায়েশ হ্যারি এই কাজ করতে পারে। কারণ, মুরে গিয়ে তাঁর বাড়িতে কী সব মূল্যবান জিনিস আছে সেগুলোর গল্প সে তার বন্ধু-বান্ধবদের করতো। হ্যারি তখন বলেছিলো যে চলো আমরা ওই বাড়িতে একদিন চুরি করি।

মুরেকে এই ঘটনায় না জড়িয়ে শুধু হ্যারিকে আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশের কাছে যান তিনি। দুইজন চোরের বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে একজন হ্যারি আর অন্যজন কাল্পনিক একজন। পুলিশ হ্যারিকে ধরে ফেলে। এখান থেকেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। হ্যারি জানায় এই চুরির সাথে মুরেও জড়িত ছিলো। এবং মুরের সাথে বাড়ির মালিকের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। তাঁর দেওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে মুরের দৈহিক বর্ণনা না মেলাতে পুলিশ ফিরে আসে তাঁর কাছে। জিজ্ঞেস করে পুলিশের কাছে মিথ্যের বলার কারণ কী?
এই পর্যায়ে গিয়ে তিনি সব সত্যি কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। হ্যারির মাধ্যমে পুলিশ এই বিষয়ে জানলেও, তাঁর সুউচ্চ অবস্থান এবং সম্মানের কথা বিবেচনা করে এটাকে চেপে যাবার সিদ্ধান্তই নিয়েছিলো। কিন্তু, তিনি নিজেই হয়তো গোপনীয়তার এই ভার বহন করতে পারছিলেন না। পুলিশের কাছে তিনি স্বীকার করেন যে তিনি একজন সমকামী ব্যক্তি। মুরের সাথে তাঁর অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। সেগুলোর বিস্তারিত বর্ণনাও তিনি দেন। ফলশ্রæতিতে, পুলিশের হাতে আর কোনো অপশন খোলা থাকে না। সামান্য এক চুরির বিচার এখন অনৈতিক যৌন সম্পর্কের বিচারের দিকে গড়ায়।

এতক্ষণ যাঁর কথা বললাম, তাঁর নাম হচ্ছে অ্যালান টুরিং। বিশ্ব শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ তিনি। তাঁর হাত ধরেই আজকের আধুনিক কম্পিউটার জন্ম নিয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সেরও জনক তিনি। মানুষ এবং যন্ত্রের পার্থক্য করার টুরিং টেস্টের জন্মদাতা তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান এনিগমা কোড ভেঙেছিলেন তিনি। এর কারণে যুদ্ধ প্রায় দুই বছর সংক্ষিপ্ত হয়েছিলো। বেঁচে গিয়েছিলো কয়েক মিলিয়ন মানুষের জীবন। ২০১১ সালে ওবামা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে যে ভাষণ দেন, সেখানে তিনি তিনজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করেছিলেন। নিউটন এবং ডারউইনের সাথে তৃতীয় নাম হিসাবে উচ্চারিত হয়েছিলো অ্যালান টুরিং এর নাম।

টুরিং এর সময়ে, পঞ্চাশের দশকের শুরুতে, সমকামিতাকে অস্বাভাবিক মানসিক রোগ হিসাবে বিবেচনা করা হতো। ব্রিটেনে এর বিরুদ্ধে কড়া আইন ছিলো। শাস্তি ছিলো জেল দণ্ড। টুরিং-কে অবশ্য জেল দণ্ড দেওয়া হয় না। তাঁকে এক বছরের প্রবেশনে রাখা হয়। এই সময় ম্যানচেস্টার রয়্যাল ইনফার্মারি-র সুযোগ্য ডাক্তারদের কাছ থেকে তাঁকে চিকিৎসা নিতে হবে। সেই সময়ে ধারণা করা হতো অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরন হরমোনের কারণে পুরুষ মানুষের মধ্যে সমকামিতার মতো বিকৃতি জন্ম নেয়। ফলে, তাদেরকে ইস্ট্রোজেন হরমোন পুশ করা হতো। কেমিক্যাল ক্যাস্ট্রেশন বা রাসায়নিক খোজা করণ বলা হতো একে। টুরিং-কেও তাই করা হয়। এর প্রভাবও পড়ে তাঁর শরীরের উপরে। এক পর্যায়ে গিয়ে তিনি তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন যে তাঁর স্তন বিকশিত হচ্ছে হরমোনের প্রভাবে।

এই বিচার, প্রবেশন পার হয়ে যাবার দুই বছর পরে, ১৯৫৪ সালের জুন মাসের সাত তারিখে আকস্মিকভাবে আত্মহত্যা করেন অ্যালান টুরিং। ময়নাতদন্তে দেখা যায় পটাসিয়াম সায়ানাইডের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বিছানায় মৃত হিসাবে পাওয়া গিয়েছিলো তাঁকে। পাশেই একটা কামড় দেওয়া এ্যাপেল ছিলো। যদিও এই এ্যাপেলের রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়নি। তারপরেও ধারণা করা হয় এ্যাপেলের মধ্যে সায়ানাইড ইনজেক্ট করে সেটাতে কামড় দিয়েছিলেন তিনি স্বেচ্ছায়। এ্যাপেল কম্পিউটারের লোগো টুরিং এর বিষাক্ত এ্যাপেল কামড়ানো থেকে এসেছে বলে অনেকেই ধারণা করে। এ্যাপেলের পুরনো লোগোতে রংধনু ছিলো, যেটা সমকামীদের প্রতীক, সেটাও সেই ধারণাকে উস্কে দিয়েছিলো। যদিও স্টিভ জবস এটাকে অস্বীকার করেছেন পরিষ্কারভাবে।

টুরিং এর আত্মহত্যার পিছনে তাঁর সমকামিতার বিচারকেই সবাই দায়ী করে। এর কারণে তাঁকে যে পরিমাণ সামাজিক অমর্যাদা এবং অসম্মানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যে ধরনের মনোচিকিৎসা নিতে হয়েছে বা ইস্ট্রোজেন হরমোনকে গ্রহণ করতে হয়েছে, তাতে করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে তিনি আত্মহত্যা করেছেন ঘটনার দুই বছর পরে। এক বছর আগেই তাঁর প্রবেশন শেষ হয়ে গিয়েছে, মনোবিদের কাছে আর যেতে হয়নি, ইস্ট্রোজেন হরমোনও নিতে হয়নি। পেশাগত জায়গাগুলোও স্বাভাবিক হয়ে আসছিলো। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিতে রিডার হিসাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ঘটনার শুরু দিকে আত্মহত্যা করলে, এটাকে সরাসরি সেই ঘটনার সাথে জড়িয়ে দেওয়া যেতো, কিন্তু দুই বছর পরে যখন তিনি এর সবকিছুকে অতিক্রম করে গিয়েছেন, তখন গ্লানি থেকে আত্মহত্যা করাটা একটু অস্বাভাবিকই। কোনো কারণে হয়তো জীবনকে বেশি ভারি মনে হয়েছিলো তাঁর কাছে। সে কারণেই হয়তো ভার লাঘব করতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি ভার লাঘব করেছিলেন। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়স হয়েছিলো তখন তাঁর। তাঁর ভার লাঘব পৃথিবীর জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে এসেছিলো।
সমকামিতা যে কোনো মানসিক রোগ না, বরং বিষমকামিতার মতোই স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক একটা বিষয়, এটা সত্তরের দশক থেকে মনোবিজ্ঞানীরা একমত হওয়া শুরু করে। উন্নত বিশ্বে সমকামিতা এখন স্বীকৃত, একে বিকৃতি হিসাবে বলার আর কোনো সুযোগ নেই। টুরিং এর দুর্ভাগ্য আর মাত্র দুই বা তিন দশক পরে তাঁর ঘটনাটা ঘটলে সামান্যতম কোনো আলোড়নই সৃষ্টি হতো না, বিচারতো অনেক দূরের কথা।

ব্রিটেন তাদের এনিগমা কোড ভাঙার কাহিনিকে রাষ্ট্রীয় গোপন দলিল হিসাবে পঞ্চাশ বছর ক্লাসিফায়েড করে রেখেছিলো। এই কাহিনি পাবলিক হবার পরে টুরিং এর অসামান্য অবদান সবার সামনে ভেসে ওঠে। তাঁকে নিয়ে এক আবেগী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ২০০৯ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন সরকারীভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন টুরিং এর বিচারের ঘটনা। ২০১৪ সালে রয়্যাল পারডন ঘোষিত হয় টুরিং এর জন্য। রানী এলিজাবেথের এই রয়্যাল পারডনিং এর প্রেক্ষিতে আরেক দাবী উঠে আসে। ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সমকামিতার জন্য পঞ্চাশ হাজার মানুষকে শাস্তি দিয়েছিলো ব্রিটেনের আদালত। তাদের আত্মীয়স্বজনরা এই সব সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মরণোত্তর সাজা তুলে নেবার দাবী জানায়। সরকারকে তাদের দাবী মেনে নিতে হয়।

অ্যালান টুরিং এর বন্ধুরা অবশ্য রয়্যাল পারডন এর জন্য বসে থাকেননি। ১৯৬৬ সাল থেকে তাঁরা চালু করেছ্নে টুরিং এওয়ার্ড। কম্পিউটার সায়েন্সের নোবেল প্রাইজ হিসাবে বিবেচিত এই টুরিং এওয়ার্ড।